দম্পতিদের জীবনে মানসিক অসুস্থতা একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানসিকভাবে অসুস্থ কারোর সঙ্গে সম্পর্ক হলে তার প্রতি খুব ভালোভাবে যত্ন নিতে হয়। ফলে দৈনন্দিন জীবনের টুকিটাকি কাজকর্ম সামলানো যেমন অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে তেমন জীবনসঙ্গীকে যত্ন করতে গিয়ে মানুষ একেবারে নাকাল হয়ে পড়ে। পারস্পরিক সম্পর্কে যদি একজন সঙ্গীর কোনওরকম মানসিক অসুস্থতা থাকে তাহলে পরিস্থিতি ঠিক কেমন হতে পারে তা বোঝার জন্য রিতিকা ধালিওয়াল কথা বলেছিলেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট পল্লবী তোমার-এর সঙ্গে। সেই কথপোকথনের সম্পাদিত অংশ এখানে তুলে ধরা হল:
কীভাবে আমি জানতে পারব যে আমার সঙ্গী অবসাদ বা উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে?
চিকিৎসাগত অবসাদের ফলে সাধারণত মানুষের মেজাজ-মর্জি বিষণ্ণ থাকে। এই বিষণ্ণতার বোধ মানুষ একটানা অনেকদিন ধরে অনুভব করতে থাকে। দেখা যায় যে কাজে মানুষের আগে খুব উৎসাহ ছিল পরে সেই কাজেই সে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, তারা খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, তাদের মানসিক কাজকর্ম ঠিকঠাক হচ্ছে না এবং মানুষের সঙ্গে সামাজিকতা রক্ষার ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাদের সর্বাঙ্গীণ জীবনযাপনে অনেক জটিলতা বা অবনতি হচ্ছে। এমনকী, কোনও কাজ করতেও তাদের খুব অসুবিধা হয় এবং কাজ করার জন্য অনেক শ্রম ব্যয় করতে হয়। এছাড়াও একজন মানুষের জীবনে অবসাদের ফলে তাদের ঘুমের ধরন ও খিদে বোধের ক্ষেত্রে বড়সড় পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে আলস্য বা কুঁড়েমি, হতাশা এবং অপদার্থতার বোধ জেগে ওঠে। তাদের কথাবার্তার মধ্যেও এসবের ছাপ পড়তে দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে নিজের ক্ষতি করার ইচ্ছে এবং নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার প্রবণতাও জেগে ওঠে।
উদ্বেগের সমস্যার ফলেও মানুষের জীবনে তার নানারকম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাধারণভাবে এই সমস্যার ফলে মানুষ তার জীবনের সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শারীরিক কিছু উপসর্গ, যেমন- বুক ধড়ফড় করা, ঘাম হওয়া, হাত-পা কাঁপা প্রভৃতি। এছাড়াও দেখা দেয় প্যানিক ডিসঅর্ডার বা আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার সমস্যা। এই সমস্যাটি উদ্বেগের একটা ভয়াবহ পর্যায়। এটি কম দিন স্থায়ী হলেও রুগির সাহস, শক্তি বা বল একেবারে ভেঙে দেয়। আসলে প্যানিক ডিসঅর্ডারের বাহ্যিক প্রকাশ অনেক বেশি স্পষ্ট হয় এবং আশঙ্কাজনিত অনুভূতির জন্ম দেয়।
যদি আমার সঙ্গী তার অসুস্থতা দূর করার জন্য কারোর সাহায্য নিতে না চায় তাহলে আমি কী করব?
