সালটা ছিল ২০১৩। ওই সালেই মালায়লম সিনেমা 'নর্থ ২৪ কাদাম' এমন একটি বিষয়কে জনসমক্ষে এনেছিল, যা আমাদের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ অক্সিজেন জুগিয়েছিল। ফাহাদ ফাজিল তাঁর অসামান্য অভিনয়ের মাধ্যমে দিয়ে নায়কোচিত সম্মান লাভ করেন। এই সিনেমার একটি চরিত্র হরিকৃষ্ণ ছিল একজন সফট্ওয়্যার প্রোগ্রামার। তাঁর মধ্যে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। এহেন মানসিক অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে খোলাখুলি কিছু না বললেও, এই সিনেমাটির মধ্য দিয়ে ওসিডি-র সম্বন্ধে সমাজের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের ধ্যান-ধারণা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। হরি সব সময়ে এবং সর্বত্র নোংরা পরিষ্কার করার জন্য টিস্যু পেপার বা ন্যাকড়া সঙ্গে নিয়ে যেত। সে যেখানে বসত, সেই জায়গাটিতে বসার আগে পরিষ্কার করে নিত। আবার কোনও ঘর থেকে বেরনো বা ঢোকার সময়ে সে নিজে হাতে দরজা বন্ধ করত না বা খুলতও না। কারণ, তার মনে হত যে, দরজার হাতলে নোংরা লেগে রয়েছে। প্রতিদিন সকালে চারদিক ধাপে-ধাপে পরিষ্কার করার কাজটা তার কাছে একপ্রকার প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সিনেমার পরিচালক দেখাতে চেয়েছিলেন যে, অন্যান্য মানসিক রোগের মতো, ওসিডি-র ক্ষেত্রেও মানুষের মধ্যে কয়েকটি লক্ষণ ফুটে ওঠে। যেমন, হরির মধ্যে আকাশপথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কতগুলি অযৌক্তিক ভয় কাজ করত, যা সাধারণ ভয় হিসেবে অনেক মানুষের মধ্যেই থাকে। সিনেমাটি শেষ হয়েছিল হরির আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আর এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছিল একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং সমাজ কর্মীর সঙ্গে হরির যোগাযোগের ফলে। একটি ট্রেনযাত্রার সময়ে দু'জনের দেখা হয়েছিল।
'নর্থ ২৪ কাদাম'-এর মতো সিনেমার অপ্রত্যাশিত সাফল্য, এর গুরুত্বের দিকটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। যে সময় বক্স অফিসে কোনও সিনেমার সাফল্য নির্ভর করত সেই সিনেমার নায়ক-নায়িকার মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার দৃশ্য বা আঘাত-প্রত্যাঘাতের মতো উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্যের বাড়বাড়ন্তের উপর, সেখানে এই ধরনের সম্পূর্ণ স্রোতের বাইরে থাকা একটি সিনেমার জনপ্রিয়তার বিষয়টি সত্যিই অভাবনীয়। আলোচ্য সিনেমাটি আমাদের সামনে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল যে, সমাজে এখনও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়টি, বিশেষত, ওসিডি-র মতো একটি গুরুতর সমস্যার ক্ষেত্রেও মানুষ কতটা উদাসীন বা নির্লিপ্ত থাকে। ওসিডি-র মতো অসুখ সম্পর্কে আমাদের প্রচুর ভুল ধারণা রয়েছে এবং সমস্যাটিকে অতিরঞ্জিত করে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়।
প্রথমত, ওসিডি-র সমস্যাকে শুধু মানুষের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বা জিনিসপত্রকে নিখুঁতভাবে গোছানোর বাতিক হিসেবে বিবেচনা করা একেবারেই ঠিক নয়। যদি কেউ আলমারিতে রং মিলিয়ে জামাকাপড় সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে, তাহলে সে ওসিডি-র সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে, একথা বলা যাবে না। এটার মধ্য দিয়ে কারও জামাকাপড় পরার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ধার্য সময়টার সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়। নিমহানস্-এর অধীনস্থ, ভারতের প্রথম ওসিডি ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ওয়াইসি জনার্দন রেড্ডির মতে, একজন ব্যক্তি, যিনি সম্পূর্ণ ওসিডি-তে আক্রান্ত এবং যার মধ্যে ওসিডি-র সামান্য লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে, এমন দু'টি ক্ষেত্রে খুব সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। এবং এটি চিহ্নিত করার জন্য মানুষের চিন্তাভাবনা এবং কাজকর্মের অব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। আমাদের সবার মনেই কিছুক্ষণের জন্য খারাপ বা অশুভ চিন্তা আসে এবং তা আবার মন থেকে বেরিয়েও যায়। কিন্তু একজন ওসিডি-র সমস্যায় ভোগা রুগির ক্ষেত্রে এমনটা হবে না। তাদের সমগ্র চিন্তাভাবনাটাই খারাপ বা অশুভ এবং সহজে এর থেকে মুক্তিও পাওয়া যায় না। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা উচিত, ওসিডি মানুষের প্রাত্যহিক ব্যক্তিগত এবং কর্মজীবনের উপর কুপ্রভাব বিস্তার করে।
