পরীক্ষার আগে আমাদের অধিকাংশেরই দিশাহারা লাগে। এই সময় আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না যে, কীভাবে পরীক্ষার পাহাড়-প্রমাণ সিলেবাস শেষ করব। কিছু পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে তো আবার পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হবে বলে তার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন বা নিজেরই নিজের কাছে অনেক প্রত্যাশা থাকে। এই কারণে পরীক্ষা এগিয়ে এলেই অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী মানসিক উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটায়। এই ধরনের পরীক্ষাজনিত উদ্বেগ কাটানোর জন্য কয়েকটি উপায় রয়েছে এবং প্রত্যেকটি পড়ুয়ার জানা উচিত যে, তাদের পরীক্ষার উদ্বেগ কাটানোর জন্য তারা কখনোই একা নয়। এই কারণে একজন পরীক্ষার্থীর উদ্দেশ্যে মনোবিদদের বার্তা হল, ছাত্র-ছাত্রীরা যাদের নিজেদের কাছের মানুষ বলে বিশ্বাস করে, যেমন— বন্ধু, অভিভাবক, শিক্ষক বা কাউন্সেলরদের কাছে নিজেদের পরীক্ষা সংক্রান্ত দুশ্চিন্তার কথা যেন খোলাখুলি বলে।
নিজের পরীক্ষা সংক্রান্ত মানসিক উদ্বেগের কথা কেন অন্যকে বলা জরুরি?
পরীক্ষার্থীর সমস্যাটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়— পরীক্ষার আগে একজন পরীক্ষার্থীর মনে যখন নানারকম ভয়, উদ্বেগ প্রভৃতি দেখা দেয়, তখন তারা এগুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকে। কিন্তু এই সমস্যার কথা অন্যকে জানালে তারা সেই সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে সঠিকভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।
পরীক্ষার্থীর চিন্তাভাবনাজনিত ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের করা— পরীক্ষা শুরুর আগে একজন পরীক্ষার্থী প্রায়শই যদি মনে মনে দিশাহারা বোধ করে এবং মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়, তাহলে সে অনেক সময় বুঝতেই পারে না যে কেন তার এমন অনুভূতি দেখা দিচ্ছে। তাই অন্যকে নিজের এহেন অনুভূতির কথা জানানোর মধ্য দিয়ে সে নিজের চিন্তাভাবনার ধরনটিকে ঠিকঠিক বুঝতে পারবে— এমন আশা করা যায়। আর অন্যদের কাছে নিজের সমস্যার কথা বলার মধ্য দিয়ে তাদের সাহায্যে সেই সব সমস্যা সমাধানের রাস্তাও বের করা সম্ভবপর হবে।
পরীক্ষার্থীর মনের ভার দূর হয়— কাছের মানুষের সঙ্গে নিজের মনের অনুভূতি ভাগ করে নিলে মনের চাপ, বোঝা, উদ্বেগ অনেকটাই হালকা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যের কাছে নিজের সমস্যার কথা জানানোর এই বিষয়টিকে একপ্রকার থেরাপি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এই থেরাপি মানুষের মনের টেনশন দূর করার অন্যতম অস্ত্র। যদি নিজের কথা অন্যকে মন খুলে বলা যায়, তাহলে অন্যান্য আরও মানুষের সমস্যার কথাও জানা যাবে। এটি একজন পরীক্ষার্থীর মনের জোর বাড়াতে সাহায্য করবে।
পরীক্ষার্থীর জীবনে নতুন দিশার জন্ম হতে পারে— অনেক সময়ে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন পরীক্ষার্থীর মন-মেজাজ এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে, তারা নিজেদের শক্তি, দক্ষতা এমনকী নিজের জীবনকেও শেষ করে দিতে চায়। এই পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষার্থীর বাবা-মা, শিক্ষক, কাউন্সেলর বা তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে তার শক্তির কথা পুনরায় মনে করে দিয়ে এই গুরুতর সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হতে পারে। আসলে একজন নিরপেক্ষ শ্রোতা যখন কারও সমস্যার কথা শোনে, তখন সে ভালো-মন্দ সব কিছুই বিচার করে। তাই সাহায্যপ্রার্থী এর ফলে অনেক বেশি লাভবান হয়।
একজন পরীক্ষার্থী পেতে পারে সঠিক সমাধান সূত্র— যখন একজন পরীক্ষার্থী তার অভিভাবক, কাছের মানুষ, বয়সে বড় এমন মানুষ, শিক্ষক প্রভৃতি শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে নিজের সমস্যার কথা জানায়, তখন তাদের কাছ থেকে সে সেই সব সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন উপায়ের কথাও জানতে পারে। পরে সেগুলি নিজের জীবনে কার্যকরী করে তারা শুধু সমস্যার সমাধানই করে না, এর সাহায্যে নিজেদের জীবনকে আরও সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করে। নিজের বিশ্বাসভাজন কারও কাছ থেকে পরীক্ষার মরশুমে সময়ের সদ্ব্যবহারজনিত নানা খুঁটিনাটি বিষয়ও জানা সম্ভব হয়।
কাদের কাছে পরীক্ষার্থীরা নিজেদের সমস্যার কথা জানাবে?
