পরিচর্যা

একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ গড়ে তোলা বিষয়ক একটি সাক্ষাৎকার

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে যে ওই অসুস্থ মানুষটির মানসিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব সে বিষয়ে অনেক প্রমাণ আমাদের চারপাশে রয়েছে। তবু একজন মানসিক রুগির পরিচর্যাকারীদের বহুসময়েই এক্ষেত্রে নানারকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কীভাবে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের সঙ্গে কার্যকরী সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় সে বিষয়ে কিছু সুপরামর্শের জন্য হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পূর্ণিমা বি ভি কথা বলেছিলেন নিমহ্যান্সের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার আরতি জগন্নাথনের সঙ্গে

মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের সঙ্গে সুষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন পরিচর্যাকারী সাধারণভাবে কী কী ভুল করে থাকে?

মানসিক রুগির কাছ থেকে একজন পরিচর্যাকারীর প্রত্যাশা খুবই সামান্য থাকে। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের আচার-আচরণ, মেজাজ-মর্জি এবং মানসিকতা সম্পর্কে একজন পরিচর্যাকারীর মনে পরোক্ষভাবে একটা ধারণা গড়ে ওঠে। অধিকাংশ মানুষের পক্ষে যে কাজ করা সম্ভব তা যে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষে করা সহজ হয় না সে নিয়েও পরিচর্যাকারীদের মনে অনেক ধোঁয়াশা, দ্বিধা থাকে। এই মনোভাবের জন্য দায়ী মানসিক অসুখ সম্পর্কে পরিচর্যাকারীদের যথাযথ জ্ঞান ও বোধের অভাব।

কিছু পরিচর্যাকারী থাকে যারা ক্রমাগত একজন মানুষের মানসিক সমস্যাগুলোকে মন থেকে স্বীকার করতে চায় না। আবার অন্য কয়েকজন পরিচর্যাকারী ভাবে যে তাদের নিজস্ব মতামত এবং সমালোচনার দ্বারা একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি উপকৃত হয়। কিন্তু রুগির পরিচর্যাকারীদের এরকম সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি একনাগাড়ে চলতে থাকার ফলে পরিস্থিতির উন্নতির বদলে অবনতি ঘটে এবং রুগির মানসিক সমস্যা দূর হওয়ার পরিবর্তে আবার নতুন করে মাথা চাড়া দেয়। নেতিবাচক অনুভূতির প্রকাশ যে মানুষের মানসিক সমস্যাকে কমানোর বদলে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে তার সপক্ষে অনেক প্রমাণ রয়েছে। একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের উপর নেতিবাচক অনুভূতির প্রকাশ বিপদ ডেকে আনে। পক্ষান্তরে ইতিবাচক অনুভূতির প্রভাব এক্ষেত্রে অনেক কার্যকরী ও
ফলপ্রসূ হয়।

অনুভূতির প্রকাশ বলতে এখানে কী বোঝানো হচ্ছে?

অনুভূতির প্রকাশ হল একধরনের যোগাযোগের মাধ্যম যা একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে মানুষ পাঁচরকমভাবে মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। যেমন- সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে নজরদারি করা, শত্রুতা বা বিরুদ্ধাচরণ করা, অপ্রয়োজনীয়ভাবে হস্তক্ষেপ করা বা অনধিকার প্রবেশ, ইতিবাচক উৎসাহ দান এবং আন্তরিক ব্যবহার। এগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি নেতিবাচক এবং পরের দুটো ইতিবাচক অনুভূতি।

কীভাবে নেতিবাচক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ মানুষের অসুখ সারানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়?

এ বিষয়ে জর্জ ব্রাউন একটি গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যে সমালোচনা, শত্রুতা বা বিরুদ্ধাচরণ করা এবং কারোর অনুভূতির উপর অপ্রয়োজনীয়ভাবে হস্তক্ষেপ বা অনধিকার প্রবেশের মতো পারিপার্শ্বিক চাপ একজন মানসিক অসুখের শিকার হওয়া মানুষের সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো অসুখ বারবার ফিরে আসার ক্ষেত্রে একটা অন্যতম বড় সম্ভাবনা হল নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশের প্রভাব।

পরিচর্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি  কোন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়?

