সম্প্রতি (২০১৭ সালে) একটি অল্পবয়সি দম্পতিদের ঘনিষ্ঠ জীবনযাত্রা নিয়ে শুভ্ মঙ্গল সাবধান নামক একটি হিন্দি কৌতুক বা হাসির সিনেমা প্রকাশ পেয়েছে। সিনেমায় মুদিত শর্মার চরিত্রে অভিনয় করেছেন অংশুমান খুরানা এবং সুগন্ধার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভূমি পেডনেকার। স্বামী মুদিতের ঋজুকরণের (ইরেকশন) সমস্যা ছিল এবং সেজন্য বিয়ের পরে সুগন্ধার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। সিনেমাটিতে মজার ছলে দেখানো হয়েছে যে একজন পশু চিকিৎসক মুদিতকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে সে খুব মানসিক চাপের মধ্যে থাকে এবং চাপের জন্যই মুদিত সারাক্ষণ উদ্বেগে ভোগে।
ভারতের মতো রক্ষণশীল দেশে এই বিষয়টিকে নিষিদ্ধ হিসেবে মনে করা হলেও, আজকাল প্রচলিত গণমাধ্যমগুলো (পপুলার মিডিয়া) এই সমস্যা নিয়ে বেশ সোচ্চার হয়েছে এবং জোরালো পদক্ষেপও করছে। আমাদের দেশের স্কুলগুলোর পাঠক্রমে যৌনতা এবং সম্পর্কজনিত সমস্যার বিষয়টি স্থান পায়নি। যৌন স্বাস্থ্যসুরক্ষা একটি উদীয়মান বা উঠতি ক্ষেত্র হলেও, বিষয়টিকে ঘিরে যোগ্য বিশেষজ্ঞের অভাব ক্রমশ গুরুতর হয়ে উঠছে।
ভারতে এই সমস্যা কতখানি প্রাসঙ্গিক?
যদিও এবিষয়ে ভারতে নির্ভরযোগ্য কোনও সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য পাওয়া না গেলেও, ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশে, ২০১২ সালে প্রকাশিত দি ব্রিটিশ ন্যাশনাল সার্ভেস অফ সেক্সুয়াল অ্যাটিটিউড অ্যান্ড লাইফস্টাইলস্-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি ছ'জন মানুষের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে যৌন সমস্যা দেখা যায়। যৌন এবং সম্পর্কজনিত সমস্যা নিয়ে কাজ করা ব্যাঙ্গালোরের একজন থেরাপিস্ট (আয়েপ্পা এবং অন্যান্য-দের হ্যাপি রিলেশন গ্রুপ, ২০১৭) অনলাইন থেকে পাওয়া ৫০০টি প্রশ্নের বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে ৯৭ শতাংশ প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা এসেছে সেইসব পুরুষদের কাছ থেকে, যাদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ৩৫-এর বছরের মধ্যে রয়েছে। অধিকাংশ প্রশ্নগুলো ছিল পুরুষদের লিঙ্গের আয়তন ('ছোট লিঙ্গ' নিয়ে চিন্তাই এখানে দেখা দিয়েছিল), তাড়াতাড়ি বীর্যস্খলন (ইজাকুলেটিং) ঘটা (যদিও সংখ্যাগোরিষ্ঠের মধ্যে বীর্যস্খলনের সময়ের ব্যবধান গড়পড়তা একইরকম দেখা গিয়েছে) এবং ঋজুকরণ সংক্রান্ত।
কেন অল্পবয়সি ভারতীয়দের মধ্যে যৌন সমস্যা দেখা দেয়?
