গাঁজা ব্যবহার ও সাইকোসিসের মধ্যে যোগসূত্র

গাঁজা ব্যবহার ও সাইকোসিসের মধ্যে যোগসূত্র

রাঘব ২৪ বছর বয়সী একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে সে তার বন্ধুর সঙ্গে আমার কাছে আলাপ আলোচনা করার জন্য আসে। রাঘবের বন্ধুরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে এবং এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা একই বাড়িতে সবাই মিলে থাকত। তারা একে অপরকে খুব ভালোভাবে চিনত ও একটা পরিবারের মতো বসবাস করত।

রাঘব কিছুদিন ধরেই বন্ধুদের দোষারোপ করা শুরু করেছিল এই বলে যে তারা নাকি রাঘবের অনুপস্থিতিতে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। রাঘব তার বন্ধুদের বলেছিল যে সে তাদের আর বিশ্বাস করে না। সাধারণত রাঘব মাঝে মাঝে নেশা করলেও গত এক সপ্তাহ ধরে সে প্রচুর পরিমাণে গাঁজা ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। এর মধ্যে দিয়ে রাঘব এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করতে শুরু করেছিল। যেহেতু রাঘবের বন্ধুরা মাঝে মাঝে ধূমপানের মাধ্যমে গাঁজার নেশা করত তাই তারা বুঝতে পেরেছিল যে রাঘব যা করছে তা মোটেই ঠিক করছে না। বন্ধুদের অবিশ্বাস করার মতো নতুন আচার-আচরণ করা ছাড়াও রাঘব খাওয়াদাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। সে কথাবার্তাও প্রায় বলত না। যদি কেউ তাকে খাওয়া বা বাইরে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করত তাহলে সে প্রচন্ড রেগে যেত। কেউ কিছু বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে জোরাজুরি করতে ভয় পেত কারণ রাঘব শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী ছিল এবং খুব সহজেই অন্যের প্রতি সে মারমুখী হয়ে উঠত।

২৩ বছরের আদিকে যখন আমি ২০০৪ সালে প্রথম দেখি তখন সে বাণিজ্য বিষয়ে স্নাতক হয়েছিল। তারপর এক বছর ধরে সে তার বাবার ফার্মে অ্যাকাউন্টস বিভাগে কাজ করছিল। আদি ছিল খুব শান্তশিষ্ট, ভদ্র, পড়ুয়া ছেলে। তাই তাকে নিয়ে তার বাবা-মায়ের কোনও সমস্যাই ছিল না।

কিন্তু সম্প্রতি এই পরিস্থিতির বদল ঘটেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আদি নিজের মধ্যে নিজেকে আটকে রেখেছিল, মাঝে মাঝে দূরে কাউকে দেখে হাসত বা অদৃশ্য কোনও মানুষের সঙ্গে বিড়বিড় করে কী যেন বলত। শুরুতে তাকে দেখে মনে হত যে সে যেন মজা করছে। তাই তার পরিবার প্রথম দিকে এই ঘটনাকে গুরুত্বই দেয়নি। কিন্তু ক্রমশ আদি এমন আচরণেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল এবং তা প্রায় ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। এর ফলে আদি কাজকর্ম ঠিকভাবে করতে পারছিল না। বিশেষ করে রাতে একেবারেই ঘুমাচ্ছিল না। আগে যেখানে আদি সিগারেট প্রায় খেতই না, সেখানে সে প্রতিদিন নিয়ম করে দশটার বেশি সিগারেট খাওয়া ধরেছিল। একদিন তার মা তাকে মারধরও করে। আদির এই আচরণের পরিবর্তন কয়েক মাস আগে গাঁজা ব্যবহারের পরেই দেখা দিতে শুরু করে জেনে তার মা ভীষণ রেগে গিয়েছিল। আদির হাতখরচের জন্য টাকা কমিয়ে দেওয়া হয় এবং এই নিয়মটা অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনে চলা শুরু হয়।