মানসিকভাবে অসুস্থরা সহজভাবে সবকিছু বুঝতে চায়। যেহেতু তারা আগে থেকেই  চিন্তাভাবনার দিক থেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা সংকোচে ভোগে তাই তাদের সঙ্গে ধাপে ধাপে যোগাযোগ স্থাপন করা দরকার। অন্যের অনুভূতির প্রতি মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা সংবেদনশীল হয়। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রুগি, বিশেষত যারা হ্যালুশিনেশন বা সম্মোহনের শিকার হয় প্রথমে তাদের সঠিক অবস্থান এবং তাদের মনের গভীরে কী চিন্তাভাবনা হচ্ছে, সে বিষয়ে জানার ও বোঝার চেষ্টা করা জরুরি। অথচ এই দায়িত্বপালন করা একজন পরিচর্যাকারীর পক্ষে যথেষ্ঠ কঠিন। তাই সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ হল আমাদের অর্থাৎ পরিচর্যাকারীদের আচার-আচরণ সহজ, স্বাভাবিক করা, রুগির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার জন্য আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া। তাদের প্রতি আন্তরিক, দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল হয়ে তাদের কাজকর্ম করতে উৎসাহ দান ও ভালো কাজের প্রশংসা করা প্রয়োজন। এভাবে তাদের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়া সম্ভবপর হয়।

আপনি যে ধরনের নির্দেশিকার কথা বলছেন বা সুপরামর্শ দিচ্ছেন তা কি সব ধরনের মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, নাকি নির্দিষ্ট বা বিশেষ কোনও মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়?

এগুলোই চিরাচরিত নির্দেশিকা। কিন্তু স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা ডিমেনশিয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানের জন্য পরিচর্যাকারীদের আরও নানারকম পন্থা, পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি।

রুগির বোধগম্যতার সমস্যাগুলো কি মানুষের চেতনা বা বৌদ্ধিক দক্ষতার সঙ্গে সম্পর্কিত?

হীন সামাজিক চেতনা এর একটা সম্ভাব্য কারণ হতেই পারে। কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের মধ্যে সামাজিক চেতনার যে দুর্বলতা দেখা দেয় তা পরিচর্যাকারীদের নেতিবাচক আচার-আচরণের দ্বারা আরও বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা অসুস্থ মানুষের উপর তার কুপ্রভাব পড়ে। তবে এই বিষয়টা নিয়ে এখনও অনেক
বিতর্ক রয়েছে।

মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ যদি ঠিকঠাক ওষুধ খেতে না চায় তাহলে পরিচর্যাকারীদের কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?

এক্ষেত্রে পরিচর্যাকারীদের ধৈর্য ধরতে হবে। মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য পরিচর্যাকারীদের অনেক বেশি করে গঠনমূলক হয়ে উঠতে হবে। রুগির মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করা, তাদের অনুপ্রেরণা জোগানো এবং নিজের আচার-আচরণে ইতিবাচকতা আনা প্রয়োজন। রুগি এবং পরিচর্যাকারীর মধ্যে পারস্পরিকতা গড়ে তোলা জরুরি। রুগিকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য এই কথাই বোঝাতে হবে যে তার মতো এমন ওষুধ পরিচর্যাকারীকেও খেতে হয়। এক্ষেত্রে পরিচর্যাকারীকে ওষুধের গুরুত্ব সম্পর্কে রুগিকে ওয়াকিবহাল করা দরকার এবং ওষুধের গুণাগুণ বা ফলাফল নিয়ে রুগি যাতে চিন্তা না করে সে কথাও তাদের বোঝাতে হবে। ওষুধের বিষয়ে পরিচর্যাকারীকে শুধু এটুকুই ব্যাখ্যা করতে হবে যে ওষুধ যেমন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তেমনই মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাতেও ওষুধ কার্যকরী ভূমিকা নেয়।

রুগির সঙ্গে পরিচর্যাকারীদের কার্যকরী যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা দেখা দেয় তা দূর করার জন্য আপনি কী পরামর্শ দিতে চাইবেন?

