বিকার

আসক্তি: আমাদের প্রয়োজন চিকিৎসার প্রসারে উন্নতি ঘটানো

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের ব্যবহার ভারতে ক্রমশ এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে এই সমস্যার প্রতি মনোযোগও ক্রমে কমে যাচ্ছে আমাদের। সম্প্রতি  নিমহ্যান্স-এর পরিচালনায় যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমীক্ষা হয়েছে তাতে দেখা গিয়েছে যে প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে কমপক্ষে একজন মাদক দ্রব্যের ব্যবহারজনিত সমস্যায় আক্রান্ত, এবং অ্যালকোহল ও বিভিন্ন মাদক ব্যবহারকারী প্রতি ১০০জন মানুষের মধ্যে মাত্র ৩জন সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য পায়। কেন  এত কম সংখ্যক মানুষ চিকিৎসার দ্বারস্থ হয় এবং কী করলে নিশ্চিতভাবে সবার কাছে সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব সে বিষয়ে হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শ্রীরঞ্জিথা জেউরকর কথা বলেছিলেন নিমহ্যান্স-এর আসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রধান ডঃ প্রতিমা মূর্তির সঙ্গে।

মাদকদ্রব্য ব্যবহারজনিত অব্যবস্থার উপর এই সমীক্ষা করা হয়েছিল। এর অর্থ  আসলে কী? মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও তার প্রতি আসক্তির মধ্যে কীভাবে পার্থক্য করা যায়?

আমার মতে সবচাইতে বড় সমস্যা হল মাদক বা বিভিন্ন নেশার দ্রব্য ব্যবহারজনিত অব্যবস্থা বা সমস্যা। এভাবে বলার কারণ হল এটা শুধু মানুষের আসক্তি নয়, বরং এর ফলে একজন মানুষ যে কোনও ধরনের রাসায়নিক নেশার পদার্থ, তা বৈধ পদার্থ যেমন- তামাক বা অ্যালকোহলও হতে পারে আবার অবৈধ বস্তু যেমন- ব্রাউন সুগার, কোকেন, স্টিমুল্যান্টস্‌ বা প্রস্তাবিত নানারকম ড্রাগের ব্যবহারও হতে পারে। যেভাবেই এই সমস্যাকে ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, আমাদের দেশে ইদানীং  প্রায় সব বয়সের মানুষ, যেমন- পূর্ণবয়স্ক, অল্পবয়সি বা বয়স্ক এমনকী, মহিলারাও নানারকম মাদক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাই এবিষয়ে প্রত্যেকেরই সজাগ থাকা উচিত। কারণ কখন মাদকের ব্যবহার সমস্যাবহুল হয়ে দাঁড়ায়, তা জোর দিয়ে কোনও মানুষের পক্ষে বলাই সহজ নয়।

মানসিক স্বাস্থ্যের সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে কমপক্ষে ৮৫ শতাংশ মানুষ, যারা মাদকদ্রব্যের ব্যবহারজনিত সমস্যায় আক্রান্ত, অথচ সমস্যা সমাধানের জন্য তারা যথাযথ চিকিৎসা সুযোগ পায় না। এমন ঘটনা কেন ঘটে বলে আপনার মনে হয়?

এর একটা কারণ হল যতক্ষণ না সমস্যা গুরুতর হয়ে উঠছে ততক্ষণ মানুষ একে  সমস্যা বলে মানতেই চায় না। দ্বিতীয় কারণ হল মাদক ব্যবহারের কিছু সামাজিক ফলাফল নিয়ে মানুষ আদৌ ওয়াকিবহাল থাকে না। যেমন- পারিবারিক হিংসা, দুর্ঘটনা, আপদকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা (আঘাত এবং শারীরিক বিপর্যয়), পরিবারের সদস্যদের নানারকম মানসিক সমস্যা, কর্মক্ষেত্রের সমস্যা- এসব ঘটনাকে প্রায়শই গুরুত্ব সহকারে বিচার করা হয় না এবং সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও দেরি হয়। তৃতীয় কারণ হল মানুষ জানে না যে সাহায্যের জন্য কোথায় যেতে হবে। কারণ মাদক দ্রব্যের ব্যবহারের ফলে যে সমস্যা দেখা দেয়, তা নির্ধারণ করার জন্য পেশাদারদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ থাকে না এবং যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থাও তারা করতে পারে না। চতুর্থ কারণ হল মাদক ব্যবহারজনিত কলঙ্কের বোধ।  মানুষের মধ্যে এখনও মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা নিয়ে দ্বিধাবোধ এবং সেই নেশা ছাড়ার ক্ষেত্রে অক্ষমতা লক্ষ করা যায়। তাই আমার মনে হয় এসব কারণগুলোকেও গুরত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা জরুরি।

