সন্তানদের মানসিক অসুস্থতায় বাবা-মায়ের দিশাহারা অবস্থা
Santanu

সন্তানদের মানসিক অসুস্থতায় বাবা-মায়ের দিশাহারা অবস্থা

একটি বাচ্চার মা-বাবা তাঁদের নিজেদের, সঙ্গীদের, অভিভাবকদের বা ভাই-বোনদের অসুখবিসুখে বড় একটা ভেঙে পড়ে না। কিন্তু নিজেদের সন্তানদের অসুস্থতায় বা অক্ষমতায় বাবা-মায়েরা একেবারে পাগলের মতো হয়ে যায়

একটি বাচ্চার মা-বাবা তাঁদের নিজেদের, সঙ্গীদের, অভিভাবকদের বা ভাই-বোনদের অসুখবিসুখে বড় একটা ভেঙে পড়ে না। কিন্তু নিজেদের সন্তানদের অসুস্থতায় বা অক্ষমতায় বাবা-মায়েরা একেবারে পাগলের মতো হয়ে যায়। আর রোগ যদি বাচ্চার মনে বাসা বাঁধে তাহলে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। এর ফলে জটিলতা ক্রমশ বেড়ে যায়। কিন্তু এমন পরিস্থিতি গড়ে ওঠার সত্যিই কোনও প্রয়োজন নেই। আমি আমার লেখার মধ্য দিয়ে এই বিষয়টি পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব। যখন একজন বাবা বা মা তাঁর সন্তানের মানসিক সমস্যার কথা প্রথম জানতে পারেন তখন বাবা-মায়ের মধ্যে ঠিক কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়? আমার ধারণা এই কথা শোনার পরে বাবা-মায়েরা তাঁদের আবেগকে চেপে রাখতে পারে না। মনের ভয়, উদ্বেগ, লজ্জা, হতাশা, সন্দেহ, অবিশ্বাস, যন্ত্রণা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বাবা-মায়েদের এইসময়ে একটা চিন্তাই ঘুরেফিরে মনে আসে যে, এরপর কী হবে? লোকে কী বলবে, ভাববে। মনের মধ্যে এইসময়ে একপ্রকার অপরাধবোধ দেখা দেয়। মনে প্রশ্ন জাগে- আমার বা আমার বাচ্চার ক্ষেত্রেই বা কেন এমন হল? কীভাবে আমরা এই অপরাধবোধের হাত থেকে মুক্ত হতে পারব? বাবা-মা হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে না পারা, জিনগত সমস্যা, কোনও ভুল কাজের মাশুল গোনা, বাচ্চার জন্য সুস্থ পরিবেশ গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতা থেকে এই পরিস্থিতিতে সন্তানের অভিভাবকদের মনে অপরাধবোধের জন্ম হয়।

মনের আবেগকেই মানুষ এইসময়ে সাধারণভাবে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমরা কখনোই ভেবে দেখি না যে, আমাদের ভাবনা এবং বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য থাকতেই পারে। আমরা একবারও ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করি না যে, এই কঠিন বাস্তবের সঙ্গে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব।

নিজের ছেলে বা মেয়ের মানসিক সমস্যার কথা শুনে, জেনে আমরা প্রায়শই সব কিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি। আমাদের মনে চিন্তা, আশঙ্কার মেঘ জমতে থাকে। আর বাবা-মায়েদের এই মানসিকতা বা মনোভাব তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। মনে এইসময়ে নানা ধরনের জিজ্ঞাসার জন্ম হয়। আমার বাচ্চা জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে তো? বা আমার সন্তানের জীবনটা কেমন হবে? অথবা বাবা-মা হিসেবে নিজেদের ভবিষ্যৎটাই বা কী হবে? স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কি একসঙ্গে থাকা সম্ভব? কারণ বাচ্চাদের কোনও মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক সমস্যা হলে বাবা-মায়েরা একে অপরকে নিজেদের জিনগত ত্রুটি সম্পর্কে দোষারোপ করে। এই ধরনের অযৌক্তিক আচরণ, অদ্ভুত বিশ্বাস অনেক শিক্ষিত এবং প্রগতিশীল মানুষের মধ্যেও প্রায়শই দেখা যায়।

আসলে বাস্তব বা পরিস্থিতিকে স্বীকার না করার মানসিকতা এইসময়ে বাবা-মায়েদের মধ্যে খুব বেশি করে দেখা দেয়। বাচ্চার রোগ নির্ধারণের বিষয়টি বোঝা, দ্বিতীয় কোনও পন্থা নেওয়া যায় কিনা ভেবে দেখা, অসুখ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও চেষ্টাই এইসময়ে বাবা-মায়েরা করেন না। কিন্তু এইসময়ে আমাদের দরকার অনেক পড়াশোনা করা, জানা, শেখা, সমস্যার স্বরূপ বোঝা, কীভাবে তার থেকে বেরনো যায় তা ভাবনাচিন্তা করা এবং গোটা বিষয়টা বাচ্চার সামনে তুলে ধরা। পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে বিষয়টি কীভাবে উত্থাপন করা যায় এবং বাচ্চাকে সুস্থ করে তুলতে কীভাবে সবার সাহায্য পাওয়া যায়, সে বিষয়টাও বাবা-মায়েদের মাথায় রাখা জরুরি। আসলে সমস্যার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পারিপার্শ্বিকের সহায়তা কীভাবে গ্রহণ করা সম্ভব, সেদিকে নজর দেওয়া খুবই প্রয়োজন।