প্রিয়জনের দেখভালের জন্য একজন পরিচর্যাকারীর ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল ইতিবাচক মানসিকতার অধিকারী হয়ে ওঠা। সেই সঙ্গে রুগিকে শ্রদ্ধা, সম্মানও করা প্রয়োজন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও পরিচর্যাকারীকে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে দৈনন্দিন জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা একজন পরিচর্যাকারীর অন্যতম দায়িত্ব হওয়া উচিত।

পরিচর্যাকারীদের জন্য আপনার পরামর্শগুলো তাহলে একনজরে কী কী?

১. রুগির হয়ে কোনও কথার উত্তর দেওয়া এড়াতে হবে। যদি পারস্পরিক যোগাযোগের সময়ে রুগি কিছুটা সময় নেয় তাহলে তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

২. অসুস্থ মানুষের উপস্থিতিতে বিশেষ করে সংকটের সময়ে জটিল অনুভূতির বিষয়ে কথাবার্তা বলা ঠিক নয়। এমন দীর্ঘ আলোচনা করা ঠিক নয় যা একজন অসুস্থ মানুষকে আরও দিশাহীন করে তুলতে পারে।

৩. তাদের চিন্তাভাবনা, চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে মনের নিজস্ব ধারণাগুলোকে ততক্ষণ এড়িয়ে চলা উচিত যতক্ষণ না তারা নিজের মুখে নিজেদের কথা বলছে। এক্ষেত্রে শুধু নিজের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কোনও বিষয়ে মতভেদ থাকলেও রুগির কথা মন দিয়ে শোনা প্রয়োজন।

৪. যদি তাদের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় তাহলে তাদের সঙ্গে আরও স্পষ্টভাবে কথা বলতে হবে। নিজের মনে কোনও কথার গোপন অর্থ খোঁজা উচিত নয়।

৫. মানুষের ইতিবাচক আচরণের প্রশংসা করা দরকার এবং বিপদের সময়ে তার পাশে থাকা জরুরি।

৬. রুগির সামনে কোনও অস্বচ্ছ মন্তব্য করা একেবারেই ঠিক নয় যাতে তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়।

৭. হালকা মন্তব্য বা মতামত দেওয়া কখনোই কাম্য নয়। যেমন- ''ও একটা অপদার্থ'' বা ''ও কোনওদিনই সঠিক কাজ করতে সক্ষম হবে না'' প্রভৃতি।

৮. কোনও একটা কথা বলার সময়ে পরিবারের একজন সদস্যরই তা বলা উচিত। কারণ একসঙ্গে দু'জন মানুষের কথা বলা ঠিক নয়। তাহলে কে কী বলছে তা ভালো করে বোঝা যায় না। এটি মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি সম্মান বাড়াতেও সাহায্য করে।

৯. মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের সঙ্গে তাদের রোগ বা সমস্যা নিয়ে কথা বলা যাবে না। তাদের প্রতি সমালোচনা বা শত্রুতার মনোভাব দূর করাও জরুরি।

১০. পরিবারের প্রত্যেক সদস্যেরই সমানভাবে কথা বলার অধিকার থাকা উচিত। যদি মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষটি ভাবে যে তাকে চাপ দিয়ে কোনও কথা বলানো  হচ্ছে তাহলে পরিচর্যাকারীর উচিত তাকে এই বলে আশ্বস্ত করা যে যদি রুগি চায় তাহলেই একমাত্র সে কথা বলতে পারে। আর অসুস্থ ব্যক্তি যখন কথা বলবে তখন অন্যদের তা শান্তভাবে মন দিয়ে শোনা একান্ত জরুরি।