সম্প্রতি নিমহ্যান্সের নেতৃত্বে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ের উপর যে সমীক্ষা করা হয়েছে তাতে ভারতে আসক্তিজনিত সমস্যার পরিমাণগত কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। এই সমীক্ষায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রকাশ পেয়েছে:
পাঁচজন মানুষের মধ্যে কমপক্ষে একজন বিভিন্ন ধরনের মাদক দ্রব্যে (অ্যালকোহল, তামাকজাত বস্তু বা ড্রাগ)-র প্রতি আসক্ত (শতাংশের হিসেবে তার পরিমাণ হল ২২.৪)
পাঁচজনের মধ্যে নিদেনপক্ষে একজন তামাক ও সিগারেটের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল (শতাংশের হিসেবে তার পরিমাণ হল ২০)
কুড়িজনের মধ্যে অন্তত একজন মানুষ মদ্যপানের প্রতি আসক্ত (শতাংশের হিসেবে তার পরিমাণ হল ৪.৬)
যেসব মানুষ মদ্যপান করে তাদের ১০০জনের মধ্যে মাত্র তিনজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য চায়। অর্থাৎ, বাকি ৯৭ শতাংশ মানুষ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে কোনও সহায়তাই পায় না।
কেন এত অল্প সংখ্যক মানুষ বিশেষজ্ঞের সাহায্য চায়?
প্রথম প্রতিবন্ধকতা- অধিকাংশ মানুষ এটাই বোঝে না যে অ্যালকোহল ব্যবহার এমন একটা সমস্যা যা সমাধানের জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আসক্তিকে বেশিরভাগ মানুষ নৈতিক সমস্যা বলে ভাবে (যেমন- ''মদ্যপান খুব বাজে অভ্যাস'') অথবা খারাপ রুচি বলে মনে করে (যেমন- ''আপনার প্রয়োজন শুধু স্থির থাকা'')
বাস্তব ঘটনা হল- আসক্তির পিছনে থাকে জিনগত ত্রুটি,ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা এবং সামাজিক প্রভাব। এর পিছনে ইচ্ছাশক্তির ভূমিকা থাকে অত্যন্ত কম।
দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা- অধিকাংশ মানুষই তাদের শারীরিক সমস্যার সঙ্গে সিগারেট খাওয়া, মদ্যপান বা ড্রাগ নেওয়ার অভ্যাসের যোগসূত্র বুঝতে পারে না। এজন্য তারা সাধারণ ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রায়শই এসব ক্ষেত্রে মানুষ তার এলাকার প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেন্দ্রে যায়। সেখানে তারা তাদের নানারকম সমস্যার অভিযোগ জানায়, যেমন- তাদের ঘুম না হওয়ার সমস্যা, বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দুর্বলতা, খিদে না পাওয়া, মাথাব্যথা প্রভৃতি। আবার কয়েকজন মানুষ বিশেষজ্ঞের কাছে উচ্চ বা নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা বা গ্যাসট্রিকের সমস্যা নিয়ে যায়।
বাস্তব কী ঘটে- প্রায়শই সাধারণ চিকিৎসক এবং নার্স রুগিকে তার জীবনযাত্রাজনিত অভ্যাসগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে না। ডাক্তাররা লক্ষণগুলোর উপর আলোকপাত করলেও তার কারণগুলোর বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকে না, অর্থাৎ, অ্যালকোহল বা সিগারেটের ব্যবহারের বিষয় তাদের জানা থাকলেও রুগির যে আসক্তিজনিত সমস্যা রয়েছে এই পর্বে ডাক্তাররা তা নির্ধারণ করতে পারে না। এই সমস্যা নির্ধারণ করার জন্য সিএজিই (CAGE) বা এমএএসটি (MAST)-র নামক পরীক্ষার দরকার হয়।
যদি আপনি বা আপনারা দেখেন যে অ্যালকোহল, সিগারেট বা তামাকের প্রতি আপনাদের আসক্তি বাড়ছে তাহলে সেইসব অভ্যাসগুলোকে ত্যাগ করার চেষ্টা করা জরুরি। যদি আপনি তা নিজে থেকে করতে না পারেন তাহলে একজন বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন।
তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা- যখন রুগিরা আসক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য ডাক্তারের কাছে যায় তখন তারা ডাক্তারের কাছে থেকে কোনও বিজ্ঞানসম্মত সহায়তা পায় না। ডাক্তাররা প্রায়শই সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হয় না। তারা রুগিকে অ্যালকোহল বা তামাক ব্যবহার বন্ধ করার পরামর্শ দেয়, কিন্তু এবিষয়ে রুগিকে সাহায্য করার জন্য ডাক্তার কিছুই করে না।
এক্ষেত্রে কার্যকরী চিকিৎসা বলতে কী বোঝায়- কার্যকরী চিকিৎসার অর্থ হল রোগের সঠিক চিহ্নিতকরণ, নেশার বস্তুর ব্যবহার বন্ধ করার জন্য রুগিকে সাহায্য করা। এক্ষেত্রে তাদের বোঝাতে হবে যে কেন সেই অভ্যাস ছাড়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আসক্তি কাটাতে গিয়ে একজন মানুষকে কীভাবে বাধার মোকাবিলা করতে হয় তা বোঝানোও জরুরি। যেমন- কীভাবে সে নেশার বস্তুর ব্যবহার কমাবে, এর ফলে তার যে সমস্যা হবে সেই সমস্যা সে কীভাবে মোকাবিলা করবে, কীভাবে কাছের মানুষ ও সামাজিক চাপের মোকাবিলা করবে প্রভৃতি। আসক্তি ত্যাগ করার লক্ষণগুলোর চিকিৎসাও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আসক্তির বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে, কীভাবে রোগ নির্ণয় করা হবে এবং কীভাবে তার চিকিৎসা হবে সেক্ষেত্রে একজন সাধারণ ডাক্তারের যথেষ্ঠ দায়িত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
