আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, অসুস্থ বা অক্ষম মানুষের পরিচর্যার কাজটি কঠিন, কিন্তু সম্মানজনক। একজন পরিচর্যাকারীর জীবনের সব ক্ষেত্রেই তাঁর কাজের প্রভাব পড়ে। অনেক পরিচর্যাকারীদের সঙ্গেই আমাদের কাজ করতে হয়। তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানতে পেরেছি, নিজেদের পরিবার প্রতিপালন করতে গিয়ে তাঁদের উপর অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা এসে পড়ে। এই বাধা অতিক্রম করা একজন পরিচর্যাকারীর পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়। পরিচর্যার পেশায় যাঁরা নিযুক্ত হন তাঁরা সারা জীবন ধরে সাংঘাতিক অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করেন। পরিচর্যাকারীদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল হয়, তার সঙ্গে পরিচর্যাকারীর কম পারিশ্রমিক আরও সমস্যার সৃষ্টি করে। ক্যারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালে করা একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, সমগ্র ভারতে আমাদের প্রকল্পের সাথে যুক্ত পরিবারগুলির মধ্যে ৯৩ শতাংশ পরিবারের কেউ না কেউ পরিচর্যার কাজে যুক্ত রয়েছেন এবং এঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। আজকের দিনে এই সংখ্যাটা খুবই হতাশাজনক। তাই এই সমস্যার প্রধান অন্তরায়টিকে আমাদের খুঁজে বের করে তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
পরিচর্যার কাজে মানসিক চাপ ও উদ্বেগের সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থের অভাব। অনেক সময়ে দেখা যায় যে মানুষটিকে পরিচর্যা করা হচ্ছে সে তার চাকরিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। ফলে ওই পরিবারটি স্বভাবতই অর্থ সংকটের মধ্যে পড়ল। এছাড়া একজন পরিচর্যাকারী, যিনি অসুস্থ ব্যক্তির স্বামী বা পরিবারের মহিলা সদস্য হতে পারেন, তিনি কাছের মানুষের দেখভাল করার জন্য কোনও কাজে যুক্ত হতে পারেন না। এভাবে একটি পরিবার দু'দিক থেকেই রোজগারের পথ হারিয়ে ফেলে। আর তার ফলে পরিবারের উপর নেমে আসে চরম অর্থ সংকট। এই পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে, যখন রুগির চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায়। এভাবে একটি পরিবার চারদিক থেকে লড়াই করতে করতে একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এই ধরনের আর্থিক বিপর্যয় একজন পরিচর্যাকারীর কাজের দক্ষতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তার জীবনে হাজার বাধা উপস্থিত হয়।
ভারত সরকার এরকম বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করার জন্য অনেক পরিকল্পনা নিয়েছে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী অক্ষম ব্যক্তিদের পেনশন প্রদান এবং জাতীয় সুরক্ষা পরিকল্পনা। এই ব্যবস্থার দ্বারা অক্ষম মানুষের চিকিৎসা ও থেরাপির ব্যয়ভার বহন করা হয়। কিন্তু এই পরিকল্পনা অসুস্থ ব্যক্তির পরিবারের উপর প্রভাব ফেলে না বা তার আত্মীয়স্বজন বা কাছের মানুষ যে পরিচর্যাকারী হিসেবে কাজ করছে তাকে আর্থিক সহায়তাও দিতে পারে না।
