পরীক্ষার সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা জন্মায় যে, পড়ার কোনও শেষ নেই, কিন্তু তার জন্য হাতে সময় খুব কম। এই কারণে পরীক্ষার মরশুমে একজন পরীক্ষার্থীর পক্ষে সময়ের সদ্ব্যবহার করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বহু ছাত্র-ছাত্রীই পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে এবং পরীক্ষা চলাকালীন সময়ের অপব্যবহার করে। এই সময়ে হয় তারা পড়াশোনার কাছে ঘেঁষতে চায় না নয়তো পরীক্ষায় ভালো ফল করার ক্ষেত্রে সময়ের দাম এবং নিজেদের প্রচেষ্টাকে ছোট করে দেখে। তাই পরীক্ষা এগিয়ে এলে একজন পরীক্ষার্থীর উচিত পরিকল্পনামাফিক এবং কৌশলী হয়ে সময়ের যথাযথ ব্যবহার করতে শেখা। এমনকী পরীক্ষার জন্য সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি কেউ নিজের পড়ার পদ্ধতি পরিবর্তন করতে চায়, তাহলেও সে আগের থেকে অনেক বেশি লাভবান হতে পারবে বলে মনে করা হয়।
প্রায়ই দেখা যায় যে, পড়ুয়ারা নিজেদের পড়াশোনার প্রস্তুতির জন্য সময়কে খুব তুচ্ছ করে দেখে, আর নাহলে লেখারপড়ার চাপের তুলনায় সময় বেশি নেই বলে হা-হুতাশ করে। সময়ের সদ্ব্যবহারের জন্য দৈনন্দিন কাজকর্ম ঘড়ি ধরে করার অভ্যাস করতে পারলে, তা সবসময়েই খুব ভালো ফল দেয়। এই অভ্যাস রপ্ত করার ক্ষেত্রে বহু শিক্ষার্থী তাদের নিজস্ব ডায়েরিতে প্রতি সপ্তাহের প্রাত্যহিক কাজকর্ম ঘড়ি মিলিয়ে লিখে রাখে এবং সেই পরিকল্পনা মতোই তারা সারাদিন নিজেদের নির্ধারিত কাজকর্ম করে থাকে।
এ, বি, সি অনুসারে বিভক্তিকরণ
একজন পরীক্ষার্থী যদি পরীক্ষার আগে তার পাঠ্যসূচির অর্ন্তভুক্ত বিষয়গুলিকে ভাগ করে নিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়, তাহলে সময়ের যথাযথ ব্যবহার করাও হয় এবং নিজের দক্ষতাকেও বাড়ানো যায়। এক্ষেত্রে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর উচিত নিজেকে প্রশ্ন করে জেনে নেওয়া যে, সিলেবাসের কোন বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা অপেক্ষাকৃত কম জরুরি। সেই মতো পরিকল্পনা করে সপ্তাহের প্রথমদিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি পড়া দরকার। আর কম জরুরি বিষয়গুলি সপ্তাহের শেষের দিকে পড়ার জন্য রেখে দেওয়া যাবে। এই পদ্ধতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে শুধু যে সময়ের সদ্ব্যবহারই করা সম্ভব তা নয়, এটি পড়ুয়াদের পাঠক্রমের অর্ন্তভুক্ত বিভিন্ন বিষয়গুলির অগ্রাধিকারের প্রশ্নের ক্ষেত্রেও একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
অগ্রাধিকার অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের বিভিন্ন ভাগগুলি হল—
সবচাইতে জরুরি বিষয় ( অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলি)
যে বিষয়গুলি দেরি না করে পড়ে ফেলতে হবে (মাঝারি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়)
যে বিষয়গুলি পড়ার তেমন তাড়াহুড়ো নেই (কম জরুরি বিষয়)
পরিকল্পনামাফিক সময়ের ব্যবহার করা
সাধারণত, সময়কে যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়, তাতে সারাদিনের নিত্য-নৈমিত্তিক কাজকর্ম যুক্ত থাকে। যেমন—
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কাজ— ক্লাস করা, ঘরে-বাইরে নানা কাজ করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, খেলাধূলা করা, শরীরচর্চা, একটু-আধটু ঘোরাঘুরি করার জন্য সময় ব্যয় করা প্রভৃতি।
একান্ত নিজস্ব কাজ— নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা, অবসর সময় কাটানো, টিভি দেখা, গান শোনা, বাজার-দোকান করা, সমাজে মেলামেশা করা, ই-মেল পাঠানো, ফোনে কথা বলা ইত্যাদি।
অত্যাবশ্যক কাজ— খাওয়া-দাওয়া করা, ঘুমানো।
ঘরের কাজ— রান্নাবান্না করা, বাড়ি-ঘর পরিষ্কার রাখা, বাসনপত্র মাজা, জামাকাপড় ধোওয়া প্রভৃতি।