কীভাবে এই সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে মানুষকে সাহায্যের ব্যাপারে উৎসাহিত করা যায়?

মানুষকে আমাদের বোঝানো জরুরি যে মাদকদ্রব্যের ব্যবহারজনিত অব্যবস্থা জনস্বাস্থ্য সমস্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটাও বোঝানো প্রয়োজন যে তাড়াতাড়ি চিকিৎসার সাহায্য নিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তৃতীয় বিষয় হল পেশাদারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাদক দ্রব্যের ব্যবহারজনিত সমস্যায় আক্রান্তদের সহায়তা করার জন্য উদ্যোগী করে তুলতে হবে। অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গিও সাধারণ মানুষের মতো। কারণ সাধারণের মতো তারাও ভাবে যে মাদকদ্রব্য ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীই দায়ী। মাদকাসক্তের জন্যও তারাই দায়ী। কিন্তু আমরা জানি যে এসব সত্যি নয়। মাদক দ্রব্যের ব্যবহার শুরু করার পিছনে মানুষের অনেক কারণ থাকে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হল কারণ যাই থাকুক না কেন, মাদকের ব্যবহার বাড়ানোর পিছনে মানুষের একপ্রকার আসক্তিগত জৈবিক প্রকৃতি থাকে। এবং একবার এর ব্যবহার বেড়ে গেলে মানুষের পক্ষে নিজেকে সাহায্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য আমাদের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করা জরুরি, যার ফলে তাদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে।

এক্ষেত্রে কী ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন?

আসক্তির সমস্যা নিয়ে নানারকম ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন- একে মস্তিষ্কের অব্যবস্থা বলা হয়। সেজন্য যে মানুষটা আসক্তির শিকার হয় তার প্রয়োজন পড়ে যত্নের ও সহায়তার। সেই সঙ্গে তাকে দোষারোপ করে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করে রাখা উচিত নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আসক্তির মাত্রা বাড়ার আগে সমস্ত সমস্যা খতিয়ে দেখা জরুরি। এজন্য আমাদের চারপাশে থাকা মানুষ যারা অ্যালকোহল বা অন্যান্য ড্রাগ ব্যবহার করছে তাদের জন্য যথাযথ নীতি গ্রহণ করা দরকার। এজন্য প্রয়োজন হলে কল্যাণকর আইনও প্রনয়ণ করা যেতে পারে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল মাদক ব্যবহারের ক্ষতিকারক প্রভাব প্রতিরোধ করার জন্য জনসচেতনতা গড়ে তোলা।

এইসময়ে একজন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে কী ধরনের সাহায্য পাওয়া যায়?

