আপনি কি ওই ভঙ্গুর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়েটিকে সাহায্য করতে পারবেন?

আপনি কি ওই ভঙ্গুর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়েটিকে সাহায্য করতে পারবেন?

পেশাদার মডেল জেনির বয়স ২৫-এর কাছাকাছি। হাসপাতালের বহিরাগত বিভাগের করিডোর দিয়ে ও দুলকি চালে হেঁটে যেত, হাসপাতালের কর্মীদের সাথে হেসে কথা বলতে বলতে, সুরেলা কন্ঠে সবাইকে “গুড মর্নিং” জানিয়ে, চারিপাশে উল্লাস ছড়িয়ে।

বাইরের এই হাসিখুশি স্বভাব আর আনন্দমুখর ভাব আসলে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিভ্রান্ত এবং আহত ছোট মেয়েটিকে সুরক্ষিত রাখার একটি পন্থা ছিল। ওর ছোটবেলা ছিল মর্মান্তিক, যখন ওর উপরে অকথ্য ভয়াবহতা চাপিয়ে দিয়েছিল তারই পরিচিত ব্যক্তিরা যাদের মধ্যে তার পরিবারের সদস্যরাও ছিল। বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও স্কুলের অধ্যায় ছিল বিভীষিকার মতো। ১৫ বছর বয়সে ও বুঝতে পারে যে ও বোকা না, বরং ডিস্লেক্সিক, এবং লার্নিং ডিসএবিলিটির পরীক্ষা নিজেই করায় কারণ ওর মনে হয়েছিল যে অন্য কেউ ওর কথা ভাবে না।

কিশোরী বয়স থেকেই ওর একের পর এক অনেক বয়ফ্রেন্ড ছিল, প্রত্যেকটা নির্যাতিত সম্পর্কের পরেই আরেকটা নির্যাতিত সম্পর্ক শুরু হত, অথচ ও অনেক আশা, ভরসা আর বিশ্বাস নিয়েই সবকটায় পা রেখেছিলো। ও শুধু “চেয়েছিল এমন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে যে ওকে সত্যিকারের ভালবাসবে”, যেভাবে ও নিজেকে প্রত্যেকটা সম্পর্কের মধ্যে ঢেলে দিতো।

ও অন্যদের সাদা বা কালো রূপে দেখত, যারা ওর চোখে “আদর্শ”, অনেক সময় এমন ছেলেদের বেছে নিত যাদের ব্যবহার মুগ্ধ করার মতো কিন্তু বাজারে প্রচুর বদনাম ছিল। শুভ্রতা চটজলদি অন্ধকারে পরিণত হত যখন ও ছেলেটির উপর নিজের অধিকার দেখাতে শুরু করত বা গায়ে পড়া হয়ে যেত। ছেলেটি ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করত, ওর ফোন এবং মেসেজের জবাব দিতো না। এতে ও রাগে ফেটে পড়ত এবং হাতের কাছে যা থাকত, যেমন মোবাইল ফোন, কফি মগ, বই বা অন্য কিছু মাটিতে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলত। তারপর সে ছেলেটিকে অসংখ্য মেসেজ পাঠাতো জানতে চেয়ে যে ও কি অন্য কোন মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে? প্রত্যেকটা সম্পর্কে এমন অনেকবার হয়েছে। এর কিছুদিন পরে ওরা আবার একসাথে হয়ে যেত।

ও কখনই কোন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবতে পারেনি কারণ ওর সব থেকে বড় ভয় ছিল যে কেউ ওকে ছেড়ে চলে যাবে আর ও একা হয়ে যাবে। কিন্তু কোন সম্পর্কই টিকে থাকেনি বেশীদিন। প্রত্যেকবার প্রচণ্ড ঝগড়ার একটি অধ্যায়ের পর ছেলেগুলো সম্পর্ক ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে, আর ও দুর্বল হয়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।

“কষ্টকে অবশ করে রাখার জন্য” রাস্তায় পাওয়া যাওয়া এমন সব ধরণের মাদক দ্রব্য ও ব্যবহার করেছিল যা ওর বন্ধুরা ওকে জোগাড় করে দিতো। ওর মায়ের প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ অতিরিক্ত মাত্রায় খেয়েছিল মারা যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে, এবং এর জন্য ওকে দুবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল পেট ওয়াশ করে ওষুধ বার করার জন্য।

