বিকার

সেরিব্রাল পলসি

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

সেরিব্রাল পলসি কি?

সেরিব্রাল পলসি হল এক ধরনের স্নায়বিক ভারসাম্যহীনতা যা বাচ্চাদের মস্তিষ্ক গঠনের সময় কোন প্রকার আঘাত জনিত কারণে বা স্নায়ুকোষের ঠিকমত কাজ না করার কারণে ঘটে থাকে। সেরিব্রাল পলসির জন্য শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নড়াচড়া, পেশীর সক্ষমতা, কোওর্ডিনেশন বা ভারসাম্য, সব কিছুই ব্যাহত হয়। এটা হল ক্রনিক চাইল্ডহুড ডিস্‌এবিলিটি বা বাচ্চাদের দুরারোগ্য অক্ষমতা।

নিচে লেখা বিশেষ বিশেষ লক্ষণগুলি সেরিব্রাল পলসির ক্ষেত্রে দেখা যায়:

  • স্থায়ী এবং অচিকিৎসা যোগ্য: এক্ষেত্রে, মস্তিষ্কের আঘাত বা ক্ষতি যা হয় তা স্থায়ী এবং তা উপযুক্ত চিকিৎসার দ্বারাও সেরে ওঠে না। আঘাতপ্রাপ্ত মস্তিষ্ক শরীরের অন্যান্য অংশের মত সেরে ওঠে না। যদিও, সংশ্লিষ্ট অবস্থার সার্বিক উন্নতি বা অবনতি দুটোই ঘটতে পারে।

  • নন‌-প্রগ্রেসিভ: অর্থাৎ, পরবর্তীকালে মস্তিষ্ক বা ব্রেনের আর কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয় না।

  • দুরারোগ্য: যে ব্যক্তি সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত তাঁকে জীবনভর একই অবস্থাতে বেঁচে থাকতে হয়।

এই অবস্থার সাথে আরও অনেক সংশ্লিষ্ট অসুবিধা বা প্রবলেম থাকতে পারে:

  • মোটর ডিস‌অর্ডার

  • সেন্সারী ইমপেয়ারমেন্ট বা সেন্সারী নার্ভের ক্ষয়ক্ষতি

  • কানে শোনার অক্ষমতা

  • মনঃসংযোগের অভাব

  • ভাষা ও উপলব্ধির অভাব

  • মেন্টাল রিটার্ডেশন বা বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা

  • ব্যবহার জনিত অসুবিধা

  • শারীরিক অসুস্থতা

  • বার বার জ্ঞান হারানো বা ফিট‌ হওয়া

প্রধান বিষয়

  • বাচ্চা বয়সে সেরিব্রাল পলসি হল সব থেকে নিকৃষ্ট মানের শারীরিক বা মোটর-জনিত অক্ষমতা।

  • সমগ্র পৃথিবীতে, প্রায় ১৭ মিলিয়ন লোক সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত।

সেরিব্রাল পলসির লক্ষণগুলি কী?

যে লক্ষণগুলির দ্বারা মস্তিষ্কের আঘাত বা অপুষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়, সেইগুলি হল সেরিব্রাল পলসির চিহ্ন। এইগুলি প্রাথমিক পদ্ধতি যার দ্বারা এই রগকে চিহ্নিত করা যায় যেহেতু, বাচ্চারা নিজেদের অসুবিধা ঠিকমত বোঝাতে পারে না। যদিও, বাবা-মা-রা মোটর ডেভেলপমেন্ট এর কমি লক্ষ্য করতে পারেন, ডাক্তাররা ক্লিনিক্যাল টেস্ট বা পরীক্ষা ও চিকিৎসার মূল্যায়নের দ্বারা অন্যান্য অসুবিধা দূর করে  অসামঞ্জস্যতাকে নির্ণয় করতে পারেন।