চতুর্থ প্রতিবন্ধকতা- ভারতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এমন প্রতিষ্ঠান খুব কমই রয়েছে যেখানে বিশেষভাবে আসক্তিজনিত সমস্যার চিকিৎসা হয়। আবার পুনর্বাসন কেন্দ্র কিছু থাকলেও তাদের মধ্যে কয়েকটি খুবই ব্যয়বহুল, কোনওটি আবার যথাযথ নয়, এমনকী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার লঙ্ঘনও করে।
আমাদের কী প্রয়োজন- সুরক্ষা কেন্দ্রগুলোতে পুনর্বাসন বা দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার ব্যবস্থা করাই যথেষ্ঠ নয়। আসলে এগুলোই যে সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়, তা নয়। দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা কেন্দ্রগুলোতে মানুষের অ্যালকোহল ও আসক্তিজনিত সমস্যা নির্ণয় করে তার সঠিক সমাধানের ব্যবস্থা করাই কার্যকরী চিকিৎসার অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে।
কীভাবে এই শূন্যস্থান আমরা ভরাট করতে পারব?
কীভাবে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সে বিষয়ে নিমহ্যান্সের বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হল-
১. জনসচেতনতা বাড়ানো- আসক্তি যে একপ্রকার লাগাতার মস্তিষ্কের অসুখ, কোনও নৈতিক সমস্যা নয়, সে বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। কত পরিমাণ অ্যালকোহল, তামাক বা ড্রাগের ব্যবহার একজন মানুষের পক্ষে যথাযথ এবং কখন এগুলোর ব্যবহার সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, তা মানুষকে বোঝাতে হবে।
২. প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা- রুগির আসক্তিগত সমস্যা নির্ধারণ করার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাধারণ ডাক্তার, নার্স ও কর্মীদের উপযোগী ও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। রুগিকে কার্যকরী চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন-
মানুষ চিকিৎসার দ্বারস্থ হোক বা না হোক তাদের নিয়মিত তামাক বা অ্যালকোহলের ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।
তাদের শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে তাদের শারীরিক ও আচরণগত সমস্যার মূলে রয়েছে আসক্তির প্রভাব।
সাধ্যমতো তাদের চিকিৎসা করতে হবে বা প্রয়োজন পড়লে তাদের বিশেষ সুরক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার সুপারিশ করতে হবে।
এজন্য ডাক্তার এবং নার্সদের জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রমের মধ্যে আসক্তির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৩. লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে- এখানে সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য সঠিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। সেই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও সাহায্য করতে হবে। এর ফলে মানুষ বুঝতে পারবে যে কোথায় গেলে সে সাহায্য পাবে ও নিরাপদ থাকবে এবং বিপদসীমা অতিক্রম করার আগেই তারা বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হবে।
কিন্তু এই বিষয়টা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
যারা অ্যালকোহল বা তামাক ব্যবহার করে তাদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-
শ্রেণি ১- যারা মাঝে মাঝে এগুলো ব্যবহার করে।
শ্রেণি ২- যারা নিয়মিত ব্যবহার করে কিন্তু তাদের মানসিক ও চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয় না।
শ্রেণি ৩- এগুলো ব্যবহারের ফলে যাদের মধ্যে গভীর সমস্যার লক্ষণ ফুটে ওঠে।
তৃতীয় শ্রেণির মানুষ, যারা আসক্তির সমস্যা ছাড়াও অন্যান্য কিছু সমস্যার জন্য বিশেষজ্ঞের কাছে যায়। সেই সমস্যাগুলো হল- পরিপাকতন্ত্র বা গ্যাসট্রোইনটেস্টিনাল সমস্যা, হিংসা বা দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়া এবং লিভারের সমস্যা। এই পর্যায়ের চিকিৎসা খুব একটা সুলভ হয় না। এই চিকিৎসায় অনেক টাকা ও সময় ব্যয় হয়।
দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষরাই আসক্তির সমস্যার ক্ষেত্রে সংখ্যাগোরিষ্ঠ। কারণ এদের চিকিৎসা সংক্রান্ত ও মানসিক জটিলতা থাকে না। তাই তাদের সাহায্যের বড় একটা প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই শ্রেণির মানুষ সময়মতো চিকিৎসা করালে উপকৃত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে তারা সুফল পায়।
একজন মানুষ অ্যালকোহল বা তামাক সেবন শুরু করার ১০ থেকে ১৫ বছর পরে সেগুলোর প্রতি আসক্ত হয়। চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে যদি মানুষ চিকিৎসার দ্বারস্থ হয় তাহলে তার জীবনের ঝুঁকি কম থাকে, চিকিৎসার খরচ কম হয় এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতিও অল্প হয়।