পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার কি?
কোন ভয়াবহ অঘটনের অভিজ্ঞতা বা কোন দুর্ঘটনা, যেমন শারীরিক বা যৌন নির্যাতন, মারাত্মক দুর্ঘটনা, সামরিক সংঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প বা সুনামির প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তির মনে সেই ঘটনা সংক্রান্ত স্মৃতি ভয় আর উদ্বেগের সঞ্চার করতে পারে। সময় আর উপচর্যায় অনেকেই সুস্থ হয়ে ওঠেন, দুর্ঘটনা সংক্রান্ত উদ্বেগ কমে যায়, এবং তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন।
কিছু ব্যক্তির মধ্যে অবশ্য সময়ের সাথে সাথে এই স্মৃতির ভয়াবহতা বাড়তেই থাকে। তাঁদের মনের মধ্যে দুর্ঘটনার দৃশ্যগুলোর পুনরাবৃত্তি বারবার হতেই থাকে এবং এর ফলে তাঁরা আতঙ্কিত আর উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাকে পোস্ট ট্রম্যেটিক স্ট্রেস ডিস্অর্ডার বলা হয়। যেমন ধরুন মারাত্মক কোন দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির মনে বারবার সেই দুর্ঘটনার ছবি ভেসে উঠতে পারে। সেই সময় তাঁর অনুভূতিগুলো এত প্রবল হয়ে ওঠে যেন দুর্ঘটনাটি আবার ঘটছে এবং তিনি ভয়-ভিত আর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
পোস্ট ট্রম্যেটিক স্ট্রেস ডিস্অর্ডারের উপসর্গ কি?
পি টি এস ডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড ভয় আর উদ্বেগ অনুভব করেন। পি টি এস ডি-র কিছু সাধারণ উপসর্গ হল:
ঘটনার আবেগপূর্ণ পুনরাবৃত্তি: আক্রান্ত ব্যক্তি ঘটনাটি কে নিয়ে বারবার দুঃস্বপ্ন দেখেন আর প্রায়ই জাগা অবস্থায় ঘটনাচক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখেন। এর ফলে ব্যক্তি প্রতিবার সেই তীব্র মানসিক আঘাত আর ভয় অনুভব করেন যা ঘটনা ঘটার সময় অনুভব করেছিলেন। ব্যক্তির নানা ধরনের শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, গা গোলানো ভাব আর আতঙ্কিত হয়ে পড়া।
এড়িয়ে চলা: আক্রান্ত ব্যক্তি এমন সব আলোচনা, স্থান এবং পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন যা সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে পারে।
সব সময় সতর্ক থাকা: আক্রান্ত ব্যক্তি সব সময় সতর্ক থাকেন আর সুরক্ষিত পরিবেশেও বিপদের আশঙ্কা নিয়ে ভয়-ভিত হয়ে থাকেন। ওনার ঘুমোতে অসুবিধে হয় এবং চমকে চমকে ওঠেন।
অনুভূতিহীন হয়ে পড়া: আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের প্রতি আবেগ অনুভব করেন না এবং ক্রমশ বিনোদন কাজে আনন্দ উপভোগ করেন না।
পি টি এস ডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে অন্যান্য মানসিক সমস্যা, যেমন অবসাদ, তীব্র উদ্বেগ, মাদক আসক্তি বা অন্য ধরনের নেশা করা, বা আত্মহত্যার চিন্তা দেখা দিতে পারে। আপনার পরিচিত কোন ব্যক্তির মধ্যে যদি এইধরনের কোন উপসর্গ লক্ষ্য করেন তাহলে তাঁর সাথে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করুন এবং তাঁকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞয়ের পরামর্শ নিতে বলুন।
পি টি এস ডি হওয়ার কারণ কি?
