এলজিবিটিকিউআইএ+

আমি বিচিত্রকামী, আপনি কি আমায় একজন বিশ্বস্ত থেরাপিস্টের সন্ধান জানাতে পারবেন?

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

একবছর আগে আমি থেরাপি করাতে গিয়ে থেরাপিস্ট 'জে'-কে বলেছিলাম যে আমি একজন উভকামী। অবসাদ, নানারকম সমস্যা এবং চিন্তিত থাকার জন্য আমি থেরাপি করাতে গিয়েছিলাম। আসলে এসবের মধ্যে আমার উভকামীতা ছিল একটা বড় বিষয়, যা নিয়ে সর্বসমক্ষে কথা বলার সাহস আমার ছিল না। আমার কথা শুনে কী বলবেন থেরাপিস্ট? তিনি কি আমার যৌন অভিমুখকে খোলা মনে মেনে নেবেন, এবং বিষয়টাকে 'সমস্যা' বলে মনে না করার ফলে তার সমাধান করার চেষ্টা করবেন না? আমার ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি কি আমায় দিশা দেখাতে সাহায্য করেছিলেন? আমি বিশ্বাস করেছিলাম থেরাপিস্ট জে-কে এবং যদি ও আমার বিশ্বাস ভেঙে দিত তাহলে আমি সাংঘাতিক আহত বোধ করতাম। তারপর শুরু হত নতুন করে সাহায্য খোঁজার পালা কারণ আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।

আমি কিন্তু প্রথমে থেরাপিস্ট জে-এর কাছে যাইনি। আমি গিয়েছিলাম অন্য একজন বেশ নামকরা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট-এর কাছে এবং আমার এখনো মনে হয় যে আমার জে-এর সংস্পর্শ-এ আসা কোনও কেরানীর বা ব্যবস্থাপনার ভুলের জন্য ঘটেছিল। এই বয়স্ক থেরাপিস্টের মধ্যে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে ছিল মানসিক স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে একজন এলজিবিটি-কে স্বীকৃতি দেওয়ার সদিচ্ছা এবং তাদের হয়ে কাজ করার জন্য তিনি ছিলেন একজন কর্মী। কিন্তু তিনি সবসময়ের জন্য এলজিবিটিদের জন্য সক্রিয় কর্মী ছিলেন না। ৮০ এবং ৯০ দশকের শুরুতে তাঁকে সবাই গে এবং লেসবিয়ান-দের এবং তাদের সমকামিতার “চিকিৎসা” সংক্রান্ত থেরাপিস্ট হিসেবে জানত ও চিনত। আমি তাঁর বর্তমান ভালো কাজকে কখনোই হেয় করতে চাইছি না, কিন্তু তাঁর পরিবর্তে জে-কে পেয়ে আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। আমি নিশ্চিত নই যে তাঁর অতীতের বিশ্বাসের সাথে আমার ভঙ্গুর আত্মবিশ্বাসের মেলবন্ধন ঘটানো সম্ভব হত কিনা।

'এলজিবিটি-সহযোগী হওয়া উচিত'

সাত বছর পরে আমি নিজেকে পরিচয়ের গোপনীয়তা থেকে মুক্তি পেয়েছি এবং বাইরে আসতে পেরেছি। আমার জীবনে এলজিবিটি সম্প্রদায়ভুক্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরিবারের সদস্য রয়েছে, যাদের আমি ভরসা করি। এই আশীর্বাদ প্রত্যেক লেসবিয়ান মহিলা, গে পুরুষ, উভকামী মানুষের উপর থাকে না। এমনকী, খুব কম সংখ্যক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি সমাজে বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানে স্বীকৃতি পায়। (নতুন লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য প্যান ও আধার কার্ড পাওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারেন - মোটেই সহজ কাজ নয়।)

ফেসবুকের সীমিত সদস্যদের জন্য তৈরি গ্রুপগুলোতে বিচিত্রকামী পুরুষ এবং মহিলারা একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ/থেরাপিস্ট/কাউন্সেলরের কথা বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে চায়। এলজিবিটি-দের পক্ষে হওয়া আবশ্যক। এলজিবিটি-দের প্রতি উদার মনোভাবকে আমরা কখনো ধরে চলি না; বিচিত্রকামী মানুষদের ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপির সাহায্যে গে সত্ত্বাকে ‘সারিয়ে’ তোলার ইতিহাস খুব বেশিদিন পুরানো নয়। কোনও ধর্মীয় ব্যক্তিকে নিযুক্ত করে একটি পরিবার আপনাকে 'স্বাভাবিক' আচরণ করার জন্য 'পথ' দেখাতে পারে। বেশ কয়েক বছর ধরে বিচিত্রকামী ভারতবাসীরা বিশ্বাসযোগ্য বিশেষজ্ঞদের একটি অসংগঠিত তালিকা তৈরি করেছে, যাঁরা এলজিবিটিদের সমস্যা ও চাহিদার কথা বোঝেন এবং আমাদেরকে তাচ্ছিল্য করেন না। এই তালিকাতে একটি একটি করে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এমন ব্যক্তিদের দ্বারা যারা এক এক করে অনেক থেরাপিস্টের কাছে গিয়ে এমন একজনকে খুঁজে পেয়েছেন যার কাছে দ্বিধামুক্ত হওয়া সম্ভব।

