দু'টি পর্যায়ের প্রথমটি ছিল মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে একটি মেয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আর অন্যটি হল স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত তার মায়ের জীবনের ঘটনা
মায়ের অসুখ সেরে ওঠার আগের দিনগুলির কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে মনে পড়ে যে ওই সময়টা একেবারেই সহজ ছিল না আমার জন্য। মায়ের অসুস্থতার ধরনটা যেমনই হোক না কেন, সেটা আমার কাছে ছিল একপ্রকার আশ্চর্যের বিষয়। সেই সময়ের অনেক গুরুতর বিষয় আজ তেমনভাবে মনে না পড়লেও, ওই বিশেষ দিনগুলোর স্মৃতি কখনোই আমার মন থেকে মুছে যাবে না। কারণ ওই সময়ে আমি জীবনের প্রতিকূলতা সত্বেও ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে শিখেছি। সেই সময়ের সুস্থ থাকা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার কোন ধারণাই ছিল না।
২০১৪ সালের প্রথম দিকে বেশ কয়েক মাস বাড়ির থেকে দূরে থাকার পরে যখন ফিরে এলাম, তখন লক্ষ্য করলাম যে, আমি আমার মায়ের মনের থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছি। মনে হয়েছিল, মায়ের সঙ্গে বাস্তবের যোগাযোগ বড়ই কম। মা যেন সেই সময়ে ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আগে মায়ের দেখভালের ব্যাপারে আমি খানিকটা অবহেলাই করেছিলাম। কারণ, আমি নিজেই জানতাম না যে, আমাকে কী করতে হবে এবং এটাও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, মায়ের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে ও নাগালের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সেই সময়ে সমস্যা অত্যন্ত সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছিল। এর কিছুদিন পরে মায়ের স্কিৎজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে।
আজকে মা অনেকটাই সুস্থ। চিকিৎসায় ভালো সাড়াও দিয়েছে। এখন মা সুস্থ-সবল একজন মানুষ। কিন্তু আমি জানি যে, একবছর আগেও যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এবং এমন অবস্থা অতীতে কখনো হয়নি। আমার মনে আছে যে, মা সেই সময়ে একটা অন্য জগতে বাস করছিল। এবং এই অবস্থায় মানুষ খানিকটা হতভম্ব হয়ে যায়।
এখন আমার ২৯ বছর বয়স। কিন্তু সেই ২০ বছর বয়স থেকে ক্রমাগত আমার মধ্যে এক ধরনের অসহায়তার বোধ জন্মেছিল। সেখানে আমার মায়ের কোনও ভূমিকা ছিল না। আমার যখন ২৪ বছর বয়স, তখন থেকে আমি ও মা একসঙ্গে থাকি। এর আগে মায়ের দু'বার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সেই দুটি বিয়ের একটাও সুখের হয়নি। এই কারণে মায়ের মনে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। আমি ছিলাম মায়ের একমাত্র সন্তান। তাই পরিবারের সমর্থন ছাড়াই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, মা এবং আমি একসঙ্গে থাকব। আমার আশা ছিল, এতে মা ভালো থাকবে। কিন্তু আমার সঙ্গে থাকার পরেও মায়ের অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি।
ইতিপূর্বে, মায়ের সঙ্গে কী ঘটেছে এবং কেন তা ঘটেছে, সে সম্পর্কে আমার কখনোই কোনও ধারণা ছিল না। তবে আমাদের পরিবারের ঝগড়া, অশান্তি মায়ের অসুস্থতার জন্য যে অনেকাংশে দায়ী, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কী কারণে আমার মা এহেন একটি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার জন্য সন্তুষ্টজনক কোনও ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাইনি।
আমার মায়ের মতো একজন সভ্য-ভদ্র এবং যত্নশীল মানুষও ধীরে ধীরে কর্কশ, রূঢ় এবং তার চারপাশের জগতের প্রতি একেবারে নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। চারপাশের সবকিছুই তার কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হত। আমার মতে, মানুষের আচরণের মধ্যে দু'টি বিষয় প্রধান। প্রথমটি হল আমাদের যে কোনও বিরক্তির একটা বাস্তব ভিত্তি থাকে এবং সেই বিরক্তির কারণেই আমাদের মনে সন্দেহ দানা বাধে। যদি দেখা যায় যে, মা ঘরের কাজকর্মে তেমন মন দিচ্ছে না, তাহলে আমার কাছে এর ব্যাখ্যা হল যে, মা সব সময়ে মাতৃসুলভ আচরণ করছে না। যদি আমি দেখি যে বাড়ির বিভিন্ন বিল জমা দেওয়া হয়নি বা খাওয়ার তৈরি হতে অনেক সময় লাগছে, তাহলে আমার মধ্যে একধরনের অসন্তোষ জন্মায়। কিন্তু বিল জমা দেওয়া বা খাবার তৈরি করার কথা একবারও মনে আসে না। এইভাবে তার মধ্যে অনেক কাজে অংশ না নেওয়ার মানসিকতা দেখা দেয়। আমার মা সেই সময়ে শুধুমাত্র শরীরে বেঁচে ছিল, তার মন বলতে কিছুই ছিল না। এবং আমিও তাকে একথা বোঝাতে পারিনি যে, চারপাশের ভালো-মন্দের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। মা যেন তখন একপ্রকার স্বয়ংক্রিয় মেশিনে পরিণত হয়েছিল এবং মাকে সেই সময় ধরা-ছোঁওয়াও ছিল বেশ কষ্টকর কাজ।
