এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হল যে, একজন রোগীর দেখাশোনার ভার যাঁদের উপর থাকে, সেই সব পরিচর্যাকারীদের দায়িত্ব কর্তব্য ভাগ করে নিয়ে কীভাবে একটি পরিবার, গোষ্ঠী এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠান তাঁদের পাশে দাঁড়াবে এবং এইসব মানুষগুলিকে তাঁদের গুরুদায়িত্ব পালন করা থেকে কিছু সময়ের জন্য ছুটির সুযোগ করে দেবে।
আমাদের আলোচিত পরিচর্যাকারীরা ভারত, নেপাল এবং বাংলাদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন এবং রাত-দিন এক করে রূঢ় বাস্তবের মোকাবিলা করে চলেছেন। এঁদের জীবনের একমাত্র ব্রত বিনিদ্র রজনী যাপন করে রোগীর সেবা করা। বারেবারেই আমাদের কানে আসে যে, এঁদের জীবনে পরিচর্যার দায়িত্ব থেকে বিশ্রাম নেওয়ার ফুরসতটুকুও নেই, নিজের জন্য একটু সময়ও এঁরা ব্যয় করতে পারেন না। এমনকী রোগীর পরিচর্যার বাইরে অন্য কাজ করার সময়েও এঁদের চিন্তায় কেবল মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি বা সাধারণ রোগীর অসুস্থতার বিষয়টিই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের মাটিতে হওয়া আমাদের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, ৯০ শতাংশ পরিচর্যাকারীর ভাগ্যে পরিচর্যার মতো গুরুদায়িত্ব পালনের পরও খানিক বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ মেলে না।
অত্যন্ত ঘোরতর পরিস্থিতিতেও পরিচর্যাকারীদের কোনও বিকল্পের সন্ধান পাওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে সানতাম্মা (নাম পরিবর্তিত)-র জীবন-সংগ্রাম উল্লেখ্য। এঁর উপরেই ছিল সেরিব্রাল পালসির মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত তাঁর ১২ বছরের ছেলে গঙ্গাপ্পা (নাম পরিবর্তিত)-র দেখাশুনার ভার। কাজ করতে বাইরে বেরনোর সময় এই অসুস্থ ছেলেকে বাড়িতে একা দরজায় তালা-চাবি আটকে রেখে যেতে হত। এই কারণে সানতাম্মা বাইরের কাজে মন দিতে পারতেন না। অসুস্থ ছেলের চিন্তাতেই তাঁর দিন কেটে যেত। বাড়ি ফিরে মা প্রতিদিনই ছেলের করুণ শারীরিক অবস্থা এবং চরম মানসিক বিপন্নতা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই কারণে প্রায় দিনই সানতাম্মার পক্ষে আর বাইরে কাজ করতে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আর এর ফলে মা, ছেলে-সহ গোটা পরিবার আধ পেটা খেয়ে কোনওরকমে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছিল। দুর্ভাগ্য এটাই যে, আমাদের চারপাশে সানতাম্মা বা গঙ্গাপ্পার মতো আরও এমন বহু মানুষ রয়েছেন, যাঁদের জীবনেও নেমে এসেছে এই একই পরিণতি।
এই সমস্যার সমাধানে কেয়ারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড মডেল বিকল্প পরিচর্যার সন্ধান করে তা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। এই পরিকল্পনায় পরিচর্যাকারীদের সঙ্গে সবাই মিলে, অর্থাৎ পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধবের সক্রিয় অংশগ্রহণ একান্ত জরুরি। আর এইভাবেই অসুস্থ মানুষের দেখাশুনার ভার একজনের ঘাড় থেকে অন্য আরও অনেকের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার প্রবণতা গড়ে উঠবে। অনেক ক্ষেত্রে মূল পরিচর্যাকারীকে দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজকর্ম বা বাইরে বেরিয়ে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য রোগীর নিকট আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশিদেরও পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসা জরুরি। এহেন সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে একজন অসুস্থ ব্যক্তি এবং পরিচর্যাকারী উভয়েরই দুর্দশা ও অসুবিধা লাঘব করা সম্ভবপর হবে।
