স্কিৎজোফ্রেনিয়া কী?
স্কিৎজোফ্রেনিয়া এক মারাত্মক মানসিক ব্যাধি যা হলে পরে বিভিন্ন অস্বাভাবিক আচরণ যেমন, কাল্পনিক দৃশ্য দেখা বা আওয়াজ শুনতে পাওয়া বা মনে অদ্ভুত ধারণা ও বিশ্বাস জন্মানো দেখতে পাওয়া যায়। যার সাথে এগুলি হচ্ছে তিনি সবকিছু সত্যি মনে করলেও তাঁর আশেপাশের লোকরা বুঝতে পারেন না।
এই রোগের কারণে ব্যক্তি মনে করেন যে অন্যরা তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন। তাঁর ফল স্বরূপ তাঁরা এমন অনেক কিছুই করেন যা অন্যদের অস্বাভাবিক মনে হয়।
সমস্যা হল এগুলো যে অস্বাভাবিক তা ব্যক্তি নিজে বুঝতে পারেন না। তাঁর কারণ বাস্তব এবং কল্পনার জগৎ আর স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক আচরণের মধ্যেকার গণ্ডী তাঁদের কাছে ভীষণই ঝাপসা। ফলে তাঁদের চিকিৎসা করাতে গিয়েও বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
কোনটি স্কিৎজোফ্রেনিয়া নয়?
স্কিৎজোফ্রেনিয়ার নাম শুনলেই আমরা কল্পনা করে নেই উস্কো-খুস্কো চুল আর ছেঁড়া জামা পড়া এক অস্বাভাবিক এবং হিংস্র মূর্তি যে প্রেতাত্মা বা গ্রহান্তরের প্রাণীদের সাথে কথা বলে। আমরা সিনেমায় দেখেছি যে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীরা হয় মারমুখি উন্মাদ নয়তো খামখেয়ালী বৈজ্ঞানিক হন যাদের পাগলা গারদে আটকে রাখতে হয়।
বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু অনেকটাই আলাদা।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া কেন হয়?
কিশোর বয়স থেকে শুরু করে যৌবনের গোড়ার দিকে অবধি এই রোগ থাবা বসিয়ে দেয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে আস্তে আস্তে এই রোগ নিঃশব্দে বাড়তে থাকে। রোগের গোড়ার দিকের উপসর্গগুলি অন্যান্য মানসিক রোগের সাথে মিলতে পারে। রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সবাইকে এড়িয়ে চলা বা দৈনন্দিন কাজকর্মে অনীহার মত বিভিন্ন নেতিবাচক মানসিকতা লক্ষ করা যায়। অস্বাভাবিক এবং খামখেয়ালী আচরণ যেমন একলা একলা হাসাও লক্ষ করা যেতে পারে। সঠিক সময় চিকিৎসা না শুরু হলে ব্যক্তি আরও হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন। গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ১% এই রোগের শিকার হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের ছেলে বা মেয়ে দুজনেরই এই রোগ হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখনো এই রোগের সঠিক কারণ বের করতে পারেননি। তবে বিভিন্ন গবেষণায় এটা দেখা গেছে যে মস্তিষ্কের গঠনগত নানারকম সমস্যার জন্যে এই রোগ হয়ে থাকে। নিম্নলিখিত কারণগুলিও এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়ঃ
জিনগত কারণ
মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক পদার্থের তারতম্য
গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনও গুরুতর অসুখ বা শরীরে পুষ্টির অভাবের জন্য শিশুর এই রোগ হতে পারে।
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং অত্যাধিক মদ এবং অন্যান্য মাদক দ্রব্যের সেবন।
স্কিৎজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ কী?
অনির্দিষ্ট উপসর্গগুলিতে তারতম্যের কারণে একজন স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগী কিন্তু সবসময় অস্বাভাবিক আচার আচরণ করেন না। এই রোগের প্রধান উপসর্গগুলি হলঃ
বিভ্রম: অবাস্তব দৃশ্য, শব্দ, স্পর্শ, স্বাদ বা গন্ধের অনুভূতি।
ভ্রান্ত কল্পনা: নিজেকে তারকা মনে করা বা অকারণ সন্দেহপ্রবণ যেমন খাবারে বিষ থাকার ভয় বা টিভির অনুষ্ঠানকে সাংকেতিক বার্তালাপ মনে করার মত ভ্রান্ত কাল্পনিক ধারণা।
অগোছালো মানসিকতা: অযৌক্তিক এবং অস্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা এবং কথাবার্তা।
মনোযোগের অভাব: মনোযোগ দিয়ে কোনও কাজ শিখতে, করতে বা মনে রাখতে না পারা।
নিজেকে গুটিয়ে নেয়া: লোকসঙ্গ এড়িয়ে চলা।
সাইকোসিস বা সাইকোটিক এপিসোড কী?
