এখন এখানে পরীক্ষার মরশুম। এটা আদৌ খুব সর্তকতার সঙ্গে ভাবার বিষয় নয়, কারণ প্রত্যেক বছরই এই সময়ে পরীক্ষা হয়। কিন্তু তবুও পরীক্ষা নিয়ে মানুষের মনে বাড়তি সর্তকতা থেকেই যায়। শুধু এই বছর নয়, প্রত্যেক বছরেই থাকে। এর কারণ হল, পরীক্ষার্থীর সাথে সাথে তার অভিভাবক, শিক্ষক বা আত্মীয়স্বজনের মনে পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে উদ্বিগ্ন বা উত্তেজিত হওয়া।
পরীক্ষা এমন কী বিষয়, যা নিয়ে মানুষের ভাবনাচিন্তা বা মানসিক উদ্বিগ্নতার শেষ থাকে না?
আসলে সমাজের বড় একটি অংশ, পরিবারগুলি বিশেষত ছাত্র-ছাত্রীমহল পরীক্ষাকে মানুষের মূল্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে একপ্রকার বাহ্যিক অলঙ্কার হিসেবে বিচার করে।
শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের জীবনের ভালো-মন্দ, বর্তমান-ভবিষ্যৎ প্রভৃতির চুলচেরা পরিমাপ বা বিশ্লেষণ করে। একজন ছাত্র-ছাত্রীর জীবনের সফলতা বা ব্যর্থতার মূল্যায়ন হয় পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। যদি পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থী খুব ভালো নম্বর পায়, তাহলে মনে করা হয় যে, তারা জীবনে খুব সফল হল। অথবা পরীক্ষায় ভালো নম্বর তাদের জীবনে নতুন সুযোগ লাভের সম্ভাবনা এনে দিল। আর যদি এর পরিবর্তে তারা পরীক্ষায় কম নম্বর পায়, তাহলে তারা মনে করে যে, জীবনটাই যেন ব্যর্থ হয়ে গেল। বা জীবনকে আর সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষার নম্বর একজন মানুষের জীবনের সর্বাঙ্গীণ নিয়ন্ত্রক হতে পারে না। বা নম্বরের নিরিখে মানুষের জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতার বিচার করা যায় না।
প্রথমত, সফলতার কোনও একটি সংজ্ঞা হয় না। অর্থাৎ, পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতার মূল্যায়ন কোনও একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বা চিরাচরিত প্রথা মেনে করা যায় না। প্রত্যেকের কাছেই সাফল্য বা ব্যর্থতার অর্থ আলাদা-আলাদা হয়। কিছু মানুষ ভাবে যে, তাদের জীবনের সফলতা নির্ভর করে অর্থ রোজগারের নিরিখে। আবার আর একদল মানুষের কাছে জীবনের সাফল্য বলতে বোঝায় বহু মানুষকে সেবা করা। অথবা অনেক মানুষ তার পরিবার-পরিজনদের প্রতি যত্নশীল হওয়াকে জীবনের চরম সফলতা বলে মনে করে। অর্থাৎ, সাফল্য-ব্যর্থতার প্রশ্নে প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা ধারণা থাকে। তাই কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতাকে বিচার করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, সাফল্য-ব্যর্থতা মানুষের জীবনের একটা অঙ্গ। এগুলি মানুষের উপর আরোপিত কোনও তকমা বা মোড়ক নয়। আসলে মানুষের সাফল্য বা ব্যর্থতা বোঝা যায় কোনও একটি নির্দিষ্ট কাজে তার অক্ষমতা বা সক্ষমতার নিরিখে। কিন্তু এর ফলে একজন মানুষ সামগ্রিকভাবে জীবনে সফল বা ব্যর্থ— একথা জোরের সঙ্গে বলা যায় না। তাই কেবলমাত্র পরীক্ষায় ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করতে পারলেই কেউ জীবনে সাংঘাতিক সফল হল— সে কথার আদৌ কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। ঠিক একইভাবে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া মানে জীবনে আর কিছু হল না— এমন ভাবার কোনও যুক্তি নেই। একটু অন্যভাবে বলা যায় যে, কোনও কাজে নিজের সফলতা বা ব্যর্থতার মাধ্যমে নিজেকে চেনা এবং বোঝা যায়। কিন্তু এগুলি কখনও কোনও মানুষের চিরকালীন তকমা হয়ে উঠতে পারে না।
তৃতীয়ত, কোনও একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে মানুষের সাফল্য বা ব্যর্থতা দিয়ে একজন মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রকে বিচার করা যুক্তিযুক্ত নয়। যেমন— পড়াশোনা, পরীক্ষা প্রভৃতির মাধ্যমে একজন মানুষের যথাযথ মূল্যায়ন করা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ এগুলি একজন মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু তার সঙ্গে একথাও মনে রাখা দরকার যে, একটি বিশেষ সময়ে এগুলি একজন মানুষের জীবনে সর্বাধিক গুরুত্ব পেলেও, তার গোটা জীবনেই যে এর প্রভাব পড়বে তেমন নয়। আসলে আমাদের জীবন এতটাই বড় এবং দীর্ঘ যে, তাতে ছয় মাস বা এক বছর একজন মানুষ কীভাবে কাটালো, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা এতই কম সময় যে তা মানুষের জীবনে কোনও গুরুত্বই রাখে না। যেমন— কোনও একটি নির্দিষ্ট পরীক্ষা, যা প্রতি বছর হয়ে থাকে, তাতে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর পাওয়া নম্বরের তারতম্য প্রতিবারই ঘটতে পারে। অর্থাৎ, আগের বছরে যে নম্বর পেলে ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব হত, সেই নম্বর আর এই বছরে গ্রাহ্য হবে না। দেখা যাবে যে, তার থেকে আরও বেশি নম্বর পেলে তবেই একজন ছাত্র বা ছাত্রীর সামনে নতুন পথ খুলছে, বা সে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু, সেই নম্বর একজন শিক্ষার্থী না পেলে, সে জীবনে ব্যর্থ হয়েছে— তা বলা যাবে না। আসলে এগুলি নির্ভর করে সাময়িক পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর।