একদিন ভাবনাচিন্তা করে বলেছিল যে ও শুধু সেই মুহূর্তগুলোতেই আনন্দ অনুভব করেছিল যখন ও বন্ধুদের সাথে মজা করত, যাতে বেশীরভাগ সময়ই মদ আর গাঁজা থাকত। ও একা থাকাটা সহ্য করতে পারত না। নিজের ঘরে রাতে যখন একা থাকত, ওর মনে হত যেন ওর কোন অস্তিত্ব নেই, শুধু তখনই ওর নিজেকে একজন ব্যক্তি মনে হত যখন ও অন্যদের সাথে মেলামেশা করত। নিজের একাকী কোন সত্তা ছিল না ওর, ও জানত না ও নিজে কে বা কী।

বেশীরভাগ সময় ওর মনে কোন অনুভূতি থাকত না, যার বর্ণনা ও করেছিল “আমার আত্মার শূন্যতা” এই বলে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল গাল দিয়ে যখন ও জানিয়েছিল যে ‘অন্তত কিছু’ অনুভব করার জন্য ও নিজের বাহুতে ব্লেড দিয়ে কেটেছিলঃ শূন্যতার থেকে ব্যথা ভালো মনে হয়েছিল। তাতেই যখন মনে হয়েছিল যে কিছু অনুভব করতে পারছে না তখন খুব ভেঙে পড়েছিল আর সারা রাত ধরে কেঁদেছিল। সেই অন্ধকার কোন এক ক্ষণে নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা কষ্ট আর দুঃখের হদিস পেয়েছিল সে। ভোর ফুটে ওঠার সাথেই ও মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে পড়েছিল যে ও অবসাদে ভুগছিল এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে ওষুধ লিখিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় ওর মনের অবসাদ প্রতক্ষ্য ছিল। এক দফার অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ শুরু করা হয়। কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছিল যে শুধু “ডিপ্রেসিভ এপিসোডে” ওর সমস্যার পূর্ণ ব্যাখ্যা সম্ভব না। ওষুধের প্রভাব শুরু হওয়া অবধি আমি সপ্তাহে একবার করে ওর সাথে দেখা করতে থাকি, এবং তারপরে ওকে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলগিস্টের কাছে রেফার করি সাইকোথেরাপির জন্য। এর পাশাপাশি আমি প্রত্যেক মাসে ওর সাথে একবার দেখা করি ওষুধের প্রভাব যাচাই করার জন্য।

ধারণার থেকে অনেক বেশী সংখ্যায় রয়েছে এই ধরণের ব্যক্তিত্বের মানুষ। মেয়েদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশী ছেলেদের তুলনায়। এমন অনেক মেয়েদের, যাদের অন্য মেয়েরা হয়তো ড্রামা কুইন (অতিনাটকীয় স্বভাবের) বা আরও খারাপ কিছু বলে থাকে, তাদের আসলে প্রয়োজন একজন অভিজ্ঞ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের যে এমন মানসিক সমস্যার চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের সাহায্য করতে পারবে তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিভ্রান্তিকর এবং ভয়াবহ অনুভূতিগুলোকে বুঝতে যা এই ধরণের ভঙ্গুর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের মধ্যে থাকাটাই স্বাভাবিক।

এই  প্রবন্ধের ক্রমে ডাঃ শ্যামলা বৎসা দেখাতে চেয়েছেন যে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের আচরণের পরিবর্তনের আড়ালে লুকিয়ে থাকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা। কীভাবে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সাধারণ আচার-আচরণের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার পূর্ব লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় তা এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এই ধরনের রচনায় কমবয়সী ছেলেমেয়েরা, যারা অহেতুকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা ভোগ করেছে, তাদের জীবনকাহিনী তুলে ধরে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে যখন একজন মানুষের আচরণের মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে তখন সেই ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে  বিচার করা জরুরি। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য বা পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

ডাঃ শ্যামলা বৎসা ব্যাঙ্গালোরের একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, যিনি কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের চিকিৎসা করছেন। যদি কোনও পাঠকের কোনও মন্তব্য বা প্রশ্ন থাকে তাহলে এই ঠিকানায় তিনি তাঁর মতামত লিখে জানাতে পারেন। ঠিকানাটি হল columns@whiteswanfoundation.org        

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org