সাইকোসিস এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি বাস্তব ও কল্পনার মাঝখানে গুলিয়ে ফেলেন যার বহুবিদ মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলস্বরুপ ব্যক্তির আচার আচরণে মারাত্মক পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়।
সাইকোটিক এপিসোডে ব্যক্তি চূড়ান্ত দৃষ্টিবিভ্রম এবং শ্রুতি বিভ্রমের শিকার হন। ফলে ব্যক্তি অত্যন্ত হিংস্র মানসিকতার অধিকারী হন। সেইক্ষেত্রে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাসপাতালে ভর্তি করা যেতে পারে।
রোগ নির্ণয়ের উপায়
এই রোগ নির্ণয়ের কোনও নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। সংশ্লিষ্ট মনোবিদ ব্যক্তির আচরণ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পর মতামত দেন। তাঁর সম্বন্ধে আরও জানতে তিনি বাড়ির লোক বা বন্ধুবান্ধবদের সাথেও কথা বলতে পারেন।
আপনার পরিচিত কারোর মধ্যে যদি উক্ত উপসর্গগুলি দীর্ঘ সময় (অন্তত এক মাস) ধরে লক্ষ করেন তবে অবিলম্বে একজন অভিজ্ঞ মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। একমাত্র তিনিই সঠিক রোগনির্নয় করতে পারবেন।
স্কিৎজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা
স্কিৎজোফ্রেনিয়া একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব না। কিন্তু সঠিক চিকিৎসার সাহায্যে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফেরা সম্ভব। চিকিৎসার উদ্দেশ্য উপসর্গ কমানো নয়, বরং ব্যক্তিকে এই রোগ নিয়ে বাঁচতে শেখানো।
রিচমন্ড ফেলোশিপ সোসাইটির ব্যাঙ্গালোর শাখার সিইও এবং এমডি ডাঃ এস কল্যাণসুন্দরম বলছেন, “হিসেব মত এক তৃতীয়াংশ স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফেরেন। এক তৃতীয়াংশ মোটামুটি সন্তোষজনক জীবন কাটান। বাকি এক তৃতীয়াংশ প্রায় অন্যের ওপর নির্ভরশীল জীবন কাটান। এটা পুরোটাই নির্ভর করছে কবে রোগ ধরা পড়ছে তার ওপর। যত তাড়াতাড়ি রোগ ধরা পড়বে তত বেশী সেরে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে।”
অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগ এবং ইলেকট্রো কনভালসিভ থেরাপি
কেআইএমএস, ব্যাঙ্গালোরের অধ্যাপক ডাঃ লক্ষ্মী ভি পণ্ডিতের মতে, “অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগ নিয়ে আমাদের মনে অনেক ভুল ধারনা আছে। যেকোনও ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এখনকার অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগে বলতে গেলে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকেই না। মাঝে মধ্যে হাত-পা কাঁপা বা শক্ত হয়ে যাওয়া হতে পারে। আমরা প্রয়োজন ছাড়া ওষুধ দেই না। আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেও জানি।”
উনি আরও জানালেন, “অনেকেই জানেন না যে ইলেকট্রো কনভালসিভ থেরাপি বা ইসিটি ও অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে করানো এক নিরাপদ চিকিৎসার উপায়। রোগের মারাত্মক পর্যায়ে যখন ওষুধে কাজ হয় না তখন অ্যানাস্থেশিয়ার সাহায্যে মৃদু বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। এতে উপসর্গও কমে এবং রোগীর কোনও অসুবিধাও হয় না।”
রোগীর যত্ন নেওয়া এবং বাড়ির লোকের পাশে দাঁড়ানোটাও কিন্তু এই রোগের চিকিৎসার একটা অঙ্গ।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীর যত্ন নেওয়া
একজন স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীর যত্ন নেওয়া খুবই কঠিন। নিজের প্রিয়জনের এই রকম অবস্থা দেখে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক বাবা-মায়েরই মনে হয়, “আমি কেন? কী অপরাধ করেছিলাম আমি?”
আপনার প্রিয়জনের যদি স্কিৎজোফ্রেনিয়া থাকে তবে ডাক্তারের কাছে কিছু লোকাবেন না। যদি আপনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তাহলে আপনিও কাউন্সেলিং এর সাহায্য নিন। আপনি নিজেকে না সামলালে আপনার প্রিয়জনকে সামলাবে কে?
সজ্ঞ্যানে হোক বা অজ্ঞ্যানে, একজন স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগী কিন্তু আপনাদের ব্যবহার সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন হন। সুতরাং আপনার ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে যে উনি কতটা তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন।
রোগীর সাহায্যার্থে আপনি নিম্নলিখিত কাজগুলি করতে পারেন।
তাঁদের মানসিক বিভ্রম সম্বন্ধে জানতে চান।
বোঝার চেষ্টা করুন যে ঘটনাগুলো তাঁদের জন্য সত্যি এবং অস্বস্তিকর।
চিকিৎসাজনিত সিদ্ধান্ত নিতে তাঁকে সাহায্য করুন।
উপসর্গের একটা তালিকা বানান। কারণ রোগী নিজে থেকে চিকিৎসককে সব গুছিয়ে নাও বলতে পারেন।
চিকিৎসার পরেও উপসর্গের পুনরাবৃত্তি ঘটছে কি না লক্ষ রাখুন। অবস্থা বুঝে সঠিক সময় ডাক্তারকে কে জানান।
পরিবারের বাকি সদস্যদের বোঝানোর দায়িত্ব কিন্তু আপনারই।
নিজের স্বাস্থ্যেরও যত্ন নিন।