এইভাবে সময় যত এগোতে লাগল, আমার মধ্যে একধরনের চাপা দুঃখবোধ জাগতে শুরু করেছিল। আমি আমার চেনা মাকে হারিয়ে ফেলেছি— এমন একটা ধারণার সঙ্গে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম। সেই সময় আমি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলাম। আমার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক এতটাই কাছের ছিল যে, দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়াটা তাই খুব অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল। আসলে আমি আমার কাজ দিয়ে ঘরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই সময়ে আমি নিজের মধ্যে একধরনের ক্লান্তি অনুভব করতাম। আমি এ-ও অনুভব করতে শুরু করেছিলাম যে, আমি যা কিছু করার চেষ্টা করছি, তা যথেষ্ঠ নয়। এইভাবে আমার মধ্যে একপ্রকার অভাববোধ গড়ে উঠেছিল। প্রথমে দুঃখ, তারপর রাগ এবং সেই রাগ ক্রমে মনে তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল। আর এর জন্য আমার নিজের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিনতা এসে গিয়েছিল, যার ফলে আমার মনের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষাগুলিকে আমি ত্যাগ করতে শুরু করি। আমি কখনোই কল্পনা করতে পারিনি যে, জীবনে আর মায়ের সঙ্গে থাকতে পারব না, বা আমার মা আমার পাশেই থাকবেন, কিন্তু তার উপস্থিতি আমি টের পাব না।
ঘটনাক্রমে আমি যেই শহরে কাজ করতাম সেটাকে ছেড়ে দিয়ে মাকে নিয়ে আমাদের পুরনো শহরে ফিরে গেলাম, যাতে মা তার চেনা-জানা শহরে থাকতে পারে এবং সেই অনুভূতি মাকে সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করবে। আমি আশা করেছিলাম যে, নিজের শহরের গিয়ে আমরা আবার আমাদের জীবনের চেনা ছন্দে ফিরে আসতে পারব।
কিন্তু এই স্থানান্তরও পরিস্থিতির কোনও বদল ঘটাতে পারল না। উপরন্তু পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল। আমি মনের দিক থেকে পুরোপুরি ভেঙে পড়লাম এবং একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যেহেতু আমি এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কোনও কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারছি না, তাই এই সবের থেকে আমার দূরে চলে যাওয়াই উচিত। আমার কাছে আমার রোজগারের টাকাগুলি ছিল। সেটা নিয়ে আমি অন্যত্র চলে গেলাম। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে, আমার মা আমার খোঁজ করে কি না। মায়ের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার ফলে আমার জীবন থেকে যেন কয়েকটি মাস হারিয়ে গিয়েছিল।
প্রায় মাস দুয়েক পরে আমি বাড়িতে ফিরে এলাম। এসে দেখলাম অধিকাংশ জিনিসই অগোছালো হয়ে পড়ে রয়েছে। বাড়িটায় ধুলো ভর্তি। আমি এবং আমার মা কেউ কারও সঙ্গে বেশিরভাগ সময় কথাই বলতাম না। মা কীভাবে তার সময় কাটাচ্ছে, সে সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। এবং এই ব্যাপারে মা-ও আমাকে কিছু বলত না। যখন আমি বাড়িতে ফিরে এলাম, তখন কিছু বলার আগে মা আমার দিকে শান্তভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। মা সেদিন বলেছিল যে, তার মেয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে।
এই কথা শুনে আমি নিজের মধ্যে এমন এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম, যা আমি আমার অনেক বন্ধুকে সে কথা বলেছিলাম। পরে তারাও আরও অনেককে সে কথা জানিয়েছিল। 'আমি তোমার মেয়ে, আম্মা,'— এই কথা আমি বলেছিলাম। কিন্তু এই কথা শুনে আমার দিকে মা তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কারো কাছেই এই আচরণের কোনও যথার্থ ব্যাখ্যা ছিল না। এবং আমি এতটাই অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম যে, সেখান থেকে আমি পালিয়ে আসি। আমি জানতাম না, কীভাবে মা এহেন আশ্চর্য কথা আমায় বলল। কীভাবে মা ভাবল যে, আমি তার মেয়ে নই? কেন মা সেদিন ওই ব্যবহার করেছিল, তার কোনও একটা যুক্তিসংগত কারণ আমি খুঁজেই পায়নি।
এই ঘটনার পরে একদিন রাত্রে আমি লক্ষ্য করলাম যে, মা কেমন যেন মারমুখী হয়ে উঠছে। এমন কিছু বিষয় ছিল, যেখানে মায়ের কোনও নিয়ন্ত্রণই ছিল না। এটা ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয় যে, আমি এখনও বুঝতে পারিনি সেদিন মায়ের কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল। সবরকম ভাবেই আমি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। সেদিন আমি এমন কী করেছিলাম, যার জন্য মা ওই অদ্ভুত ব্যবহার করেছিল?
মায়ের ওই ধরনের আক্রমণাত্মক মনোভাব থেকে আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, অবিলম্বে মায়ের উপযুক্ত চিকিৎসার দরকার। আমি চেয়েছিলাম মাকে যথাযথ সাহায্য করে সুস্থ করে তুলতে। এর আগে মায়ের কাজকর্মকে আমি অগ্রাহ্য এবং অবহেলা করেছিলাম, তাই সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, দেরি হয়ে গেলেও, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, মাকে সুস্থ করার জন্য একজন চিকিৎসকের সাহায্য অবশ্যই নেব।