অ্যাস্পারগারস্ সিনড্রোম বলতে কী বোঝায়?
অ্যাস্পারগারস্ সিনড্রোম হল অটিজম সমস্যার অন্তর্গত একধরনের বিকাশজনিত দুর্বলতা বা ত্রুটি। ১৯৪০ সালে ভিয়েনার এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হান্স অ্যাস্পারগার প্রথম এই সমস্যাটি জনসমক্ষে আনেন। তাঁর চিকিৎসাধীন একটি অল্পবয়সী ছেলের আচরণে তিনি অ্যাস্পারগারস্ সিনড্রোমের লক্ষণ দেখতে পান। এই রোগীর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তি এবং ভাষাগত বিকাশ স্বাভাবিক থাকলেও, তার সামাজিক আদানপ্রদানগত দক্ষতা এবং শক্তি ছিল খুবই দুর্বল। হান্সের মতে, এই ধরনের ছেলেরা আসলে 'খুদে পণ্ডিত' হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ তারা তাদের পছন্দের বিষয় নিয়ে বিশদে কথাবার্তা চালাতে পারে।
অ্যাস্পারগারস্ সিনড্রোমকে সাধারণত অল্প পরিমাণ অটিজমগত সমস্যা বা 'হাই-ফাংশনিং অটিজম' হিসেবে ধরা হয়। এইধরনের সমস্যা প্রায়শই সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। কারণ যে সব বাচ্চাদের এই সমস্যা থাকে তারা দৈনন্দিন জীবনে খুবই সপ্রতিভ, সচল এবং ঝকঝকে গোছের হয়। তাই তাদের সামাজিক আদানপ্রদানগত সমস্যার জন্য আচরণের মধ্যে যে অস্বাভাবিকতার লক্ষণ ফুটে ওঠে, তা প্রায়শই ঢাকা পড়ে যায়।
২০১৩ সালে ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল ফর মেন্টাল ডিসঅর্ডার (DSM-5) অটিজম, অ্যাস্পারগারস্ সিনড্রোম এবং অন্যান্য বিকাশজনিত সমস্যাকে একত্রে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বা এএসডি-র (ASD) ছাতার তলায় নিয়ে আসে।
অ্যাস্পারগারস্ সিনড্রোমের চিহ্ন এবং লক্ষণ
সামাজিক মেলামেশা বা আদান প্রদান- অ্যাস্পারগারস্ সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের ভাষাগত এবং বুদ্ধি ব্যবহারগত (কগনিটিভ) দক্ষতা ভালো হয়। এরা সাধারণত অন্যান্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বা যোগাযোগ গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু এই যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধা হয়। সমাজের চোখে এদের আচরণ খানিকটা অদ্ভুত বলে মনে হয় এবং এরা সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলতে পারে না, শরীরি ভাষার পড়তে পারে না এবং সমবেদনা ব্যক্ত করতে পারে না। এই ধরনের বাচ্চারা যেকোনো কথা আক্ষরিক অর্থে বোঝে, বিদ্রূপ বা হাতের ভঙ্গিমা এদের কাছে বোধগম্য হয় না।
সীমাবদ্ধ আগ্রহ এবং এক কাজ বারবার করা- যে সব বাচ্চাদের মধ্যে অ্যাস্পারগারস্ সমস্যা থাকে তাদের কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে অনেক তথ্য এবং জানার আগ্রহ থাকে, যেমন - ট্রেন, ডাইনোসর প্রভৃতি বিষয়ে এদের আগ্রহ থাকে। কিছু ক্ষেত্রে, এক কাজ বারবার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যেমন - পাখীর ডানার মতো বারবার হাত ঝাপটানো।
অটিজম সমস্যার অন্যান্য অস্বাভাবিকতার মতো অ্যাস্পারগারসেও দেখা যায় অনুভূতিগত বা বোধশক্তির ক্ষেত্রে প্রবল সংবেদনশীলতা। যেমন- চোখে দেখা, কানে শোনা বা কোনও জিনিসের গন্ধ শোঁকার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা প্রকাশ পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট শব্দ শুনে বা গন্ধ শুঁকে বাচ্চারা দিশাহারা বা বিপন্ন বোধ করে। অনেকসময়ে এই ধরণের ঘটনায় নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য এরা রেগে চিৎকার করার মতো অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে।
