নেশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ

নেশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ

মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রেরণা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে

মানুষের কোনও কাজ বা স্বভাবের মধ্যে পরিবর্তন আনার জন্য প্রেরণার প্রয়োজন হয়। কাউকে জোর করে কিছু করানো যায়না। একজন মাদকাসক্ত বা নেশাগ্রস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই কথাটি খুব খাঁটি।

একজন ব্যক্তি যিনি কোনও নেশার দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল, তিনি অন্যদের থেকে সহজে তাঁর চিকিৎসা করানোর জন্য সাহায্য চাইবেন না। অবস্থার সামাল দেওয়া শুরু করা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে তাঁদের প্রেরণা ও ইচ্ছাশক্তির মধ্যে খামতি দেখা যায়। প্রেরণার মধ্য দিয়ে মানুষের মাদকাসক্তি কমানোর চেষ্টা করলে তা থেকে বেড়িয়ে আসা সেই ব্যক্তির ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে। প্রেরণা মানুষকে সক্রিয় করে তোলে নিজেকে বদলাতে উৎসাহ দেয়। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চিন্তার স্বাধীনতা দিলে তাঁরা নেশা ছাড়তে চান না এবং চিকিৎসক বা পরিবারের সদস্যদের কথা শোনেন না। কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন নিজের পরিবর্তনের জন্য নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করেন, তখন তাঁর মধ্যে মনোবল তৈরি হয় এবং তাঁর চিকিৎসার ফলও ভাল হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রত্যেক মানুষই নিজেদের আচরণগত বদলের সময় কিছু অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে যান। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিও এই অধ্যায়গুলির মধ্যে দিয়ে যান, যখন তাঁদের চিকিৎসা চলে।

গভীর চিন্তা ভাবনার আগে: এই পর্যায়ে একজন ব্যক্তি তাঁর কুঅভ্যাসগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেও তিনি নিজেকে বদলাতে চান না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু করার আগে একজন চিকিৎসকের উচিত তাঁর সঙ্গে একটি ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা, এবং জানা যে তিনি কোন পরিস্থিতিতে নেশা মুক্ত হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অতঃপর তাঁর সিদ্ধান্তকে কুর্নিশ জানিয়ে চিকিৎসার পদ্ধতি খুঁজে বার করা উচিত।

এই পর্যায়ে সেই ব্যক্তিকে নেশার দ্রব্য সেবন করার খারাপ দিকগুলি সম্পর্কে সচেতন করা হয়। ধরে নিন একজন যদি হতাশায় ভুগতে থাকেন, তাঁকে বোঝানো হয় কি করে মদ্যপানের কারণে তাঁর হতাশার মাত্রা আরও বেড়ে চলেছে। একজন চিকিৎসক সেই ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্যের সাহায্য নিতে পারেন তাঁর সমস্যা এবং তাঁর পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য।


গভীর চিন্তা ভাবনার পরে: এই পর্যায়ে একজন ব্যক্তি নেশা করার ভাল ও খারাপ দিকগুলির ব্যাপারে সচেতন থাকেন কিন্তু ভাবতে থাকেন তাঁদের পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি না। কেউ কেউ তাঁদেরকে বলেন তাঁদের পদক্ষেপ সম্পর্কে ভাল ও খারাপ জিনিসগুলি পাশাপাশি লিখতে। এই কাজটি তাঁদেরকে বাড়িতে করতে বলা হতে পারে, এবং চিকিৎসক সেই লেখাগুলি পরের সেশনে দেখতে পারেন অথবা সেশন চলাকালীন তাঁকে এটি লিখতে বলতে পারেন। মাদকাসক্ত ব্যক্তির মনে অনুপ্রেরণা জোগালে তাঁর ইচ্ছাগুলি বাস্তবে রুপান্তরিত হবে। একজন চিকিৎসক মাদকাসক্ত ব্যক্তির দোটানাটিকে তাঁকে ভাল করে বোঝাতে পারেন যার ফলে সে নেশা করা এবং নিজের উন্নতির মধ্যে পার্থক্যটি বুঝতে পারবেন। এর ফলে সেই ব্যক্তি নেশা করার খারাপ প্রভাবগুলি বুঝতে পারেন বা অবশেষে নেশা করা বন্ধও করে দিতে পারেন।

প্রস্তুতিঃ একজন মানুষ যখন নিজেকে বদলানোর সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা নিজেদের আরোগ্যের পরিকল্পনা করেন। এই অবস্থায় তাঁর চিকিৎসক ও পরিবারের কর্তব্য তাঁকে আরও অনুপ্রেরিত করা। তাঁকে তাঁর ইচ্ছাশক্তির উপর জোর রাখতে বলতে হবে এবং বলতে হবে অন্য আরেকজন ব্যক্তিকেও নেশা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে। এর ফলে সেই ব্যক্তিটির মধ্যে দায়িত্ববোধ জন্মাবে এবং তিনি নেশার থেকে দূরে সরে থাকতে পারবেন। সংক্ষিপ্ত হস্তক্ষেপের জন্য সেই ব্যক্তি নিজের পছন্দমত চিকিৎসা পদ্ধতি বেছে নিতে পারবেন।