ভারতে বহু মানুষের বৈকল্পিক যৌন অভিমুখ বা লিঙ্গ পরিচয়, অথচ তাদের সংখ্যার বিষয়ে আমাদের কোনও স্বচ্ছ ধারণা নেই। আমরা যা জানি তা হল যে যারা আমাদের সামনে রয়েছেন তাদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক মানুষের অবসাদ বা আত্মহত্যা করার ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে কিছু তথ্য তথ্য নয়, অভিজ্ঞতা। যখন আমরা শুনতে পাই যে এমন কোনও ব্যক্তি মারা গিয়েছেন, তখন আমরা ফেসবুকে শোক, দুঃখ প্রকাশ করি, আত্মার শান্তি কামনা করি। সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের শোক প্রকাশের দ্বারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখি। আমার জীবনের প্রথম বিচিত্রকামী অনুষ্ঠান ছিল ব্যাঙ্গালোরে, এমন একজন ট্রান্সজেন্ডার মহিলার স্মরণসভা যাকে তার গোষ্ঠীর মানুষ খুব ভালোবাসত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী, ভালোবাসার মানুষ ও স্বাধীন এক সত্ত্বা। কিন্তু যে যতই সুন্দরী, জনপ্রিয় বা স্বাধীন হোক না কেন, জীবন এতটাই কঠিন হতে পারে যে সেটাকে শেষ করে দিতে হয়।

এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি এতগুলো বছর কাটিয়েছি যে কিছু নিয়ম আমি আত্মসাৎ করে ফেলেছি। যেমন, মানুষের আচার-আচরণ লিঙ্গভিত্তিক হবে বলেই আশা করা হয়ে থাকে। যে সব শিশুর মধ্যে স্বাভাবিক লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য থাকে না তারা অন্যের আক্রমণের শিকার হয়। পূর্ণবয়স্ক মানুষ যখন সমাজের সাধারণ নিয়ম অর্থাৎ বিয়ে, বাচ্চার জন্ম দেওয়া প্রভৃতি মেনে চলতে অক্ষম হয় তখন তার উপর বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য ও গোষ্ঠী নানারকম চাপ তৈরি করে। ট্রান্সজেন্ডাররা এই লিঙ্গ নিয়ে হেনস্থার কঠোর বিধি-নিষেধের আগুনে প্রতিনিয়ত জ্বলে পুড়ে মরছে।

যখন কোনও মানুষের যৌন অভিমুখ উন্মোচিত হয়ে যায় তখন কী ঘটে? তার জন্য কি কর্মজগত, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বা সমাজে তাকে অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়? বাড়ি ভাড়া করলে তার বাড়িওয়ালা কি তাকে শান্তিতে বাস করতে দেয়? তার প্রতি তার বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের কেমন ধারণা জন্মায়? তারা কি বিকল্প যৌনতার বিষয়টি আদৌ বোঝার চেষ্টা করে? এসব প্রশ্নের উত্তরগুলো সাধারণভাবে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বিবেচিত হয়। যেমন- তার পরিবার তাকে প্রত্যাখ্যান করবে, কর্মজগতে সহকর্মীরা তাকে হেয় করার বা তার কৃতিত্বকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করবে। এই পরিস্থিতির চরম পরিণতি হল হিংসার শিকার হওয়া।

আসলে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, আমরা গতানুগতিকতায় বেশি বিশ্বাসী। তাই যখন যৌন অভিমুখ বা লিঙ্গ পরিচিতির ক্ষেত্রে আমরা বিকল্প কিছু দেখি তখন আমরা নিজেদের চিরাচরিত সংস্কারের বাইরে বের করে আনতে পারি না। আসলে আমাদের নীতিবোধ, নৈতিকতা, আচার-বিচার সবই গড়ে ওঠে আমাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে, টেলিভিশন থেকে, ধর্মীয় ব্যক্তিদের কাছে থেকে। তাই এসব মাধ্যমগুলোতে যদি বিচিত্রকামী বা ক্যুইয়ারদের নিয়ে সারাক্ষণ নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পায় তাহলে এবিষয়ে সঠিক ধারণা আমাদের মধ্যে কীভাবে
গড়ে উঠবে?