ওসিডি-র ফলে মানুষের মনে এমন এক বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয়, যা তার কাছে শেষ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিষয় বা চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়। বাধ্য হয়ে এই সময় মানুষ একটা কাজ বারবার করতে থাকে। অথচ সে জানে যে, তার এহেন আচরণের কোনও অর্থই হয় না। সেটা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং বাড়াবাড়ি করা। ওসিডি সাধারণত অল্প পরিমাণ থেকে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ওসিডি-র লক্ষণগুলি বেশ জটিল এবং এর বহিঃপ্রকাশ এক-এক জনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম হয়। সব কিছুর মধ্যেই দূষণের সম্ভাবনা এবং তা দূর করার জন্য বারবার ধোয়া-মোছা করার প্রবণতা যেমন ওসিডি-র পূর্বাভাস হিসেবে চিহ্নিত হয়, তেমন অন্যদিকে ওসিডি-র আরেকটি লক্ষণ হল, দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে সন্দেহ দানা বাঁধা, এক কাজ বারবার করা বা তা যথাযথ হয়েছে কি না তা ক্রমাগত পরীক্ষা করা। ক্ষতিকারক বা অনিষ্টকারক এমন বিষয়ে বদ্ধমূল চিন্তাভাবনা, নিন্দাসূচক বা অপবাদমূলক, এমনকী ঈশ্বরের প্রতিও নিন্দার মনোভাব পোষণ করা, যৌনতাকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হওয়া এবং সব কিছুতেই সাযুজ্য এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য অত্যন্ত বাড়াবাড়ি রকমের চিন্তা করা প্রভৃতিও এই রোগের অন্যান্য লক্ষণ। কিছু ক্ষেত্রে ওসিডি-কে বাধ্যতামূলক কাজ বা আচরণের মাধ্যমে বিচার করা হয়ে থাকে। যেমন, ৩০ বছর বয়স্ক যুবক সতীশ (নাম পরিবর্তিত)-এর ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গিয়েছিল। একটি ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার হিসেবে সতীশের মধ্যে এমন এক সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, যার ফলে সে ব্যাঙ্কের গ্রাহক বা কাস্টমারের হাতে তাদের গচ্ছিত টাকা তুলে দেওয়ার আগে মনে করত যে সে সঠিক পরিমাণ অর্থ তাদের দিচ্ছে না। তাদের হাতে টাকা দেওয়ার আগে সতীশ এতবার সেই টাকাগুলি গুনত যে, তাতে কাস্টমাররা ভীষণ রেগে যেতেন এবং সতীশ খুব ঢিমেতালে কাজ করছে বলে চেঁচামেচি জুড়ে দিতেন। এইভাবে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার একদিন সতীশকে এই কাজে অযোগ্য বলে বিবেচনা করে অপেক্ষাকৃত কম দায়িত্বপূর্ণ জায়গায় বদলি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওসিডি-র আরেকটি দিক হল যে, সব সময়ে কুচিন্তা করা। এর থেকে মানুষের মধ্যে গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাজনিত অযৌক্তিক ভয়, এমনকী তার মৃত্যুর পরে কী ঘটবে, সেই নিয়েও মানুষের মধ্যে অলীক চিন্তা করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ফলে ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে এহেন অমূলক চিন্তা করা কখনোই শেষ হয় না। তাই স্বাভাবিকভাবে এবং স্বেচ্ছায় যখন মানুষ এই সব কুচিন্তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে সক্ষম হয় না, তখন তা মানুষকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