সংজ্ঞা অনুযায়ী অ্যাস্পারগারস্ সিনড্রম এবং অটিজম সমস্যার মধ্যে একটা প্রধান বৈষম্য হল- অ্যাস্পারগারস্ সিনড্রমের ক্ষেত্রে বাচ্চাদের মধ্যে ভাষাগত বা বুদ্ধির ব্যবহারিক বিকাশের কোনও দুর্বলতা থাকে না। এমনকী, যে সমস্ত বাচ্চাদের অ্যাস্পারগারস্ সমস্যা থাকে তারা প্রচুর বই পড়ে এবং বুদ্ধিবৃত্তির মান সাধারণ বা তার বেশী হয়। তবে অটিজমের মতো অ্যাস্পারগারসের ক্ষেত্রেও বাচ্চাদের কথা বলার ধরনের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকে। যেমন- একঘেয়েমি বা ভীষণ জোরে অথবা উচ্চস্বরে কথা বলা।
অনেকসময়ে হাঁটা চলার (মোটর) দক্ষতা দেরিতে বিকশিত হওয়ার ফলে হাঁটা চলার মধ্যে অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে।
অ্যাস্পারগারস্ সমস্যার কারণ
এখন পর্যন্ত এই সমস্যার নির্দিষ্ট কারণ নিশ্চিত করে বোঝা সম্ভব হয়নি। পরিবারের মধ্যে কারোর যদি এই ধরনের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে জিনগত কারণে সেই পরিবারের অন্য কারোর মধ্যে এই রোগ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোন জিনের প্রভাবে এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তা নির্ধারণ করা যায়নি।
এই সমস্যা মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
অ্যস্পারগারস্ সমস্যা নির্ণয় করা
বাচ্চার অভিভাবক বা পরিচর্যাকারী এবং তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। একজন বিশেষজ্ঞ বাচ্চার সর্বাঙ্গীন বিকাশের ইতিহাস, তাদের সামাজিক আদানপ্রদানগত দক্ষতা এবং আচরণগত তথ্যের উপর নির্ভর করে এই রোগ নির্ণয় করে থাকেন। সাধারণত পাঁচ থেকে ন'বছর বয়সি বাচ্চাদের মধ্যে এই অসুখ নির্ণয় করা হয়। কিন্তু অনেকসময় রোগের লক্ষণ ঠিকঠাক বুঝতে না পারার জন্য প্রায়শই এই রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা ধন্ধের মধ্যে পড়ে যান অথবা এডিএইচডি, ওসিডি বা টওরেট সমস্যার সঙ্গে অ্যাস্পারগারস্ সমস্যা নিয়ে তাদের মনে সংশয় জেগে ওঠে।
অ্যাস্পারগারস্ সমস্যার সমাধান
এই সমস্যার সঠিক সমাধানের উপায় জানা না থাকলেও, এমন অনেক কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে, যার সাহায্যে এই অসুখে আক্রান্ত একটি বাচ্চার দৈনন্দিন জীবনযাপনে যাতে এই রোগের প্রভাব না পড়ে তার ব্যবস্থা করা যায়। যেমন- স্পিচ থেরাপি এবং সামাজিক দক্ষতাজনিত প্রশিক্ষণ একটি শিশুর সামাজিক যোগাযোগ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপির সাহায্যে এই সমস্যায় আক্রান্ত বাচ্চাদের উপর স্কুলে ভয় দেখানো বা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করে রাখার উপর রাশ টানা যায়। অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে শিশুদের হাঁটাচলা এবং অতিসংবেদনশীলতাজনিত সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে শেখানো হয়। এই ধরনের প্রতিকারগুলির সাহায্যে শুধু বাচ্চারা নয়, তাদের অভিভাবক এবং পরিচর্যাকারীরাও উপকৃত হন।