সংশ্লিষ্ট অবস্থা দেখে, চিকিৎসক ঠিক কোথায় এবং কতোটা জটিল অসামঞ্জস্যতা আছে তাও নির্ণয় করতে পারেন । এই চিহ্নগুলি প্রত্যেক বাচ্চার ক্ষেত্রে এক নাও হতে পারে যেহেতু সকলের ব্রেন বা মস্তিষ্কের আঘাতের পরিমাণ এক নয়।

  • মাসল টোন বা মাংসপেশির গঠন: স্বল্প বা অতিরিক্ত পেশীর গঠন – অলস হাত-পা, খুব শিথিল বা খুবই শক্ত হাত-পা, অনিয়মিত পেশীর সঙ্কোচন, গাঁট বা গ্রন্থিগুলির একত্রিত হয়ে যাওয়ার ফলে সঠিক ভাবে নড়াচড়া না করতে পারা। এর ফলে হাঁটাচলা, বসে থাকা বা দাঁড়ান কোনটাই অবলম্বন ছাড়া সম্ভব হয় না।

  • চলাচলের সামঞ্জস্য ও তার নিয়ন্ত্রণ: মাংসপেশির গঠনের অসামঞ্জস্যতা বাচ্চাদের হাত-পা, শরীরের নড়াচড়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। পেশীর গঠনের এই অসামঞ্জস্যতার জন্যই বাচ্চাদের হাত-পা কুঁকড়ে থাকা বা শিথিল ভাবে থাকা বা ক্রমাগত কাঁপতে দেখা যায়। উদাহরণ স্বরূপ, একটা বাচ্চা, ৬ মাস বয়সেও বসতে বা উল্টোতে পারে না, অথবা ১২-১৮ মাসের পরেও হাঁটতে পারে না, এবং তারও পরে হয়তো বা, নিজের কাজ, যেমন লেখা, দাঁত মাজা বা জুতো পরা, এগুলি করতে পারে না।

  • অঙ্গভঙ্গি: সেরিব্রাল পলসি ভারসাম্য ও অঙ্গভঙ্গিকে ব্যাহত করে। যখন বাচ্চারা বিভিন্ন ভঙ্গিতে বসে তখন পস্‌চারাল রেসপন্স করাটা খুবই স্বাভাবিক। সাধারণত, সামনে পা ছড়িয়ে বসা একটা বাচ্চার স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি। কিন্তু সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত বাচ্চার পক্ষে এইভাবে বসা সম্ভব নয়।

  • ভারসাম্য: নার্ভ বা মোটরের অসামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ করবার ফলেই বাচ্চাদের ভারসাম্য বা ব্যালেন্সের প্রবলেম বা অসুবিধা দেখা যায়। বাবা-মা-রা এই অসংগতির চিহ্নগুলো যখন বাচ্চারা বসতে শেখে বা উঠে দাঁড়ায় বা হামা দেয় বা হাঁটতে শেখে তখন লক্ষ্য করতে পারেন। সাধারণ ভাবে শিশুরা তাদের হাতের সাহায্যেই বসা, হাঁটা, পরবর্তীকালে নিজের কাজ নিজেরাই করতে শেখে। কিন্তু যদি একটা বাচ্চা কারো সাহায্য ছাড়া বসতে বা দাঁড়াতে না পারে, তখন সেটা সেরিব্রাল পলসির চিহ্ন বলে ধরা হয়।

  • গ্রস‌ মোটর ফাংশন: হাত-পা ও বিভিন্ন পেশীর উপযুক্ত নাড়াচাড়া দ্বারা সার্বিকভাবে চলাচল সম্পন্ন করাই হল গ্রস্‌ মোটর ফাংশন। যে ভাবে একটা শিশুর ব্রেন গড়ে ওঠে, সে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কিছু কিছু নির্দিষ্ট কাজ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু যদি সেই কাজ করতে তার নির্দিষ্ট সময়ের থেকে বেশি সময় লাগে বা নির্দিষ্ট সময়ে সে ঠিকমতো সেই কাজ করতে না পারে, যেমন হামাগুড়ি দেওয়ার সময় এক দিকে হেলে থাকা, কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটতে না পারা, এগুলি সেরিব্রাল পলসির লক্ষণ হতেও পারে।

