আমাদের রাস্তাঘাটে বা কর্মক্ষেত্রে বা কলেজে, এমনকি পরিবারেও, কিছু অদৃশ্য মানুষ বসবাস করেন যারা নিজেদের শারীরিক সুস্থতা, ভাল থাকা ও জীবিকার কথা না ভেবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিনামূল্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। চিরকালই আড়ালে থেকে যাওয়া এই নায়করা কারা? এরাই তাঁরা, যারা রোগীর যত্ন নেন, যাদের আমরা বলি পরিচর্যাকারী।
পরিচর্যাকারী যে কোনও বয়সের মানুষ হতে পারেন, যিনি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, বা পরিবারের যেকোন প্রকার রোগে আক্রান্ত কারুর যত্ন নেন। কেঁউই মনস্থির কোরে পরিচর্যার কাজে এগিয়ে আসেন না। সময়ের সাথে সাথে বা হঠাৎ করে একদিন তাঁরা যত্ন নেওয়ার কাজে জড়িয়ে পড়েন। এই কাজের জন্য তাঁরা কখনো কোন প্রশিক্ষণ পান না বা কোন আর্থিক উপার্জন করেন না। অথচ, এটিই তাদের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাঁরা সেই সব মানুষের সেবা যত্ন করেন যারা তাদের উপর মানসিক, আরোগ্য কামনায়, সংবেদনশীলতায়, সামাজিক বা অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল। এইরুপ সাহায্য সবসময় সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া যায় না এবং যারা যত্ন নেন তাঁদেরকে আলাদা ভাবে সাহায্য দেওয়ার ব্যাবস্থাও নেই। দুঃখের বিষয় এই হল, যারা চিকিৎসাবিদ্যা বা সমাজের উন্নতির কাজে জড়িত, তাঁরাও কখনো সম্পূর্ণ ভাবে পরিচর্যাকারী স্বীকৃতি দিতে পারেন না। বরং তাদের উপর আরও বেশি ভার চাপিয়ে দেন।
যত্ন নেওয়ার অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি আলাদা মর্যাদা আছে এবং পরিচর্যাকারীরা সাধারনত তাঁদের কাজ নিয়ে গর্বিত হন। তবে অন্যের যত্ন নেওয়ার সাথে সাথে, তাঁদের নিজেদের জীবন অনেক সময় নিশ্চিতরূপে পাল্টে যায়। গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করে দিতে হয় অন্যের জন্য। এর ফলে তাঁদের নিজেদেরকে কখনও কখনও অসুস্থতায়, একাকীত্বে, দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়। এই কারণে পড়াশুনা বা চাকরি অনেক সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায়। এসবের মধ্যেও যারা পড়াশুনা বা চাকরি করেন, তাঁরা নিজদের কাজ ও যত্ন নেওয়ার দায়িত্বের মধ্যে দোটানায় পড়ে যান। এইসব প্রভাবগুলি আমরা ভারতবর্ষে বেশি দেখতে পাই কারণ এখানে বেশিরভাগ যৌথ পরিবার একক পরিবারে পরিণত হয়েছে।
ভারতবর্ষ ও তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে, এমনকি এসিয়া আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই মুহূর্তে পরিবারের অবৈতনিক পরিচর্যাকারীদের সংখ্যা কত তার কোন সঠিক তথ্য নেই। অনুমান করা হয় যে ব্রিটেনে প্রত্যেক আটজনের মধ্যে একজন (প্রায় ৬০ লক্ষ) পরিচর্যাকারী পাওয়া যায়। এই সংখ্যাটি ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ব্যাবহার করলে প্রায় ১৫ কোটি পরিচর্যাকারীর সংখ্যা দেখা যাবে। এই ১৫ কোটি মানুষজনের মধ্যে ছোট থেকে বড় সকলেই আছেন যারা কেউই অর্থ উপার্জন করেন না এবং নিজেদের সুস্থতা, ভালথাকা, ভবিষ্যৎ সবকিছুই অন্যদের প্রতি উৎসর্গ করে দেন।
কর্ণাটকের হসপেটের বিশিষ্ট মানসিক রোগের চিকিৎসক ডাঃ অজয় কুমারের মতে, “যারা অন্যদের সেবা যত্ন করেন, তাঁরা একটি অদৃশ্য সম্প্রদায়, কখনও কখনও নিজেদের কাছেও অদৃশ্য। তাঁদের এই অদৃশ্য হওয়াটাকেই আমাদের প্রথমে বদলাতে হবে”।
তাহলে একবার ভেবে দেখুন, আপনার আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কি আছেন যারা অন্যের সেবা যত্ন করেন? আপনার আশেপাশে নিশ্চয় এমন মানুষ আছেন যারা নিজেদের কথা বলবেন না এবং আপনি এঁদের ওপর দায়িত্বের ভার বুঝতেও পারবেন না। এরা সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে আমাদের চার’পাশে ছড়িয়ে আছে। তাঁরা কেন অচেনা বা অদৃশ্য হয়ে থাকবেন? আশাদেবী নিজের স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত স্বামী গুনেস্বরণের দেখাশুনা করেন। তার বক্তব্য, “প্রত্যেকদিন যদি আপনি আমার একটু খোঁজখবর নেন, তাহলেই আমি ভাল বোধ করি”। এইসব আলচনা এবং রোগী ও পরিচর্যাকারীর একে অপরকে চেনা কাউকে সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপ। এই ছোট পদক্ষেপটি যত্ন প্রদানকারীর জীবনে একটি বিশাল পরিবর্তন আনে। যদি আমরা সময় করে এই প্রথম পদক্ষেপটি নিতে পারি, তাহলে কে জানে এই যাত্রাটি কতভাবে বদলে যেতে পারে।
এই সিরিজের পরবর্তী প্রচ্ছদগুলিতে আমরা পরিচর্যাকারীর উপর বিভিন্ন প্রভাব, যত্ন প্রদানকারীদের বিভিন্ন ধরণ এবং জনতাত্বিক বদলের ফলে তাদের সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
ডাঃ অনিল পাটিল কেয়ারারস ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্যনিবাহী অধিকর্তা। এই সংস্থা মনোরোগীর পরিচর্যাকারী, যাঁরা বিনামূল্যে সেবা করেন, তাঁদের সাহায্য করে থাকে। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই কাজ করে। ডাঃ পাটিল তাঁর সহকর্মী রুথ পাটিলের সাথে এখানে লিখছেন। আরও জানতে আপনি লগ ইন করতে পারেন www.carersworldwide.org তে অথবা লিখে পাঠান columns@whiteswanfoundation.org ঠিকানায়।
এই লেখাটিতে লেখক নিজের ব্যাক্তিগত মতামত প্রকাশ করেছেন এবং তা হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের মতামতের থেকে আলাদা হতে পারে।