সর্বোপরি বলা যায় যে, একজন মানুষের জীবনের সার্থকতা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তাতে পরীক্ষার নম্বরই একমাত্র বিষয় নয়। এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়েও কর্মজগতে নিজেদের সাফল্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে কর্মজগতে একজন মানুষের সাফল্য নির্ভর করে তার আত্মবিশ্বাস, যোগাযোগ ক্ষমতা, শেখা এবং শেখানোর দক্ষতা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, কোনও সমস্যার সমাধানে উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ, সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনার পরিচয় প্রভৃতির উপর। অন্যদিকে সম্পর্ক স্থাপনের সার্থকতা লুকিয়ে থাকে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা এবং একে-অপরের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত হওয়ার মধ্যে। এক্ষেত্রে কখনও কখনও নিজের থেকেও অন্যের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিতে হয়। মানুষের মধ্যে এই সব গুনের সমাবেশ তখনই ঘটে, যখন তার নিজের প্রতি বিশ্বাস অটুট হয়। এইখানেই বোধ হয় মানুষ হয়ে জন্মানোর সাফল্য খুঁজে পাওয়া যায়।
এত সব কথা বলার মানে এই নয় যে, একজন পরীক্ষার্থী নিজের পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়টিকে অবহেলা করে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে না। কারণ নিজের ক্ষমতা বা সাধ্য অনুযায়ী যদি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না হয়, তাহলে প্রত্যেকের মধ্যেই একপ্রকার অসন্তোষ প্রকাশ পায়। তাই পরীক্ষার্থীদের উচিত পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা। কিন্তু এটা কখনোই বিশ্বাস করা ঠিক নয় যে, পরীক্ষায় পাওয়া ভালো নম্বরের উপরেই কেবলমাত্র তার জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া নির্ভর করছে।
পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে যে পাহাড়-প্রমাণ প্রত্যাশার জন্ম হয়, তা কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত? প্রত্যাশা যেমন তার নিজের থাকে, তেমন তার উপর তার বাবা-মা, শিক্ষক,আত্মীয়স্বজন— সবারই প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু বৃহত্তর এই পৃথিবী তার কাছ থেকে কী চাইছে? এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজার মধ্য দিয়েই একজন মানুষ তার জীবনের যথাযথ মূল্য এবং নিজেকে বিশ্বাস করতে শেখে। সে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, পরীক্ষায় যেমন নম্বরই সে পাক না কেন, তা দিয়ে একজন মানুষের জীবনের দাম নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। জীবনে চলার ক্ষেত্রে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া অনেকটা বোনাস পাওয়া, অর্থাৎ পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো একটি ঘটনা।
আমরা যখন নিজের সঙ্গে কথা বলি, তখন আমাদের মধ্যে প্রায়ই নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পায়। এই নেতিবাচকতার মধ্যে নিজেদের অপদার্থতা, নিজেকে তুচ্ছ বলে মনে করা— সবই থাকে। নিজেদের ব্যর্থতাকে সমাজ, বাবা-মা, শিক্ষক কেমনভাবে বিচার করছে বা তারা এই বিষয়ে কতটা হতাশ— এমন ভাবনা কম-বেশি আমাদের সবার মধ্যেই দেখা দেয়। কিন্তু মোদ্দা কথা হল— বৃহত্তর পৃথিবী আমার কাজে কতটা হতাশ বা সন্তুষ্ট হচ্ছে, তা বিচার করা এবং সেই মতো নিজের জীবনের লক্ষ্য, কর্মপদ্ধতি প্রভৃতি স্থির করা। আর এইভাবেই একজন মানুষের জীবনে সাফল্যের অর্থ, সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এই বিষয়টি মানুষের নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তাই কোনও একটি নির্দিষ্ট কাজে সফল না হলেও হতাশায় ভেঙে পড়া উচিত নয়। বাবা-মা বা শিক্ষকদের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, তারা চায় সবসময়ে তাদের সন্তানরা ভালো থাকুক এবং আনন্দে থাকুক। আর সন্তান এই আনন্দ খুঁজে পায় তার পছন্দ এবং ভালো লাগার বিষয়ের মধ্যেই। তাই জীবনে সফল হতে গেলে চেষ্টার কোনও বিকল্প নেই। এই চেষ্টা নিজের জন্য সবসময়েই করা প্রয়োজন।
যদি একটা দরজা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমাদের সামনে আরও হাজারটা দরজা খুলে যায়। আর এই ঘটনাকে উপলব্ধি করার জন্য আমাদের মনের দরজাকেও খুলে রাখতে হবে— এই জরুরি কথাটি একজন পরীক্ষার্থীকে ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু নতুন দরজা খোলার জন্য আমাদের চেষ্টার যেন কোনও খামতি না থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আসলে বন্ধ দরজা খোলার মধ্য দিয়েই যে মানুষের জীবনে সার্থকতা আসে, তা আমাদের সবসময়ে মনে রাখতে হবে।
মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত একজন কাউন্সেলার যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিক ভাবে ছাপানো হবে।