এমন কেউ যে কোন ধরনের জীবন বিপন্ন-কারী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন বা শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা কাউকে হতে দেখেছেন, তাঁর পি টি এস ডি হতে পারে। জন্মকাল থেকে ডিপ্রেশন বা এংজাইটি ডিস্অর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পি টি এস ডি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কতটা সময় ধরে এবং তার প্রকোপের তীব্রতা নির্ধারণ করে মানসিক আঘাতের স্থায়িত্ব। কোন এক বিশেষ কারণেই যে পি টি এস ডি হয় এমন নয়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি-বিশেষের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে কোন ব্যক্তির ওপর দুর্ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
পি টি এস ডি-র চিকিৎসা
কোন বড় ধরনের অঘটনের পর যে কোন ব্যক্তির পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে। কিন্তু সময় এবং পরিবার আর বন্ধুদের সেবা আর সহযোগিতায় অনেকেই এই মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। যদি কেউ এই মানসিক আঘাত কাটিয়ে না উঠতে পারেন বা সময়ের সাথে সাথে উপসর্গগুলো আরও গুরুতর হয়ে ওঠে, তাহলে দেরি না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞয়ের সাথে দেখা করা উচিৎ। পি টি এস ডি-র চিকিৎসা মূলত থেরাপির সাহায্যে করা হয় যার মধ্যে কগ্নিটিভ বিহেভেরিয়াল থেরাপি (সি বি টি) আর এক্সপোজার থেরাপি বিশেষ ভাবে উপকারী। এক্সপোসার থেরাপি-তে রোগীকে দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত নিজের সমস্ত চিন্তাভাবনা এবং স্মৃতির সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষত সেই স্মৃতি বা ঘটনাচক্রগুলো যা উনি এড়িয়ে যেতে চাইছেন। বারবার ঐ স্মৃতিগুলো নিয়ে আলোচনা করলে রোগীর ভিতি আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি এবং অনিদ্রার জন্য চিকিৎসক ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
পি টি এস ডি রোগীর পরিচর্যা
পি টি এস ডি রোগীর সব থেকে বেশি প্রয়োজন তাঁর আশেপাশের মানুষের সহযোগিতা আর ধৈর্যপূর্ণ ব্যবহারের। আপনাকে বুঝে নিতে হবে যে সমাজ এবং আবেগের থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখা পি টি এস ডি-র সব থেকে বড় লক্ষণ। এমন নয় যে রোগী ইচ্ছে করে আপনাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখছেন। পি টি এস ডি সম্বন্ধে বিষদে জানুন যাতে আপনি রোগীর মানসিক স্থিতি বুঝতে পারেন। রোগীর সাথে মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীর কাছে যাওয়ার প্রস্তাব রাখুন। এতে তাঁর প্রতি আপনার দায়িত্ববোধ এবং রোগ মোকাবিলায় সমর্থন প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে আপনি পি টি এস ডি-র বিষয়ে আরও ভালভাবে জানতে পারবেন। আপনার উচিৎ রোগীর চিকিৎসা করানো এবং তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় উৎসাহিত করা। শুধু খেয়াল রাখবেন যে আপনার ব্যবহারে রোগী যেন কখনো বিরক্ত না বোধ করেন।
পি টি এস ডি-র সঙ্গে মোকাবিলা
যদি ওপরে দেওয়া বর্ণনার সাথে আপনি নিজের মিল খুঁজে পান তাহলে দেরি না করে অবিলম্বে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করুন। যত তাড়াতাড়ি আপনার চিকিৎসা আরম্ভ হবে তত বেশি সম্পূর্ণ রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা। নিজের বিশ্বস্ত প্রিয়জনদের সাথে আর একইধরনের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলুন। ওদের সাথে আলোচনা আপনাকে মানসিক আঘাত থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে। সুস্বাস্থ্যের জন্য নিয়ম মেনে পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া করা, পরিযাপ্ত সময় ধরে ঘুমানো, নিয়মিত ব্যায়াম করা আপনাকে উদ্বেগমুক্ত রাখতে সাহায্য করবে।