ওসিডি স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের থেকেও অনেক প্রচলিত একটি অসুখ এবং মোট জনসংখ্যার ১-৩ শতাংশ এই রোগে আক্রান্ত হয়। অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ওসিডি-র সমস্যা খুব ছোট আকারে দেখা দেয় এবং বেশিরভাগ সময়েই তা সঠিকভাবে চিহ্নিত হয় না। এদের মধ্যে ১ শতাংশের ক্ষেত্রে সমস্যা অত্যন্ত গুরুতর হয়ে ওঠে এবং এক সময় তা সহ্যের বাইরে চলে যায়। আবার প্রচলিত বিশ্বাস এবং ডা. রেড্ডির মত অনুযায়ী, শিশুদের মধ্যেও ওসিডি-র সমস্যা হতে পারে এবং তার প্রভাব তার যৌবনকাল পর্যন্ত স্থায়ী থাকতে পারে। শিশুদের ওসিডি নিয়ে নিমহানস্-এর বিশেষজ্ঞ ডা. জয়সূর্য টিএসটু একটি সমীক্ষা করেছিলেন। সেখানে দেখা গিয়েছিল যে, ১০০ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের মধ্যে ওসিডি-র লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা অনেক ভয়াবহ হয় কারণ, তারা বুঝতেই পারে না যে তাদের কী হয়েছে। তাদের মাথায় সব অবাস্তব চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খায়। আর সেগুলি তারা অন্য কাউকে বলতেও পারে না। কিন্তু আশার কথা এই যে, চিকিৎসার সাহায্যে ওসিডি সেরে যায়। ডা. রেড্ডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিমহানস্-এ চিকিৎসারত প্রায় ৭০ শতাংশ ওসিডি রুগির অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এদের মধ্যে অর্ধেকেরই সমস্যা তেমন বড় ছিল না এবং চিকিৎসার পরে তারা পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়েছে। বদ্ধমূল চিন্তাভাবনা প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কগনিটিভ বিহেভায়রল থেরাপির সাহায্য নেওয়া হয় এবং ব্যক্তির আচরণে পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। গুরুতর ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। যদি কোনও কারণে অসুখ সারার আগে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে তার ক্ষেত্রে ওসিডি আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে তাকে চিকিৎসাধীন থাকতে হতে পারে।
যাইহোক, সমাজের চোখে এহেন মানসিক অসুখকে তেমন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এটিকে খুব হালকাভাবে দেখা হয়। এই রোগের বহুল প্রচলনের ফলে এখন অসুখটি তার প্রকৃত গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। আমরা যদি জামাকাপড়গুলি খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ভাবে পরতে চাই, তাহলে আমরা নিজেকে ওসিডি-তে আক্রান্ত বলে ভাবতে থাকি। কিন্তু আসল সত্য হল, আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করি। তাই পরিষ্কার জামাকাপড় গায়ে দিই। যদি জামাকাপড় টিপটপ থাকে, তাহলে আমাদের মধ্যে একধরনের সন্তুষ্টি দেখা যায়। জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও অনেক সময় এমন ঘটে। ওসিডি-তে আক্রান্ত একজন ব্যক্তির জীবন কতগুলি বদ্ধমূল ধারণায় পরিপূর্ণ থাকে এবং সেই চিন্তার বশবর্তী হয়েই সে তার প্রাত্যহিক জীবনযাপন করে থাকে। ওসিডি-তে ভুক্তভোগী একজন মানুষ সেই চিন্তার দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয় যে, এক কাজ বারবার করে করা শুরু করে। কিন্তু, তাতে তার কোনও আনন্দ বা সন্তুষ্টি লক্ষ্য করা যায় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী, ওসিডি খুবই মারাত্মক একটি রোগ এবং পৃথিবীর দশটা রোগের মধ্য এর স্থান তৃতীয়। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে রোজগার করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। ফলে জীবনযাত্রার মানের অবনতি হয়। এমনকী, ওসিডি মানুষকে এতটাই যন্ত্রণা দেয় যে, তার ফলে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা বা প্রবণতার জন্ম হয়।
ওসিডি-র মতো ব্যক্তিত্বের বিকারজনিত সমস্যা বা মানুষের মধ্যে জেগে ওঠা অদ্ভুত সব মুদ্রাদোষজনিত অব্যবস্থাকে আমাদের অচিরেই বন্ধ করার সময় হয়ে গিয়েছে। ওসিডি-র মতো মানসিক রোগ একজন ব্যক্তির শরীর ও মনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। তাই আমরা সমবেতভাবে আমাদের শুভবুদ্ধি এবং সহানুভূতির দ্বারা যদি এই অসুখটিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা না করি, তাহলে মানুষের জীবনের গতি, ছন্দ প্রভৃতি একেবারে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।
এখানে ওসিডি সম্পর্কে সঠিক ধারণার জন্য কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করা হল—