বাস্তবসম্মত সাহায্য পেতে গেলে এইসময়ে মানুষকে বিশেষ আসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর দ্বারস্থ হওয়া জরুরি। কিন্তু আমি আগেই বলেছি যে একজন মানুষের মধ্যে আসক্তিগত সমস্যা দেখা দিতে শুরু হওয়া থেকে আরম্ভ করে এই  কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ের একটা লম্বা ব্যবধান থাকে। তাই আমার মতে প্রথম বিষয় হল সমস্ত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের, অর্থাৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক থেকে মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল প্রভৃতি স্থানের চিকিৎসকদের আগে মানুষের মধ্যে মাদকদ্রব্য ব্যবহারজনিত সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হল আমরা জানি ননকমিউনিকেবল অসুখের ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্যের ব্যবহারকে প্রতিরোধযোগ্য ঝুঁকির উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা। আমাদের দেশে ননকমিউনিকেবল অসুখ বলতে বোঝায় হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস,ক্যান্সার, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা প্রভৃতি। আর এই সমস্যাগুলো ক্রমশ মহামারীর আকার নিচ্ছে। আর সেজন্য তামাক, অ্যালকোহল এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্যের ব্যবহার প্রতিরোধযোগ্য ঝুঁকির উপাদান হিসেবে গন্য হচ্ছে। তাই প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য একজন ডাক্তারকে প্রতিটি মানুষের মাদকদ্রব্যের ব্যবহারজনিত অভ্যাসের কথা জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সেই সঙ্গে মানুষের জীবিনযাত্রাজনিত অন্যান্য সমস্যা, যেমন- তার খাদ্যতালিকা, শরীরচর্চা ইত্যাদি বিষয়ের উপরেও জোর দিতে হবে। মানুষকে সাহায্য করার আগে এইসব বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া জরুরি। যেমন- জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য একজন মানুষ কেন মাদক ব্যবহার করছে এবং তার বিকল্প স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা কী হতে পারে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। এর পরবর্তী পর্যায়ে এগুলোর ক্ষতিকারক ব্যবহার ও এর উপর নির্ভরশীলতা দূর করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা প্রশিক্ষিত কাউন্সেলরের দ্বারা কাউন্সেলিং করানো অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে। এর ফলে মানুষের আচরণগত পরিবর্তন দেখা দেওয়া সম্ভবপর হয়।

কীভাবে একজন ডাক্তার মানুষের আচরণগত পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করতে পারে?

মানুষ যখন বুঝতে পারবে যে তার আচরণ খুব আশানুরূপ হচ্ছে না এবং তার  আচরণের বদল ঘটলে অনেক সুফল পাওয়া যাবে তখনই সেই মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসবে। তাই মানুষের সঙ্গে পরিবর্তনের সুফলগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে, কেন মানুষ মাদকদ্রব্য ব্যবহার করছে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। যদি এর কারণ নিজেকে অন্যদের থেকে সরিয়ে নেওয়া বা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় তাহলে সেই সংক্রান্ত যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি। যদি এর পিছনে মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তি কাজ করে তাহলে তার মোকাবিলা করাটা গুরুতর হয়ে উঠবে। যদি অন্য কোনওরকম অবেগানুভূতিগত কারণ থাকে, যেমন- একাকিত্ব, তাহলে তা দূর করার জন্য সামাজিক সহযোগিতা বাড়ানো উচিত। অন্যদিকে,আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মাদকদ্রব্যের উপর মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তি কমানোর জন্য অনেক ওষুধ রয়েছে। আর সেই ওষুধগুলো যদি কাউন্সেলিং-এর সঙ্গে প্রয়োগ করা হয় তাহলে সমস্যা সমাধানের জন্য তা খুবই কার্যকরী হয়ে
দেখা দেবে।

সব শেষে আমার পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি এই যে মানুষকে যদি মাদক ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে বোঝানো যায় তাহলে তার ব্যবহার প্রতিরোধ করা সম্ভব। যখন দেখা যাচ্ছে যে একজন মানুষের মাদকের প্রতি আসক্তি নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম  করে যাচ্ছে তখন তার ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখার জন্য চেষ্টা করা জরুরি। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা। কারণ এই অসুখ অবশ্যই চিকিৎসাযোগ্য। অর্থাৎ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপের সমস্যা প্রভৃতির মতো এই রোগেরও যথাযথ চিকিৎসা রয়েছে। তাই সঠিক চিকিৎসা, পরিমার্জিত জীবনযাত্রা, দৈনন্দিন জীবনে মানসিক চাপের মাত্রা হ্রাস করা এবং কীভাবে সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় তা শেখার চেষ্টা করলে মাদকদ্রব্যের ব্যবহারজনিত সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয়।