  • ফাইন মোটর ফাংশন: যথাযথ ও সন্নিহিত পেশীর চলাচলকেই ফাইন মোটর ফাংশন বলা হয়। ফাইন মোটর কন্ট্রোল-এর মধ্যে অনেক কাজই পড়ে যে গুলো শিশুরা শেখে, যেখানে শারীরিক ও মানসিক দুই-এরই সম্মিলিত প্রয়াস লাগে। বাচ্চা যত বেড়ে উঠতে থাকে তার এই সকল দক্ষতা দেখা যায়। অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা অপেক্ষাকৃত দেরীতে ফাইন মোটর কন্ট্রোল এর প্রকাশ সেরিব্রাল পলসির সম্ভাব্য কারণ।

  • ওরাল মোটর ফাংশন: ঠোঁট, জিভ, মাড়ির প্রকৃত ব্যবহারের ফলেই মানুষ কথা বলে, খায় বা পান করে। এই সবই হল ওরাল মোটর ফাংশন। একটা বাচ্চা, যে সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত, তার ওরাল মোটর ফাংশনও ঠিকমত কাজ করে না; জার ফলে তার কথা বলতে, চেবাতে, খেতে অসুবিধা হয়। ওরাল মোটর ফাংশন শ্বাস-প্রশ্বাস, কথা বলা এই সব কিছুকেই কব্জা করে। এপ্রাক্সিয়া ও ডিসারথ্রিয়া হল স্নায়বিক বাচনভঙ্গির অসামঞ্জস্য যা সেরিব্রাল পলসির জন্য হয়।

সেরিব্রাল পলসির উপসর্গগুলি কী কী?

শিশুর প্রথম তিন বছরের মধ্যেই সেরিব্রাল পলসির উপসর্গগুলি দেখা যায়। এই রোগ মানুষের শরীরের যে কোনও অঙ্গকে আক্রমণ করতে পারে এবং তা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা হয়। কিছু বাচ্চার খুবই সামান্য অসুবিধা দেখা যায় আবার কেউ কেউ ভীষণ রকম অক্ষম হয়। একটা বাচা হয়তোবা একটু দেরিতে হামা দেওয়া, বসা, হাঁটা বা কথা বলা শিখতে পারে।

আরও কিছু উপসর্গ, যেমন নিশ্বাসের অসুবিধা, কোনও কিছু হাত দিয়ে ধরার অক্ষমতা, চিবোতে অসুবিধা, ক্লান্তি, কারো সাহায্য ছাড়া না বসা বা দাঁড়ানো, শুনতে না পাওয়া, শরীরের কোনও অংশে যন্ত্রণা হওয়া এইসব উপসর্গ নিজ নিজ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রকাশ পায় কিনা তা বাবা-মাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করা উচিত।

সেরিব্রাল পলসির কারণগুলি কী?

সেরিব্রাল পলসির প্রকৃত কারণ এখনও অব্ধি অজানা। এটা দেখা গেছে যে, গর্ভাবস্থায় বা জন্মের সময় বা জন্মের প্রথম ৩ বছরের মধ্যে ব্রেন বা মস্তিষ্কের আঘাত বা ক্ষতি শিশুকে সেরিব্রাল পলসির দিকে ঠেলে দেয়।

ডাক্তারদের মতে, গর্ভাবস্থায় ব্রেনের আঘাতই হল প্রায় ৭০ ভাগ শিশুর সেরিব্রাল পলসির কারণ। ব্রেন বা মস্তিষ্কে আঘাতের প্রকৃতি ও জটিলতার ওপরই নির্ভর করে বাচ্চার নার্ভ বা মোটর-এর কর্মক্ষমতা ও বুদ্ধির বিকাশ কিরকম হবে।