ক্যারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড তাদের সমীক্ষার মাধ্যমে এমন পরিচর্যাকারীদের চিহ্নিত করেছে, যারা অর্থনৈতিক সাহায্য পেলে আরও ভালো করে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে। এদের সঙ্গে আমরাও যুক্ত হয়ে কাজ করছি। এক-একজন পরিচর্যাকারীর ব্যক্তিগত আগ্রহ, দক্ষতা এবং তার পরিবারের চাহিদার কথা মাথায় রেখে পরিচর্যাকারী ও তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য, ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা এবং ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে পরিচর্যাকারীকে বেঁচে থাকার রসদ জোগানো হচ্ছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিও এই কাজে সহায়তা করছে। পরিচর্যাকারীদের আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য এরকম নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি পরিচর্যাকারীদের কাজের গুণগুত মান ও দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টিকেও জোর দেওয়া হচ্ছে। পরিচর্যার কাজে বিকল্প ব্যবস্থাগুলিকেও গুরুত্ব সহকারে বিচার করা হচ্ছে। যেমন - পরিচর্যার কাজে পরিবারের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, প্রতিবেশি বা কমিউনিটি সেন্টারগুলিকে ব্যবহার করার জন্য ক্যারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড উদ্যোগ নিয়েছে।
গত বছরে নেওয়া এই উদ্যোগের ফলে প্রায় ৯০০জন পরিচর্যাকারী তাদের কাজের জন্য পারিশ্রমিক পায় এবং তাদের পরিবারের দারিদ্রও ঘোচে। পরিচর্যাকারীদের আর্থিক সংকট মিটে যাওয়ার ফলে তারা নতুন উদ্যমে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতেও তারা সক্ষম হয়।
নির্মলা এবং তার পরিবারের উদাহরণই এই পরিকল্পনার সাফল্যের প্রমাণ। নির্মলা একজন বিধবা মহিলা। স্বামীর মৃত্যুর পর চার ছেলে-মেয়ের দেখভালের দায়িত্ব তার উপরেই এসে পড়ে। তার বড় মেয়ে বিদ্যা আবার সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। নিজের পরিবারকে দেখাশোনা করার জন্য সে কোনও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশিদের সাহায্য পেত না। ফলে তার পক্ষে বাইরে কাজ করতে বেরনো সম্ভব হত না। এভাবে পরিবারটি একেবারে দারিদ্র্যে ডুবে যাচ্ছিল। নির্মলা অন্ধ্রপ্রদেশে আমাদের সহযোগী সংস্থার দ্বারস্থ হয় এবং ক্যারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের উদ্যোগে গঠিত পরিচর্যাকারীদের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয়। দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সে দর্জির কাজ শুরু করে। এরপর নির্মলা স্থানীয় পরিচর্যাকারীদের দলে যোগ দেয় ও দলগত সঞ্চয় প্রকল্পের আওতায় নিজের নাম নথিভুক্ত করে। এর ফলে তার ভবিষ্যৎ এবং পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়। নির্মলা থেরাপির কাজ শুরু করে এবং স্থানীয় স্কুলে যোগদান করে। এভাবে কাজ শিখে সে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। এখন নির্মলা কাজের জন্য অনেক সময় পায় এবং তার রোজগারেই পরিবারের মানুষজন জীবন ধারণ করে।
এভাবে সঠিক এবং বাস্তবসম্মত সহায়তা দানের মাধ্যমে নির্মলার মতো আরও বহু পরিচর্যাকারী জীবনধারণের রসদ পেতে পারে, পরিবারের আর্থিক ভিতকে শক্তিশালী করে অসুস্থ মানুষের সেবা করতে পারে এবং সমস্ত প্রতিকূলতাকে দূর করে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
(গোপনীয়তা রক্ষার জন্য পরিচর্যাকারীর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)
ডাঃ অনিল পাটিল কেয়ারারস ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্যনিবাহী অধিকর্তা। এই সংস্থা মনোরোগীর পরিচর্যাকারী, যারা বিনামূল্যে সেবা করেন, তাদের সাহায্য করে থাকে। ২০১২ সালে ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই কাজ করে। ডাঃ পাটিল তাঁর সহকর্মী রুথ পাটিলের সাথে এখানে লিখছেন। আরও জানতে আপনি লগ ইন করতে পারেন www.carersworldwide.org তে অথবা লিখে পাঠান columns@whiteswanfoundation.org ঠিকানায়।