এইসব কিছুর সঙ্গে আর একটি বিষয়কেও আমাদের সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। নিজেদের বোঝাতে হবে যে, বাচ্চার অসুখ বাবা-মায়েদের বা বাচ্চার নিজের দোষে হয়নি। বাস্তবকে মেনে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেই বিখ্যাত প্রবাদটি ভুলে গেলে চলবে না। বাচ্চারা ফুলের মতো সুন্দর। তারা নিজেদের শিকড় চেনে এবং যে কোনও পরিস্থিতিতেই মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু পাশাপাশি একথাও মনে রাখা জরুরি যে, শিশুরা ছোট চারা গাছের মতো। দুর্বল কিন্তু সুন্দর। চারাগাছকে যত্ন করলে যেমন তা একদিন ডালপালা বিস্তার করে, ঠিক একই ভাবে শিশুদের সঠিক লালন-পালন করলে তারাও সুন্দর, সুস্থ হয়ে ওঠে। সঠিক অভিভাবকত্ব এবং সুস্থ পরিবেশ চারাগাছ সম শিশুদের সর্বাঙ্গীন বিকাশে সাহায্য করে। সমাজের চোখে তারা ভালোবাসার পাত্র ও সফল হয়ে উঠতে পারে। তাই বাচ্চাদের বিকাশের জন্য কী করা উচিত বা সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য বাবা-মায়েদের পক্ষে কীভাবে সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব— সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখা জরুরি। এর জন্য বাবা-মায়ের দায়িত্ব বা কর্তব্য হল—

  • বাস্তবকে স্বীকার করা — সন্তানের সমস্যাটিকে যথাযথ বোঝার চেষ্টা করা, তাকে স্বীকার করা এবং অসুখের পিছনে যে বাচ্চাটির কোনও দোষ নেই, তা বিশ্বাস করা।

  • বাচ্চার অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া, নিজেদের মতামত চাপিয়ে না দেওয়া — বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে আর পাঁচজন শিশুর সঙ্গে খেলতে ভালোবাসে, তারা উন্মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নিতে চায়, স্বাধীনতা পছন্দ করে আর বাড়ির মধ্যে শাসনের ঘেরাটোপে থাকতে চায় না। এর মানে এই নয় যে, তারা যা খুশি তাই করবে বা ভুলভাল পরিস্থিতির শিকার হবে। আসলে বাচ্চাদের ব্যক্তিগত পরিসরের ক্ষেত্রে বড়দের সংবেদনশীলতা জরুরি।

  • সন্তানদের সমস্যা মন দিয়ে শুনতে হবে।

  • কোনও শর্ত ছাড়াই তাদের ভালোবাসতে হবে।

  • বাচ্চাদের সঙ্গে যোগাযোগের পথ খোলা রাখতে হবে। পড়াশোনা ছাড়াও তাদের অনুভূতি, ধারণা, নৈতিকতা এমনকী তাদের ব্যর্থতাগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার হলে বাচ্চাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথাও বলতে হতে পারে।

  • প্রকাশ্যে শিশুদের প্রশংসা করতে হবে। ছোটখাটো ভুলের জন্য তাদের শাসন করতে হবে। কিন্তু অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় এবং গোপনীয়তার সঙ্গে তা করা জরুরি। ইতিবাচক মনোভাব সব সময়েই নেতিবাচকের থেকে বেশি কার্যকরী।

  • বাচ্চার গুণগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলি নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রত্যেকেরই স্বকীয়তা রয়েছে এবং সেই অনুযায়ী তাদের দোষ-গুণ বিচার করা দরকার।

  • সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে একজন শিশুর সমাজের সাহায্যের প্রয়োজন। এর মানে এমন সাহায্য নয় যে, প্রেম-ভালোবাসার জন্য একজন বাচ্চা তার নিজের জীবনটাই শেষ করে ফেলল। তার চাই জীবনমুখী শিক্ষা এবং নিজেকে চিনতে শেখা।

  • সবশেষে যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হল, একজন বিশেষজ্ঞের সহায়তা। শুধু সন্তানের নয়। এই সাহায্য তার বাবা-মায়েরও একান্ত প্রয়োজন।

আসলে একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য একটি বাচ্চার বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে এই কারণেই জরুরি যে, সন্তানের মানসিক সমস্যাটিকে তার বাবা ও মা মেনে নেবে এবং নিজেদের অনুভূতিগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। সন্তানের ভালোর জন্য মা-বাবারা সবকিছুই করতে সক্ষম হন। বাবা-মায়েদের নিজেদের যত্নের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে ও সন্তানের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালনে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাবা-মায়েদের মনে নিজেদের অভিভাবকত্বের বিষয়টি যেন ঠাঁই না পায়। বাচ্চার অসুস্থতা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়। মানুষ হিসেবে সে তার দায়িত্ব পালনে অসফল- এমন ধারণা যাতে বাচ্চার মা-বাবার মনে না জন্মায় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে অহেতুক, অকিঞ্চিৎকর মনের দ্বন্দ্বগুলিকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলাই কাম্য। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই সমস্যা রয়েছে। প্রত্যেককেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে লড়াই করতে হয়। তাই লড়াইয়ের ময়দানে নিজেকে একা ভাবার কোনও কারণ নেই। জীবন থেকে ধ্বংসাত্মক মনোভাব দূর করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কাল কী ঘটতে চলেছে, তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকে না। এসব ছাড়াও বাবা-মা হিসেবে একজন মানুষের উচিত তার পরিবারের অন্যান্য বাচ্চাদেরকেও সাহায্য করা। এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার জন্য একটি বাচ্চার মা-বাবার একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া একান্ত জরুরি।

মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত একজন কাউন্সেলার যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিকভাবে ছাপানো হবে।

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org