বিকার

স্লিপ অ্যাপ্নিয়া

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

স্লিপ অ্যাপ্নিয়া কী?

স্লিপ অ্যাপ্নিয়া একধরনের নিদ্রা বিকার। ঘুমের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য রোগীর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায় আবার স্বাভাবিক শ্বাস প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। স্লিপ অ্যাপ্নিয়া দু ধরনের হয়।

অব্সট্রাক্‌টিভ স্লিপ অ্যাপ্নিয়া (ও এস এ) – ঘুমের মধ্যে শ্বাসনালী রুদ্ধ হয়ে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বিঘ্নিত হয় আর রোগী নাক ডাকতে শুরু করেন । ও এস এ স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার সব থেকে সাধারণ ধরন।

সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপ্নিয়া (সি এস এ) – মস্তিষ্ক থেকে যথাযথ সংকেত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সঞ্চালনা করা মাংসপেশী অবধি পৌঁছায় না, ফলে শ্বাস প্রক্রিয়া আটকে যায়।

ও এস এ –তে ভোগা বেশি সংখ্যক ব্যক্তি নিজের সমস্যা বুঝতে পারেন না যেহেতু ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরলেই নাক ডাকা বন্ধ হয়ে যায় আর শ্বাস প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়ে যায়। সি এস এ –তে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ঘুম থেকে চমকে ওঠেন। এই ধরনের ঘটনার সময় রোগী ঘুম থেকে জেগে ওঠেন আর সচেতন হয়ে পড়েন।

খেয়াল রাখবেন যে সব ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে নাক ডাকেন, তাঁরাই স্লিপ অ্যাপ্নিয়া তে ভোগেন না। আবার অনেক স্লিপ অ্যপ্নিয়া রোগী নাক ডাকেন না। স্লিপ অ্যাপ্নিয়া একটি গম্ভীর সমস্যা কিন্তু চিকিৎসার সাহায্যে এর নিরাময় সম্ভব। 

স্লিপ অ্যপ্নিয়ার উপসর্গ

স্লিপ অ্যাপ্নিয়ায় আক্রান্ত কোন ব্যক্তির পক্ষে নিজের সমস্যা বুঝে রোগ নির্ধারণ করা সম্ভব না যেহেতু স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার বেশির ভাগ উপসর্গ ঘুমের মধ্যে ঘটে।

স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার কিছু সাধারণ লক্ষণ –

  • দিনের বেলা অতিরিক্ত ঝিমুনি ভাব – রাতে ভালো ঘুম হওয়া সত্যেও যদি দীর্ঘ সময় ধরে আপনার দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঝিমুনি ভাব হয়, হয়ত আপনার ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হচ্ছে যা আপনি বুঝতে পারছেন না।

  • ঘুমের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ ভাব – ঘুমের মধ্যে দমবন্ধ লাগা বা যদি আপনার পাশে শোওয়া ব্যক্তি আপনাকে বলেন যে ঘুমের মধ্যে আপনি বারবার চমকে ওঠেন।

  • সকালে মাথা ব্যথা আর ঠোঁট ও জিভে শুষ্কতা – ঘুম থেকে উঠে যদি আপনার প্রায়ই মাথা ব্যথা করে, ঠোঁট আর জিভে শুষ্কতা অনুভব করেন বা গলায় ব্যথা হয়, হয়ত ঘুমের মধ্যে আপনার শ্বাস প্রক্রিয়া ব্যাধিত হচ্ছে।

  • জোরে নাক ডাকা – আপনাকে বলা হয় যে আপনি ঘুমের মধ্যে খুব জোরে নাক ডাকেন।

  • খিটখিটে আর বদমেজাজি হয়ে যাওয়া – ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় আপনি খিটখিটে আর বদমেজাজি হয়ে যাচ্ছেন।

আপনার পরিচিত মহলে যদি এমন কেউ থাকেন যিনি সজোরে নাক ডাকেন বা ওনাকে ঘুমের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ হতে লক্ষ্য করেছেন তাহলে ওনার সাথে স্লিপ অ্যাপ্নিয়া সম্বন্ধে আলোচনা করুন এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলুন।

স্লিপ অ্যাপ্নিয়া হওয়ার কারণ

স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার বেশীরভাগ রোগী ও এস এ–তে ভোগেন। ও এস এ–তে শ্বাসনালীর উপরের অংসের মাংসপেশি শিথিল হয়ে জিভ গলার দিকে গড়িয়ে যায় যার ফলে প্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি হয়। গলার পেছনের ভাগের টিস্যুর (কলা) কম্পনের জন্য ব্যক্তি নাক ডাকতে আরম্ভ করেন। শ্বাসনালীর ভেতর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়ে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায় আর রোগীর ঘুম ভেঙ্গে যায়।