দেখুন, আমার মনে হয় এক্ষেত্রে আমাদের একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে অন্যের সাহায্য নেওয়ার মানে হল নিজের কিছুটা শক্তিহীনতা বা সাহসের অভাব প্রকাশ করা। এবার আমরা যদি আমাদের আলোচ্য বিষয়ের দিক নজর দিই তাহলে দেখব যে একজন মানুষ অসুস্থ হয়েছে এবং সেজন্য তার উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। তাই প্রথমে নিজের সঙ্গীর আশঙ্কাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তারা ঠিক কী ধরনের অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত, তা উপলব্ধির করার চেষ্টা করতে হবে। আপনার সঙ্গী যাতে তার সমস্যা দূর করার জন্য সঠিক সাহায্য নেয় সেব্যাপারে আপনাকে অবশ্যই উৎসাহ দিতে হবে এবং উপযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে। যদি এর ফলে আপনার সঙ্গী ভয় পায় বা বিচলিত বোধ করে তাহলে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আপনাকে যৌথভাবে আলাপ-আলোচনা করতে হবে এবং আপনাকেই বেশি কথাবার্তা বলতে হবে। যদি রুগি বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে না চায় তাহলে তাকে হেল্পলাইন বা অনলাইনের সাহায্য নেওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। যদি এসব চেষ্টা ব্যর্থ হয় তাহলে সঙ্গীকে সঙ্গে করে নিয়ে আপনাকে বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে এবং সমস্ত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে হবে। এরপরে সব শুনে বিশেষজ্ঞ যা ব্যবস্থা নেবেন সেই মতো আপনাদের চলতে হবে। এক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞই আপনাকে সঠিক পথ দেখাতে পারবেন এবং কীভাবে একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া যায় তার উপায় একজন বিশেষজ্ঞই সবচেয়ে ভালো বলতে পারেন।
অন্য আরেকটি বিষয় যা আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি তা হল অসুস্থ মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষে তার কাছের মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা ও সাহায্য পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই অসুখ সারানোর ক্ষেত্রে কখনও কখনও এই বিষয়টাই সবচাইতে বড় হয়ে ওঠে।
সঙ্গীকে নিরাপদ এবং ভালো রাখতে গেলে আমায় কী করতে হবে?
যখন আপনি অনুভব করবেন যে আপনার সঙ্গীর মধ্যে মানসিক অসুখ দেখা দিচ্ছে তখন সবার আগে নিজেকে এই বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। অর্থাৎ, আপনি যদি রোগটি সম্পর্কে কিছুই না জানেন তাহলে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকবেন। তাই রোগের লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা বোঝার জন্য রোগটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করা, যে দলটি আপনার সঙ্গীর জন্য কাজ করছে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা একান্ত আবশ্যক। এসব ছাড়াও সঙ্গীর অসুস্থতাকে ভালোভাবে বোঝা আপনার পক্ষে একান্ত জরুরি। কারণ অনেকসময়ে অসুখের লক্ষণগুলো একইরকম বলে মনে হলেও, অনুভূতিগুলি অনেক বেশি প্রকট ও জটিল হয়ে দেখা দেয়। এবং আপনার পক্ষে তা জানা ও বোঝার চেষ্টা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে।
যখন আমি অধিকাংশ সময়ে আমার সঙ্গীর যত্ন নিতে ব্যস্ত থাকব তখন কীভাবে আমি নিজের দেখভাল করার সময় পাব?
রুগির অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করা যেহেতু প্রত্যেকের লক্ষ্য থাকে তাই আমরা ভুলে যাই যে প্রাথমিক পরিচর্যাকারী বা এক্ষেত্রে রুগির সঙ্গীকে অনেক বাধার মুখোমুখি হতে হয়। তাদের পক্ষে সফলভাবে বাধার মোকাবিলা করা সবসময়ে সম্ভব না-ও হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আমার মনে হয় প্রথমে সঙ্গীদের এটা বোঝা প্রয়োজন যে তারা কোনও সমাধানের পথ নয় এবং তারাই যে শুধু এককভাবে রুগিকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম তা-ও নয়। সেক্ষেত্রে নিজের যত্নের দিকটাও নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলে একটা সমাধান সূত্র বের করতে হবে। কারণ সঙ্গী যদি অসুস্থ হয় তাহলে সে দৈনন্দিন কাজ করতে সক্ষম না-ও হতে পারে, সমাজে মেলামেশা করতে না-ও চাইতে পারে বা হয়তো সে চাকরিও না করতে পারে আর এগুলোই তখন মানসিক চাপ বাড়াতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যেও জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই এই সমস্যা কাটানোর জন্য বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করা একান্ত জরুরি। অন্যদিকে এসময় নিজের পছন্দের কাজ করার জন্য সময় বের করা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে যদি আপনি দেখেন সমস্যার সমাধান করা আপনার পক্ষে অসুবিধাজনক হচ্ছে তখন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে একদম লজ্জা বা কুন্ঠা বোধ করলে চলবে না।