ঠিক এইভাবেই পড়াশোনার ক্ষেত্রেও পরিকল্পনামাফিক প্রতিদিন নির্দিষ্ট বিষয়গুলি বা অধ্যায়গুলি পড়া জরুরি। যে বিষয়গুলি পড়া হয়ে যাচ্ছে, সেগুলি একটি তালিকায় লিখে রাখতে পারলে ভালো। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে তালিকা ছাত্র-ছাত্রীরা তৈরি করবে, তাতে অগ্রাধিকার অনুযায়ী বিষয়গুলিকে এ, বি বা সি হিসেবে চিহ্নিত করা একান্ত প্রয়োজনীয়। এর সাহায্যে একজন পরীক্ষার্থী বুঝতে পারবে যে, কোন বিষয়টি তার আগে পড়া উচিত আর কোনটা পরে পড়লেও চলবে। কোনও বড় বাধা অতিক্রম করার জন্য মানুষকে ধাপে ধাপে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। তাহলে সেই কঠিন বাধা খুব সহজেই পার করা সম্ভব হয়। আর তাই পরীক্ষার মতো শক্ত বাধা অতিক্রম করার ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম প্রযোজ্য।
সময় নষ্ট করা বা গড়িমসি করার মনোভাব
পরীক্ষার আগে আমরা কম-বেশি সবাই শেষ মুহূর্তের জন্য সিলেবাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি পড়ব বলে মনস্থ করি। কেন এই ধরনের কাজে আমরা অভ্যস্ত? বা কেন আমরা পড়ার ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তের অজুহাত দেখাই অথবা নিজেদের লক্ষ্যপূরণের ক্ষেত্রে অবহেলা করে থাকি? সাধারণত দেখা যায় যে, আমরা কোনও দায়িত্বপালন বা কর্তব্যের ক্ষেত্রে শুরুর দিকে যতখানি গুরুত্ব সহকারে পরিস্থতির বিচার করি, সময় যত এগোয় তত কাজের ক্ষেত্রে আমাদের ঢিলেমি আসতে থাকে। ঠিক একইভাবে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর সামনে পরীক্ষার আগে যখন পাহাড়-প্রমাণ সিলাবাসের চাপ থাকে, তখন তার মধ্যে পরীক্ষার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে একপ্রকার গড়িমসি করা বা সময় নষ্ট করার মনোভাব দেখা যায়। পড়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর মধ্যে এমন কুঁড়েমি দেখা যায় যে, সঠিক সময়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি না নিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তের জন্য তারা পরীক্ষার পড়া করবে বলে মনে মনে স্থির করে। অধিকাংশ সময়েই এহেন মনোভাব পরীক্ষার্থীদের বিপদে ফেলে দেয়। তাই এই বিপজ্জনক মনোভাব বা পড়াশোনার ক্ষেত্রে গড়িমসি করার মানসিকতা এড়ানোর জন্য একজন পরীক্ষার্থীকে পরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করা উচিত।
পড়াশোনার ক্ষেত্রে গড়িমসির সমস্যা সমাধানের সূত্রগুলি হল—
পড়াশোনার ক্ষেত্রে কেন সময় নষ্ট করার মনোভাব দেখা দিচ্ছে, তা প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে। পরীক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে সে তার সমস্যার সমাধান করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। যেমন— যদি কোনও পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় ফেল করার ভয় থাকে, তাহলে তার উচিত নিজের লক্ষ্যের প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া এবং পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে অনেক বেশি আশাবাদী থাকা। যদি বড় কোনও লক্ষ্যপূরণের জন্য মানসিক উদ্বেগ বেড়ে যায়, তাহলে তা কমানোর জন্য ধাপে ধাপে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া জরুরি।
যদি পড়াশোনার প্রতি মনঃসংযোগ করতে কোনও পরীক্ষার্থীর সমস্যা হয়, তাহলে পড়াশোনা করার জন্য তাকে এমন জায়গা বেছে নিতে হবে যেখানে তার মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটবে না, সে শান্ত মনে সেখানে শুধু পড়াশোনা করবে। এর ফলে তার পড়ার প্রতি মনোযোগ বাড়বে এবং সে তার লক্ষ্য পূরণের দিকে এগিয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে যে, লক্ষ্যপূরণের ক্ষেত্রে যতই বাধা আসুক না কেন, কেউ যদি সে সম্পর্কে সতর্ক থাকে, তাহলে কঠিন বাধা সহজেই অতিক্রম করা সম্ভব। তাই আর দেরি না করে একজন পরীক্ষার্থীর উচিত অবিলম্বে কঠিন বিষয়গুলি পড়তে শুরু করা এবং বারেবারে সেগুলি ঝালিয়ে নেওয়া। এর মাধ্যমে পরীক্ষার্থী তার পরীক্ষার সিলেবাসও সফলভাবে শেষ করতে পারবে।
সূত্রঃ
Chong, J. (2007). Time management. Sydney, Australia: University of New South Wales.
Cottrell, S. (2008). The study skills handbook (3rd ed.). New York, NY: Palgrave Macmillan.
Morgenstern, J. (2004). Time management from the Inside Out. New York: Henry Holt and Company.