কার কাছে একজন পরীক্ষার্থী নিজের মনের কথা খুলে বলবে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে এমন মানুষকেই বাছা উচিত যাকে একজন ছাত্র বা ছাত্রী বিশ্বাস করে এবং যার মতামতকে তারা গুরুত্ব দেয়। এদের মধ্যে কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর অভিভাবক, প্রিয় মানুষ, শিক্ষক, কাউন্সেলর বা স্কুল-কলেজের সিনিয়র দাদা-দিদি-রা থাকতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, এমন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে যে নিজে একজন মানসিকভাবে দৃঢ় ব্যক্তি। সবচেয়ে ভালো হয় এমন মানুষের সঙ্গে কথা বলা যে নিজেও কখনও নানারকম সমস্যায় ভুগেছে। তাহলে একজন পরীক্ষার্থীর সমস্যাটিকে সে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে। যদি কোনও পড়ুয়া নিজের সমস্যার কথা এমন মানুষকে বলে যে নিজেই আতঙ্কগ্রস্ত, তাহলে সে ক্ষেত্রে উপকারের থেকে অপকারই বেশি হবে। সব সময়ে এমন মানুষকে বাছতে হবে যে বাস্তব পরিস্থিতির সঠিক সমাধান করতে সক্ষম। আর এই ক্ষেত্রে চেষ্টা করা উচিত একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাকে নিজের সমস্যার কথা জানানো।
অন্যের কাছে নিজের সমস্যা জানানোর পরিবর্তে একজন পরীক্ষার্থী কি তার সমস্যার কথা নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখতে পারে?
অবশ্যই পারে। কথা বলার মতো লেখাও সমান উপযোগী। অনেকে মুখে বলার চেয়ে লিখতেই বেশি ভালোবাসে। এর মাধ্যমে একজন পরীক্ষার্থী নিজের সমস্যা এবং চিন্তাভাবনার ধরন উপলব্ধি করতে পারে এবং সেগুলি সমাধানে সচেষ্ট হতে পারে। এইভাবে লেখার মধ্য দিয়ে পরীক্ষার্থী তার নিজের মনের ভার এবং দুশ্চিন্তা দূর করতে সক্ষম হয়।
কখন একজন পরীক্ষার্থী কলেজের কাউন্সেলরের সাহায্য নেবে?
যদি কেউ দেখে যে তার পরীক্ষাজনিত মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা অনেক দিন ধরে চলছে, কিছুতেই সেগুলি মন থেকে দূর হচ্ছে না, তখন সে একজন কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে পারে। এছাড়া এমনও পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যে, মানসিক উদ্বেগ এতটাই বেড়ে চলেছে যে তা মনের সব আশাকে নষ্ট করে দিচ্ছে এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে তার কুপ্রভাব পড়ছে। এমন অবস্থায় কাউন্সেলরের সঙ্গে যোগাযোগ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। এক্ষেত্রে যদি কোনও কলেজে কাউন্সেলর না থাকে বা যদি কোনও পরীক্ষার্থী মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম না হয়, তাহলে হেল্পলাইনের সাহায্য সে অবশ্যই
নিতে পারে।
এই প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন নিমহ্যান্স-এর ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মঞ্জুলা।