এরপরেও অবশ্য আদির আচরণে তেমন উন্নতি হয়নি। সে কারণেই আদিকে আমার কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল।

অনেক মানুষের কাছে মাদক বা তামাক জাতীয় বস্তু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে  ব্যবহৃত হয়। বহু দেশে এর ব্যবহার আইনসিদ্ধ এবং একটা বড় সংখ্যক মানুষ গাঁজা ব্যবহার করে। যদিও গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগের ক্ষেত্রে গাঁজা সেবনের ফলাফল বিপরীতমুখী। অধিকাংশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কয়েকটি বিষয়ে একমত, যেমন-

  • স্কিৎজোফ্রেনিয়াপ্রবণ মানুষের ক্ষেত্রে গাঁজা জাতীয় বস্তু ব্যবহার বিপজ্জনক। অর্থাৎ, কারোর আত্মীয়স্বজনের যদি এই রোগ থাকে তাহলে সেই ব্যক্তির মধ্যেও এই মানসিক অসুখ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

  • কোনও একলা জিন স্কিৎজোফ্রনিয়াকে বংশানুক্রমিক করে তুলতে পারে না। অনেকগুলো অপ্রকাশিত জিন এর জন্য দায়ী থাকে। এগুলোকেই ঝুঁকিপূর্ণ জিন বলা হয় এবং স্কিৎজোফ্রেনিয়াপ্রবণ মানুষের ক্ষেত্রে এই জিনগুলোই গাঁজা দ্বারা প্রভাবিত হয়।

  • একবার যদি স্কিৎজোফ্রেনিয়ার বিকাশ ঘটে তাহলে তা অপরিবর্তনীয় হয়।

রাঘব এবং আদি দুজনের পরিবারেই স্কিৎজোফ্রেনিয়ার ইতিহাস রয়েছে। রাঘবের কাকার বহু বছর ধরে এই রোগের চিকিৎসা চলছে। আবার আদির মামার মধ্যে  স্কিৎজোফ্রেনিয়ার এমন লক্ষণ রয়েছে, যার ফলে তার চেতনা, আবেগ ও সামাজিক ক্ষেত্র খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৮ সালে অন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আদির বোনের মধ্যেও এই রোগ চিহ্নিত করেছেন। এদের দু'জনের পারিবারিক ইতিহাস তাদের স্কিৎজোফ্রেনিয়াপ্রবণ করে তুলেছে, যা তামাক ব্যবহারের দ্বারা আরও গুরুতর আকার নিয়েছে। স্কিৎজোফ্রেনিয়াপ্রবণ মানুষের মস্তিষ্কে তামাকের প্রতিক্রিয়া আপাতভাবে এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-একরকম হয়।

রাঘবের সাইকোটিক লক্ষণগুলো সাইকোটিক বিরোধী ওষুধের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল। কিন্তু গাঁজার ব্যবহার ছাড়তে সে রাজি হয়নি। শেষবার আমার কাছ থেকে যাওয়ার সময়ে সে আমায় আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে সে গাঁজার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে।

অন্যদিকে, ছয়-সাত বছর ধরে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে আদির অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছিল। এমনকী, সে প্রতিদিন কাজেও যাচ্ছিল। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে আদির কর্মক্ষমতার মাত্রা আগের থেকে ২৫-৩০ শতাংশ হারে কমে গিয়েছিল। বিগত পাঁচ-ছয় বছরে আদি তিনবার মনোবিকারগ্রস্ত বা সাইকোটিক সমস্যায়  আক্রান্ত হয়। প্রতিবারই কিছুদিনের জন্য সে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিলে তার অবস্থার অবনতি হয়। এখন সে মনোরোগ সংক্রান্ত নানা সুযোগসুবিধার মধ্যেই রয়েছে। সহজ কথাবার্তা ছাড়া অন্য আর কিছুতে সে এখন সক্ষম নয়। অসুস্থতার জন্য তার বুদ্ধিও ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।