যে সকল কারণে মাথায় আঘাত লাগতে পারে তার মধ্যে আছেঃ

  • গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ: এটা ভ্রূণের নার্ভাস সিস্টেমের বেড়ে ওঠাকে ব্যাহত করে। জিনগত সমস্যা, সংক্রমণ বা বাচ্চার জন্মকালীন সমস্যা থেকেও সেরিব্রাল পলসি হতে পারে।

  • অকালে জন্মগ্রহণ: সময়ের আগেই যদি বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে ও সেক্ষেত্রে যদি আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয় তাহলে সদ্যজাত বাচ্চার মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। আরেকটা কারণ হল জন্ডিস। যখন রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা খুব বেড়ে যায় তখনই জন্ডিস হয়। সাধারণত, লিভার অতিরিক্ত বিলিরুবিনকে ছেঁকে শরীর থেকে বের করে দেয়। সদ্যজাত বাচ্চার লিভার-এর ঠিকমত কাজ শুরু করতে কিছুদিন সময় লাগে। কাজেই এটা খুব স্বাভাবিক যে সদ্যজাত শিশুর জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই জন্ডিস হয়। ফটো থেরাপি পদ্ধতিতে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে, উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসা না করতে পারলে ব্রেনের কোষগুলির ক্ষতি হতে পারে।

  • জন্মের প্রথম কয়েক বছর: কঠিন অসুস্থতা, আঘাত বা ব্রেনে অক্সিজেনের ঘাটতি ব্রেনের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত কোরে তোলে।

কিভাবে সেরিব্রাল পলসি নির্ণয় করা যায়?

সেরিব্রাল পলসি নির্ণয়ের কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতি নেই। এটা সাধারণত, বাচ্চার চিকিৎসার ইতিহাস ও শারীরিক কিছু পরীক্ষার দ্বারাই নির্ধারিত হয়। যদিও এই রোগের তাড়াতাড়ি নির্ণয় হওয়াটাই কাম্য যাতে বাবা-মা তাঁদের বাচ্চার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করতে পারেন, কিন্তু এই রোগ নির্ধারণে প্রায়শই দেরি হয় যেহেতু এই ভারসাম্যহীনতা নির্ণয় করা অসুবিধাজনক। আবার, অনেক সময় শিশুটির অন্য শারীরিক অসুস্থতা থাকায় প্রথম কয়েক বছরে উপসর্গগুলির পরিবর্তন ঘটে, যার দরুন এই রোগ সঠিক ভাবে চিহ্নিত করা যায় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে জন্মের প্রথম বছরের মধ্যেই রোগটি ধরা পরে, আবার খুব স্বল্প আক্রান্ত সেরিব্রাল পলসির বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ৩-৪ বছরের আগে রোগ নির্ধারণ করা যায় না।

ডাক্তার বাচ্চার অভিব্যক্তি, পেশির গঠন, অঙ্গভঙ্গি, পেশির সঞ্চালন ও অন্যান্য জিনিষ যা বাচ্চার জন্মের প্রথম কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে গড়ে ওঠে তার পরীক্ষা করেন। প্রাথমিকভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বা কিছু কিছু পরীক্ষা যেমন, এম আর আই বা সি টি স্ক্যান করতে পরামর্শ দেওয়া হয় ব্রেনের প্রকৃত চিত্র বা অবস্থা জানার জন্য।

যদি বাচ্চাটি সময়ের আগেই জন্মগ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে এম আর আই স্ক্যান দ্বারা ব্রেনে কোনও আঘাত আছে কিনা তা বোঝা যায়। কিন্তু এটা প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য যথেষ্ট তাড়াতাড়ি। যদি ডাক্তার বিবেচনা করেন যে শিশুটির সেরিব্রাল পলসি হবার সম্ভাবনা আছে, সেক্ষেত্রে জন্মের একেবারে প্রথম মাস থেকেই পর্যবেক্ষণ করা উচিত।

পরীক্ষা ও স্ক্যান

আরো কিছু পরীক্ষা করা দরকার হতে পারে সেরিব্রাল পলসির মত উপসর্গ যুক্ত অন্য রোগের সম্ভাবনা দূর করতে।