অনেক সময় এইরকম সহযোগিতার থেকে আরও বেশি কিছুর দরকার হতে পারে। সেই কারণে আর একটি অভিনব পন্থার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে একদল মানুষ বা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ একত্রিত হয়ে প্রাথমিক পরিচর্যাকারীর কাজের বোঝা হালকা করতে উদ্যোগী হতে পারে। এই ধারণা থেকে গড়ে উঠেছে 'কমিউনিটি কেয়ারিং সেন্টার'। এই সেন্টার পরিচর্যাকারী ও কমিউনিটির সদস্য উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয়। এর সঙ্গে থাকে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিও। এই ধরণের সেন্টারগুলি লোকালয়ের একদম মধ্যিখানে অবস্থিত হয়ে থাকে। এখানে চিকিৎসার সরঞ্জাম সহ খেলনাপাতি এবং প্রশিক্ষিত কর্মীদের আহ্বান জানানো প্রয়োজন। আর এইভাবেই এহেন সেন্টারগুলি পরিচর্যাকারী ও যাকে পরিচর্যা করা হচ্ছে তাদের দুজনের কাছেই স্বর্গসুখের সমান হয়ে উঠতে পারে। প্রাত্যহিক সামান্য খরচের বিনিময়ে একজন পরিচর্যাকারী তাঁর সন্তান বা অসুস্থ মানুষকে এই সেন্টারের দায়িত্বে রেখে বাইরে কাজ করতে যেতেই পারেন। কারণ এখানে তাদের নিরাপত্তা যে সুনিশ্চিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। এই সেন্টারে থাকলে রোগীরা বাড়ির চার দেওয়ালের বাইরে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ারও সুযোগ পাবে। এখানে নান কার্যকলাপের মাধ্যমে তাদের শারীরিক এবং মানসিক অনেক চাহিদাও মিটতে পারে। এই ধরনের ব্যবস্থায় একদিকে যেমন পরিচর্যাকারীরাও বিশ্রাম নিতে পারে, আবার অন্যদিকে একজন রোগীও সেন্টারে খেলাধূলা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে যথেষ্ট উপকার পেতে পারে। তাই উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি সমান গ্রহণযোগ্য। এছাড়াও এই ব্যবস্থায় পরিচর্যার উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে এলাকার স্থানীয় মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এহেন উদ্যোগের পরিসর স্বল্প। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে একজন মুখ্য পরিচর্যাকারীকে তাঁর কঠিন দায়িত্ব থেকে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি বা বিশ্রামের সুযোগ করে দেওয়াই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। এই ধরনের বিকল্প ব্যবস্থার সাফল্য মূলত জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সমর্থনের উপরই নির্ভরশীল। এই প্রসঙ্গে একজন মায়ের উদাহরণ প্রযোজ্য। যিনি সারাদিন দর্জির কাজ করার পর শান্তি মনে বাড়ি ফিরতে পারতেন। কারণ তাঁর অসুস্থ ছেলের দেখাশুনার ভার নিয়েছিল এমনই একটি কমিউনিটি কেয়ারিং সেন্টার। এই প্রতিষ্ঠান ওই মায়ের কর্মদক্ষতাকেও সম্মান জানিয়েছিল এবং সেই মহিলা তাঁর পৃথক একটি আত্মপরিচয় গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়েছিলেন। আর ছেলের কাছে এহেন আয়োজন শুধু আনন্দেরই ছিল না, এই সেন্টারে সে সন্ধান পেয়েছিল নতুন বন্ধুরও।
ডাঃ অনিল পাটিল কেয়ারারস ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্যনিবাহী অধিকর্তা। এই সংস্থা মনোরোগীর পরিচর্যাকারী, যাঁরা বিনামূল্যে সেবা করেন, তাঁদের সাহায্য করে থাকে। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই কাজ করে। ডাঃ পাটিল তাঁর সহকর্মী রুথ পাটিলের সাথে এখানে লিখছেন। আরো জানতে আপনি লগ ইন করতে পারেন www.carersworldwide.org তে অথবা লিখে পাঠান columns@whiteswanfoundation.org ঠিকানায়।
এই লেখাটিতে লেখক নিজের ব্যাক্তিগত মতামত প্রকাশ করেছেন এবং তা হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের মতামতের থেকে ভিন্ন হতে পারে।