এই পর্যায়ে ব্যক্তির চিকিৎসা নেওয়ার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। তাঁকে তাঁর ভালর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার, তাঁর চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষমতাকে উৎসাহ দেওয়া দরকার, তাঁকে কোন কাজটি করতে হবে এই বিষয়ে তাঁর সাহায্য করা প্রয়োজন এবং তাঁকে বোঝানো উচিত যে কোনও সমস্যা দেখা দিলে যেন তাঁর সঙ্গে তাঁর চিকিৎসকের সম্পর্কে যেন কোনও ভাবে খারাপ না হয়। তা হলে প্রস্তুতি পর্যায়ের একজন মানুষকে সাহায্য করা উচিত তাঁর জন্য সঠিক পরিবর্তনের পদ্ধতি খুঁজে বার করা।  

কর্মপ্রক্রিয়াঃ এই পর্যায়ে ব্যক্তিটির চিকিৎসা শুরু হয়। তাঁরা নতুন নতুন ব্যবহারের সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, যদিও তাঁদের থিতু হতে সময় লাগে। এই ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি নিজেকে বদলানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপটি নিয়ে থাকেন, যেখানে তাঁকে নানা পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। এইগুলি করার জন্য তাঁদের অন্যদের কাছ থেকে সাহায্যের প্রয়োজন হয় এবং স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে গিয়ে, তাঁদের নতুন নতুন কৌশল শিখতে হয়। এই সময় একজন চিকিৎসক বা ব্যক্তির পরিবারের সদস্যকে সেই ব্যক্তির অনুভূতিগুলিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাঁদের সেই ব্যক্তিকে পুরোপুরি ভাবে সেরে উঠতে আরও উৎসাহিত করতে হবে।

দেখাশুনাঃ এই পর্যায়ে একজন ব্যাক্তি পৌঁছতে পারলে বুঝতে হবে যে তাঁরা নিজেদের নতুন আচরণের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছেন এবং খেয়াল রাখতে হবে যে তাঁরা যেন তাঁদের পুরনো অভ্যাস আবার নতুন করে শুরু না করে বসে। সংক্ষিপ্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ব্যক্তির নতুন আচার আচরণের মুল্যায়ন করা যেতে পারে এবং তাঁর ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করা যেতে পারে। যতই তাঁরা চেষ্টা করুক না কেন নেশা থেকে দূরে থাকার, প্রেরণার অভাবে আবার নেশা করার সম্ভাবনা একটু হলেও থেকে যায়।

পুনরায় নেশা করাঃ এই পর্যায়ে ব্যক্তির মধ্যে উপসর্গগুলি আবার আবির্ভাব হয়। পরিবারের সদস্যদের সেই মুহূর্তে বিকল্প কোনও পরিকল্পনা ভাবা উচিত। চিকিৎসক আবার তাঁদেরকে সেই পরিবর্তন পদ্ধতির মধ্যে প্রবেশ করাতে চেষ্টা করবেন। তাঁদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করেন আবার নেশা করা শুরু করলে কি কি ক্ষতি হতে পারে।

গবেষণার মধ্যে দিয়ে খুঁজে পাওয়া গেছে যে যদি নেশা মুক্তির পদ্ধতির মধ্যে কোনও প্রিয়জন (স্বামী, স্ত্রী, বা পরিবারের সদস্য) নেশাগ্রস্থ ব্যক্তির পাশে থাকেন, তা হলে তার ফল ভাল হয়। তাঁরা মানুষটির মধ্যেকার সমস্ত ভাল দিকগুলি বার করে আনার চেষ্টা করেন যাতে তাঁকে আর নেশার কোনও দ্রব্য ব্যবহার না করতে হয়। তাঁরা মানুষটিকে নিজের ভালর দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন তাঁদের সমস্যাগুলির সমাধান করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিজেকে বদলাবার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।

একটি মজবুত সম্পর্কের প্রয়োজন খুবই বেশি, কিন্তু শুধু সেই ব্যক্তির অনুপ্রেরণা যথেষ্ট নয়। যে তাঁর পাশে থাকবেন, তাঁকে তাঁর নেশামুক্ত জীবনকে সমর্থন করতে হবে এবং সেই ব্যক্তিও যেন তাঁকে সমর্থন করেন।

সুত্রঃ

ডাঃ গরিমা শ্রীবাস্তব দিল্লীতে কর্মরত একজন ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট। তাঁর অল ইন্ডিয়া ইন্সিটিউট অফ মেডিক্যাল সাইন্স থেকে একটি পিএইচডি রয়েছে।

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org