গলার চারপাশে অতিরিক্ত চর্বি জমা ব্যক্তিদের মধ্যে ও এস এ-র প্রবণতা বেশি। উচ্চ রক্তচাপ, শরীরে বাড়তি মেদ, ধূমপান করলে আর বার্ধক্যজনিত কারণে ও এস এ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ও এস এ-র তুলনায় সি এস এ-তে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা অনেক কম। সি এস এ বৃদ্ধ বয়েসে বেশি হয়। এর অন্যান্য কারণ হল হৃদরোগ, স্ট্রোক আর কিছু স্নায়বিক রোগ। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য সি এস এ রোগীরা নিজেদের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। 

স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার চিকিৎসা

সমস্যা গুরুতর না হলে চিকিৎসকরা জীবন শৈলীতে কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। যেমন, শরীরের বাড়তি মেদ কমানো, ধূমপান না করা, মদের সেবন না করা ইত্যাদি। যে রোগীরা চিত হয়ে ঘুমন, তাঁদের পাশ ফিরে শোওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সমস্যা গুরুতর হলে, চিকিৎসা পদ্ধতির ধরন হল –

  • কন্টিনুয়াস পসিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার (সিপ্যাপ)- এই পদ্ধতিতে রোগীকে বিশেষ ধরনের মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হয় যার মাধ্যমে ক্রমাগত হালকা হাওয়ার ধারা শ্বাসনালীতে চলাচল করে, শ্বাসনালীকে রুদ্ধ হতে দেয় না আর শ্বাস প্রক্রিয়া সারারাত স্বাভাবিক থাকে। এই পদ্ধতিতে ভালো ফল পাওয়া যায়, যদিও প্রথমদিকে মুখোশ পরে ঘুমোতে রোগীর অসুবিধে হতে পারে।

  • ওরাল এপ্লায়েন্স (মৌখিক যন্ত্র)– দাঁতের আঁকার ঠিক করার জন্য ব্যবহৃত ব্রেসের মতো দেখতে একধরনের সরঞ্জাম মুখের মধ্যে লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে জিভ নিজের স্থানে আটকে থাকে আর চোয়াল সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

  • শল্য চিকিৎসা – শল্য চিকিৎসার সাহায্যে গলার পেছনের টিস্যুর কিছু অংশ বা পুরোটাই বাদ দিয়ে দেওয়া হয় যাতে শ্বাসনালী রুদ্ধ না হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে চোয়ালের অবস্থান সামান্য পরিবর্তন করে জিভের পেছনের ভাগে শ্বাস চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা তৈরি করা হয়।

স্লিপ অ্যাপ্নিয়া রোগীর পরিচর্যা

স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার রোগী অনেক সময় নিজের উপসর্গের কথা জানেন না যেহেতু উপসর্গ রোগী ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারেন না। পরিবারের মধ্যে যদি কাউকে নাক ডাকতে বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস রুদ্ধ হতে দেখেন বা কোন সহকর্মীকে দিনের বেলা ঝিমিয়ে থাকতে দেখেন, তাঁকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে উৎসাহিত করুন। পরিচর্যাকারী হিসেবে আপনি রোগীর সাথে তাঁর সমস্যা নিয়ে বিষদে কথা বলুন। নিদ্রা বিকারের জন্য রোগী খিটখিটে হয়ে যেতে পারেন তাই আপনাকে ওনার সাথে ধৈর্য-পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে, চিকিৎসা পদ্ধতির নিয়ম মেনে চলতে সহযোগিতা করতে হবে।

স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার সঙ্গে মোকাবিলা

স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার গুরুতর সমস্যা হয়ে আপনার কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। নিজের জীবনে সামান্য কিছু পরিবর্তন আপনাকে মানসিক চাপ-মুক্ত থাকতে সাহায্য করবে। নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামে ওজন কমে আর ও এস এ –কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ধূমপান আর মদের সেবন না করাই উচিৎ। পাশ ফিরে ঘুমানোর অভ্যাস করুন যাতে জিভ গড়িয়ে গলার দিকে না চলে যায়। এইসব জীবন শৈলী পরিবর্তন আপনাকে স্লিপ অ্যপ্নিয়ার সাথে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে, কিন্তু প্রথম পর্যায়ে নিজের সমস্ত সমস্যা চিকিৎসকের সাথে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করুন। উনি আপনাকে নিরাময়ের সঠিক পথ দেখাবেন।