  • এম আর আই স্ক্যান: এখানে রেডিও ও ম্যাগনেটিক তরঙ্গ দ্বারা ব্রেন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

  • আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান: শব্দ তরঙ্গ ব্যবহৃত হয় ব্রেনের প্রকৃত চিত্র জানার জন্য।

  • সি টি স্ক্যান: একগুচ্ছ এক্স-রে ব্যবহার করে তার দ্বারা কম্পুটারে ব্রেনের ত্রি-মাত্রিক চিত্র বানানো হয়।

  • ইলেক্ট্রোএন্সেফেলোগ্রাম বা ই সি জি: ছোট ইলেক্ট্রোড মাথার তালুতে রেখে তার দ্বারা ব্রেন বা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা লক্ষ্য করা।

  • ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাম বা ই এম জি: এর দ্বারা পেশির কর্মক্ষমতা ও পেরিফেরাল নার্ভের কর্মক্ষমতার পরীক্ষা করা হয়।

  • রক্ত পরীক্ষা।

সেরিব্রাল পলসির চিকিৎসাপদ্ধতি

বাবা-মা-রাই প্রথম লক্ষ্য করতে পারেন তাঁদের বাচ্চা বেড়ে ওঠার পথের কোনও ধাপ পেরোতে অসুবিধাতে পড়ছে কিনা। যদি কোনও ধাপ পেরোতে দেরী হয়, বাবা-মা-রা ভাবতে পারেন তাঁদের সন্তান দেরিতে শুরু করছে ও পরবর্তীকালে ঠিক শিখে যাবে। বাবা-মাকে অবশ্যই পেডিয়াট্রিসিয়ান বা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে এই বিষয়ে অবগত করা উচিত কোনোরকম দেরী না করে।

সেরিব্রাল পলসিকে সারানো যায় না, কিন্তু এই রোগের উপসর্গগুলি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অনেক চিকিৎসাপদ্ধতির সুবিধা লাভ করা যায়। যদিও, সেরিব্রাল পলসি তার ধরণ, আক্রান্ত স্থান বা অক্ষমতার জটিলতা অনুযায়ী আলাদা হতে পারে, একটা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দল একত্রে কাজ করে এই রোগে আক্রান্ত শিশুর বিস্তীর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি স্থির করেন।

পেডিয়াট্রিসিয়ান, ফিজিওথেরাপিস্ট, অর্থোটিস্ট (বিকলাঙ্গতা ও অস্থিসন্ধির অসামঞ্জস্যতা যিনি যন্ত্রদ্বারা দূর করতে পারেন), স্পীচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, অক্যুপেশানাল থেরাপিস্ট বা পেশাদারী শিক্ষা প্রদানের বিশেষজ্ঞ, বিশেষ ধরণের শিক্ষক এবং মানসিক চিকিৎসক, সকলে একজোট হয়ে কাজ করেন জাতে শিশুটি তার সব অক্ষমতার সাথে মানিয়ে যতটা সম্ভব স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে।

  • ফিজিওথেরাপি: যখনই একটা শিশু সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ধরা পড়ে, সাথে সাথেই এটা শুরু করা উচিৎ। ফিজিওথেরাপির কাজ হল পেশি-গুলিকে দুর্বল হওয়া, ছোটো হয়ে যাওয়া বা তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া থেকে আটকানো। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট বাচ্চাটিকে কিছু শারীরিক কসরত শেখান যা তাঁর পেশিকে মজবুত করে তুলবে। বিশেষ ধরণের হাত বা পা দেওয়া হয় যার ব্যবহারের ফলে পেশির প্রসারণ ও অঙ্গভঙ্গির উন্নতি ঘটে।

  • স্পিচ থেরাপি: এটা বাচ্চাদের যোগাযোগের ক্ষমতাকে বাড়ায়। শিশুদের কিছু এক্সারসাইজ সেখান হয় যা তাদের পরিষ্কারভাবে কথা বলতে সাহায্য করে।