যখন একজন বিকল্প যৌন অভিমুখের মানুষ বলতে সক্ষম হয় যে তার সাহয্যের প্রয়োজন রয়েছে তখন একজন বিশ্বাসযোগ্য থেরাপিস্টের সন্ধান করা শুরু হয়। কিছু অন্য ধরণের সমস্যার জন্য আমি আর জে-এর কাছে যাই না; আমার নতুন থেরাপিস্ট-এর কাছে আমি একবার গিয়েছি এবং ওকে আমার ভাল লেগেছে। এলজিবিটি-দের প্রতি ওর মনোভাব ইতিবাচক। কিন্তু সেটা নিয়ে ততক্ষণ আশ্বস্ত হওয়া সম্ভব ছিল না যতক্ষণ আমি বিরাট ঝুঁকি নিয়ে তাকে সবকিছু খুলে বলিনি। এটি সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ, এখনো যখন আমি আগের চেয়ে ভাল আছি, এবং নিজের সত্ত্বা, আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদাগুলোর বিষয়ে অনেক বেশী ওয়াকিবহল।

নিজেকে ভালো রাখতে কী করা জরুরি।

হয়তো আমি আমার সমস্যা অতিক্রম করতে সক্ষম হবো বা আমি আমার বাকি জীবন অবসাদের সাথে লড়াই করে কাটাবো। থেরাপি করতে যাওয়া, ওষুধ খাওয়া, অনবরত মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা বজায় রাখার চেষ্টা আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। জীবনে বেঁচে থাকার চিন্তা, সঙ্গীর সাহচর্য পাওয়ার বাসনা, বারবার নিজেদের ঝাড়াই-বাছাই করা, বিভেদের বিরুদ্ধে (বাড়িওয়ালা, অফিসের কর্তৃপক্ষ, কোম্পানির ম্যানেজার-এর দ্বারা করা বৈষম্য) কম অধিকার এবং নিরাপত্তাহীনতা ভোগ করা- এসব কিছু বড়ই ক্লান্ত করে দেয় আমায়।

তবে এত কিছুর পরেও আমি সত্যিই একজন ভাগ্যবান। আমি একজন সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত মানুষ। আমাকে দেখতে 'স্বাভাবিক'। যদি আমার তাই ইচ্ছে হয়, জনসমক্ষে আমি নিজেকে বিষমকামী হিসেবে উপস্থাপন করতেই পারি। কিন্তু সবাই আমার মতো ভাগ্যবান নয়, এবং আমার ক্লান্তির সঙ্গে অন্যদের ক্লান্তিকে তুলনা করা চলে না।

আমি বিচিত্রকামী বলে আমার জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে এমন দাবি আমি করতে চাই না। পরিস্থিতি বদলায়। বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় বিচিত্রকামী হওয়ার জন্য যে একাকীত্ব আমাকে অনুভব করতে হয়েছিল, তাড় থেকে আমি এখন অনেক ভাল জায়গায়। ব্যাঙ্গালোরের শক্তিশালী এলজিবিটি গোষ্ঠীর থেকে আমি বন্ধুত্ব এবং এই বিষয় নিয়ে কাজ করার সুযোগ দুটোই পেয়েছি। আমার আশা, এমন একটা সময় আসবে যখন আমার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ, সে আমার ভাইপো, ভাইঝি বা আমার মানস-সন্তান যে কেউ হতে পারে, যদি তাদের মধ্যে কেউ লেসবিয়ান, উভকামী, গে বা ট্রান্সজেন্ডার, নন-বাইনারি হয় তাহলে তারা তখন নির্ভয়ে, কোনও উপদ্রব ছাড়াই সমাজে বেঁচে থাকতে পারবে।

কিন্তু সেই পরিবর্তন আনতে গেলে আমাদের বিচক্ষণতা, জীবনকে সহজ-সরলভাবে দেখার চেষ্টা করা বাড়াতে হবে। এখনও পর্যন্ত আমরা অনেক বিভেদের মুখোমুখি হচ্ছি, কিছুটা সত্যি, কিছুটা ভয়। এবং অনেকসময়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রতি বিভেদ পূর্ণ ব্যবহার করছি। যদি আমরা খোলাখুলি নিজেদের পরিচয় জানাই তাহলে আমরা জানি না যে ক্ষতির মুখ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে পারব কিনা। অন্যদিকে, নিজেদের যৌন অভিমুখ লুকিয়ে রাখার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি অঙ্গ-ভঙ্গি ‘স্বাভাবিক’ হতে হবে। আমাদের মতো যাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের মানসিক চাপের কারণ স্থূল - জীবিকা নির্বাহ, নিরাপদ বাসস্থান খুঁজে পাওয়া।

তাই স্বভাবতই আমরা মানসিক চাপের শিকার হয়ে যাই। এছাড়া আমাদের মধ্যে কারও কারও আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই হিংসার জন্য বন্ধুকে হারিয়ে ফেলে (বিশেষ করে ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি থাকে)। তাই আমাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত লড়াই চলতে থাকে যাতে মৃত বিচিত্রকামীদের তালিকায় আরেকটি নাম যুক্ত না হয়। এর পরিবর্তে আমরা চাই নতুন পরিসংখ্যান,  বিচিত্রকামী মানুষ যারা বেঁচে আছে, এবং যাদের বাঁচতে দেওয়া হয়েছে।

প্রত্যেকদিন, আমি বাইরে বেরোই আমার বিচিত্রকামী সত্ত্বাকে সঙ্গে নিয়ে। আমি আছি, ভালো আছি। আমার আশা আগামীদিনেও আমি থাকব, এবং ভালো থাকব।

প্রবন্ধটি লিখেছেন ব্যাঙ্গালোরে বসবাসকারী একজন এলজিবিটিকিউআইএ+ গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ, কবি এবং লেখক রোহিণী মালুর।