প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আদি কখনও গাঁজার প্রতি আসক্ত হয়নি। যদিও তার ক্ষেত্রে যা হওয়ার ছিল তা-ই হয়েছিল। তার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জিনের প্রভাব বেশি মাত্রায় কাজ করে এবং যতক্ষণ না সেগুলো পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় হচ্ছে ততক্ষণ ওই জিনের কুপ্রভাব কমার সম্ভাবনা ছিল না।

অন্য যে কোনও কাজের মতো গাঁজা সেবনে মানুষ একেবারে মশগুল হয়ে যেতে পারে। যখন কেউ প্রথমবার কোনও বিনোদনমূলক যানবাহনে ওঠে তখন কে ভাবে যে ওই যান গড়াতে গড়াতে পরে খারাপ হয়ে যেতে পারে? অনেক মানুষ একসঙ্গে মিলে এসব যানগুলোতে শুধু মজা করার জন্য ওঠে। এসব যানবাহনে যারা উঠছে যদি তাদের শরীরের পিছনের অংশ দুর্বল হয় তাহলে তাদের কোমরে আঘাত লাগার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কেউ যদি এসব উত্তেজনাময় যানবাহনে নাও ওঠে তাহলেও তাদের অন্য কারণে কোমরে আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতেই পারে। কারণ কোন মানুষ কী ধরনের আঘাতে আহত হবে তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। সেই সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষে এর পার্থক্যও ঘটে। আবার যতক্ষণ না একটা অঘটন ঘটছে ততক্ষণ একজন মানুষের পক্ষে তার শরীরের পিছনের অংশ যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল তা জানা নাও হতে পারে।

ঠিক সেইমতো জিনগতভাবে স্কিৎজোফ্রেনিয়াপ্রবণ মানুষের গাঁজা ব্যবহারের বিষয়টা প্রাসঙ্গিক। গাঁজা ব্যবহার ও স্কিৎজোফ্রেনিয়ার যোগসূত্র নিয়ে গবেষকদের মধ্যে এখনও তর্ক-বিতর্ক চলছে। যেহেতু স্কিৎজোফ্রেনিয়া বিকাশ পাওয়ার প্রবণতা ও গাঁজা ব্যবহারের ঝোঁকের মধ্যে জিনগত প্রভাব অন্যতম একটা বিষয় সেহেতু একইরকম কোনও জিনের মধ্যে এই দুটো বিষয়েরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যেতে পারে। এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

এই জায়গা থেকে বিচার-বিবেচনা করে একজন ডাক্তার কারোর পরিবারে যদি স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকে তাহলে তাকে গাঁজা ব্যবহারের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। যদিও পারিবারিক ইতিহাস না থাকলেও গাঁজার ব্যবহার যে সাইকোসিস বা মনোবিকারের জন্ম দেয় না, সেকথা নিশ্চিত করে কখনোই বলা যায় না।

এই প্রবন্ধে বেঙ্গালুরু নিবাসী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ শ্যামলা বৎসা অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের আচার আচরণের পরিবর্তনের আড়ালে যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা লুকিয়ে থাকে তা দেখাতে চেয়েছেন। কীভাবে মানসিক অব্যবস্থার পূর্ব লক্ষণগুলো কমবয়সি ছেলে-মেয়েদের আচরণের মধ্যে প্রকাশ পায়, তা এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক। কয়েকজন অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ের জীবনকাহিনির মধ্যে দিয়ে কীভাবে তারা অপ্রয়োজনীয়ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তা বর্ণনা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। সেই সঙ্গে যখন কারোর আচরণ স্বাভাবিক সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে তখন তার বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের যে সেই বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন সে কথাও এই লেখায় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এবং সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়াও যে কত জরুরি বিষয়, তাও জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন লেখক।

এই বিষয়ে যদি কারোর কোনও মন্তব্য বা কিছু প্রশ্ন থাকে তাহলে এই ওয়েবসাইটে নিজেদের মতামত লিখতে পারেন। ওয়েবসাইটের ঠিকানা হল- columns@whiteswanfoundation.org   

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org