কথাবলার জটিলতা যেখানে বেশি সেখানে বাচ্চাকে যোগাযোগের বিকল্প পদ্ধতি, যেমন ইঙ্গিতের দ্বারা যোগাযোগ, শেখান হয়। বাচ্চার যোগাযোগের জন্য বিশেষ যন্ত্র, যেমন কম্পুটারের সাথে যুক্ত ভয়েস্‌ সিন্থেসাইজার, পাওয়া যায়।

  • অক্যুপেশানাল থেরাপি: এই থেরাপিস্ট বাচ্চার রোজকার কাজ, যেমন খাওয়া, জামা কাপড় পরা, টয়লেটে যাওয়া, করতে কি কি অসুবিধা হয় তা চিহ্নিত করে তা থেকে বেড়িয়ে আসার কাজে সহায়তা করেন। অক্যুপেশানাল থেরাপিস্ট বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে আপনার বাচ্চার আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেন।

  • প্লে থেরাপি: এটা হল একটা নতুন পদ্ধতি যেখানে খেলার মাধ্যমে বাচ্চারা আনন্দ পায় এবং এর ফলে তাদের মানসিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয়। এটা একটা থেরাপিউটিক ও সাইকোলজিক্যাল পদ্ধতি যেটা বাচ্চাকে অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করে। প্লে থেরাপি বাচ্চার শারীরিক সক্ষমতা, সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে মানসিক চাহিদা ও কাজ করার ক্ষমতা বাড়ায়। এই পদ্ধতি শুরু করা হয় যখন বাচ্চা খুবই ছোটো (০ -২ বছর), কিন্তু এটা বয়ঃসন্ধির সময়ও দরকার। যত তাড়াতাড়ি প্লে থেরাপি চালু করা হয়, বাচ্চা তত তাড়াতাড়ি উপকৃত হয়। প্রাথমিক অবস্থাতে শুরু করলে বাচ্চার ব্যবহার থেকে তার অন্যের সাথে যোগাযোগ সব কিছুরই উন্নতি ঘটায়।

  • কাউন্সেলিং: একজন কাউন্সিলার বা সাইকলজিস্ট বাচ্চা ও তার পরিবারের সাথে এই সব অক্ষমতার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।

  • বিশেষ ভাবে তৈরি শিক্ষা ব্যবস্থা: অক্ষমতা বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা-যুক্ত বাচ্চাদের শেখানোর জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত শিশুর যত্ন নেওয়া

একটা বাচ্চার জন্ম হল একটা পর্ব যা অনেক আশা, উত্তেজনা, আনন্দ-উদ্দীপনাতে ভরপুর থাকে। কিন্তু যখন বাবা-মা জানতে পারেন যে তাঁদের বাচ্চার সেরিব্রাল পলসি হয়েছে তখন তা তাঁদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের দূরদৃষ্টি একেবারেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ ঠিকই, কিন্তু তাঁদেরকে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম হল বাচ্চার অবস্থা ঠিকমত বোঝা ও সেই মত ঠিক কি সাহায্য দরকার তা স্থির করে উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি বা থেরাপির সাহায্য নেওয়া।

সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত শিশুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করা ও তার যত্ন নেওয়া খুবই কঠিন এবং তা মানুষকে হতবুদ্ধি করলেও সেখানে আশার আল অবশ্যই আছে। আপনি হচ্ছেন আপনার সন্তানের সব থেকে ভাল উকিল ও শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। সেরিব্রাল পলসির বিষয় জ্ঞান-অর্জন আপনাকে সবরকম ভাবে নিজের সন্তানকে সাহায্য করার জন্য উপযুক্ত করে তুলবে। এই রোগের সাহায্যকারী কোনও দলে যোগ দিলে আপনি যেমন আপনার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে পারবেন, তেমনই তাঁদের থেকেও অনেক কিছু শিখতেও পারবেন।

সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্তদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি

সেরিব্রাল পলসি উত্তরোত্তর ছড়িয়ে না পড়লেও এই রোগে আক্রান্তরা কোনদিনও সুস্থ হয় না। একজন মানুষ যিনি এই রোগে ভুগছেন তাঁকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এবং তিনি কিভাবে নিজের সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে হয় ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণ করতে হয় তাও শিক্ষা লাভ করতে পারেন। এখন অনেক বিকল্প ব্যবস্থা ও সাহায্যকারী যন্ত্র এসে গেছে যা সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত শিশুদের লেখাপড়া সম্পূর্ণ করতে, হবি বা ভালোলাগার কাজ করতে এবং খেলাধুলা এমনকি অবসর বিনোদনেও সহায়তা করতে পারে।

প্রাথমিক পর্যায় ধরা পড়ার পর সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের অনেকদূর এগিয়ে যাবার প্রমাণও আছে। একটা বাচ্চা যে হাঁটতে পারত না বা হাঁটতে শেখেনি তাকেও পর্বতারোহণ করতে দেখা গেছে। যে কখনও কথা বলতে পারবে আশা করা হয়নি, সে বা তারাও কথা বলে, বই লিখে তাদের কথাতে ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের দ্বারা অন্যদের অনুপ্রাণিত করেছে এরূপও দেখা গেছে।

এক্ষেত্রে, বাবা-মা হলেন একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যাঁরা নিজেদের বাচ্চাকে তার ভালোলাগার জায়গাটা খুঁজে নিয়ে প্রাথমিকভাবে বেঁচে থাকার সব উপকরণ দিয়ে তাকে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেন।

সেরিব্রাল পলসির ধরণ

চার ধরণের সেরিব্রাল পলসি হয়:

  • স্প্যাস্টিক সেরিব্রাল পলসি: এটা বেশী সংখ্যক বাচ্চার ক্ষেত্রে দেখা যায় যদিও এই রোগের প্রখরতা সব সময় এক নাও হতে পারে। এই প্রতিবন্ধকতারও চারটে ভাগ আছে:

    • হেমিপ্লেজিয়া - একই দিকের হাত ও পা আক্রান্ত হয়; হাতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

    • প্যারাপ্লেজিয়া - দুই পা এই রোগের আওতায় আসে; হাত খুবই সামান্য প্রভাবিত হয় বা একেবারেই রোগের আওতাতে আসে না।

    • কোয়াড্রিপ্লেজিয়া বা টেট্রাপ্লেজিয়া - দুটো হাত ও দুটো পা সমভাবে আক্রান্ত হয়।

    • ডাইপ্লেজিয়া - এটা হল প্যারাপ্লেজিয়া ও টেট্রাপ্লেজিয়ার মধ্যবর্তী অবস্থা; এক্ষেত্রে দুটো পা-ই সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

  • আথেটয়ড বা ডিস্‌কাইনেটিক সেরিব্রাল পলসি: এর বৈশিষ্ট্য হল পেশির গঠন ও চলাচল খুবই কম এবং মাথা, হাত ও পায়ের অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনি, যা অনুভূতি বা টেনশন এর সাথে সাথে বাড়ে আর বিশ্রামের সময় কমে যায়।

  • আটাক্সিক সেরিব্রাল পলসি: এটা খুবই কম দেখা সেরিব্রাল পলসি যার বৈশিষ্ট্য হল দুর্বলতা, চলাফেরার অসুবিধা ও একই ভাবে না থাকতে পারা। ব্যাপক অর্থে, ফাইন মোটর স্কিলের অসুবিধা ও চলাফেরার সমস্যাটাই এখানে প্রধান।

  • বিভিন্ন সেরিব্রাল পলসির মিশ্র অবস্থা: বিভিন্ন ধরণের সেরিব্রাল পলসির সমন্বয়; যদিও স্প্যাসটিসিটি ও আথেটোসিস এই দুই প্রকারের সমন্বয়ই বেশি দেখা যায়।