আমি চারপাশে প্রায়শই এমনসব পুরুষ মানুষ দেখতে পাই যাদের মধ্যে যৌনতাকে ঘিরে নানারকম ভ্রান্ত ধারণা এবং ভ্রান্তবিশ্বাস রয়েছে। শাহিল একজন ইঞ্জিনিয়ার। একবছর আগে তার বিয়ে হয়েছে। সে ছ'বার পর্যায়ক্রমে যৌনসঙ্গম করতে পারে। বীর্যস্খলনের পর থেকে টানা দুদিন শাহিল 'অতিরিক্ত ক্লান্ত' হয়ে পড়ে। শাহিলের মধ্যে যে ধরনের উদ্বেগ-সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে, তা ভারতীয় উপমহাদেশে 'ধাত সিনড্রোম' নামে পরিচিত, যেখানে পুরুষদের মনে একটা ভ্রান্ত বিশ্বাস রয়েছে যে বীর্য ক্ষয়ের ফলে তাদের শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
৩৫ বছর বয়সি রজত একজন অ্যাকাউনট্যান্ট বা হিসারক্ষক। সে বিয়ে করেছে এবং তার দুটো বাচ্চাও রয়েছে। একজন প্লাস্টিক সার্জন তাকে আমার কাছে মনো-যৌন (সাইকোসেক্সুয়াল) কাউন্সেলিং-এর জন্য পাঠিয়েছিলেন। ওই শল্য চিকিৎসক বা সার্জনের সঙ্গে রজত তার লিঙ্গবর্ধকজনিত (পেনিস এনলার্জমেন্ট) অপারেশন নিয়ে আলোচনা করেছিল। ন'বছরের বিবাহিত বা দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে গড়ে ওঠা যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে রজত বেশ সন্তুষ্ট ছিল। তবে কয়েক সপ্তাহ আগে যখন সে তার পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে সুইমিং পুলে নেমেছিল তখন সে তার লিঙ্গের আয়তনের জন্য বন্ধুদের কাছে হাসিঠাট্টা বা তামাশার পাত্র হয়ে উঠেছিল। তখন থেকেই সে তার পুরুষাঙ্গ বা লিঙ্গের আয়তন নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ে। স্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলন থেকে বিরত বা দূরে থাকে এবং একনাগাড়ে সমস্যাটি তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল।
রজতের মতো অল্পবয়সি পুরুষ বা যুবকদের কাছে অনলাইনের মাধ্যমে পর্ণোগ্রাফিক উপাদানের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা এখন খুবই সহজ একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে যৌনতার ধারণাটিকে শারীরিক মিলন এবং লিঙ্গকেন্দ্রিক হিসেবে চর্চা করা হয়। সামাজিক প্রেক্ষিতে যৌন স্বাস্থ্য শিক্ষার তাৎপর্য নিয়ে হ্যাপি রিলেশনশিপসের দ্বারা করা একটি সমীক্ষায় একজন যুবকের প্রশ্ন ছিল, ''ডাক্তারবাবু, আমার লিঙ্গ খুব ছোট, মাত্র ছ'ইঞ্চি লম্বা। আমার এমন ওষুধ চাই যাতে লিঙ্গের আয়তন বাড়তে পারে।'' দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের চারপাশে থাকা চোরা বাজারে, বিশেষ করে অনলাইনের চোরা বাজারে এমনসব নকল ওষুধ, লোশন, জরিবুটি এবং তেল বিক্রি হয়, যা পুরুষদের মনে জন্মানো লিঙ্গ-দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ঘটার মতো একটা মিথ বা ভ্রান্ত ধারণাকে বেশি করে প্রচার করতে থাকে।
ভারতীয় যুবক বা তরুণরা সেই শারীরিক মিলনকেই স্বীকৃতি দিতে চায় না যা অনেকটা দু'জন মানুষের একসঙ্গে নাচ করার মতো একটা বিষয়, যেখানে উভয় সঙ্গীর মধ্যে তালমিল বা নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলাটা একান্ত জরুরি হয়। এর পরিবর্তে অনেক পুরুষই মনে করে যৌনসঙ্গমে বা শারীরিক মিলনে উদ্যোগী হয়ে ওঠাটা একমাত্র তারই দায়িত্ব। সেইসঙ্গে একজন পুরুষ তার লিঙ্গের ঋজুতার দ্বারা নারীর যোনিপথ ভেদ করার জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এভাবেই যতদূর সম্ভব প্রক্রিয়াটা দীর্ঘায়িত করা যায়- এমনটাই বিশ্বাস করে একজন পুরুষ। শারীরিক মিলনের ক্ষেত্রে একজন পুরুষ তার মহিলা সঙ্গীটির ভূমিকাকে ধর্তব্যের মধ্যেই মনে করে না। এই মনোভাবের জন্যই যখন যৌন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে তখন পুরুষরা প্রায়শই নিজেদের দোষ দেয় এবং এই ভেবে আশ্বস্ত হয় যে তাদের নিজেদের ভুল বা ত্রুটির কারণে যৌনমিলনে সমস্যা হচ্ছে। অনেকসময়ে এর ফলে যে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয় তা থেকেই মানুষের মধ্যে উদ্বেগ এবং অবসাদজনিত অসুস্থতার মতো মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যা যখন অনেক গভীরে চলে যায় তখন একজন পুরুষের মনে নিজের পৌরুষ বা পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ জাগে। কোনও কোনও সময়ে এই সন্দেহ এতটাই চরমে ওঠে যা থেকে একজন পুরুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
এখানে গীতা এবং শরতের উদাহরণ তুলে ধরা খুবই প্রাসঙ্গিক। তাদের তখন একবছরেরও কম সময় বিয়ে হয়েছিল এবং তাদের উপর পরিবারের চাপ ছিল যেন তারা সন্তানের জন্ম দেওয়ার মতো একটা সুখবর তাড়াতাড়ি দিতে পারে। গীতা একটা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের সাহায্যে জানতে পারে যে কখন সে ডিম্বানু উৎপাদনে সক্ষম হতে পারে এবং সেই অ্যাপ্লিকেশনে এটাও বলা ছিল যে কোন তারিখে স্বামী-স্ত্রীর যৌনমিলন হলে সে গর্ভধারণ করতে পারবে । শরত যখন গীতার সঙ্গে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হত তখন মাঝে মাঝেই গীতা ধৈর্য হারিয়ে ফেলত এবং কখন স্বামীর বীর্যপাত হবে সেকথা জিজ্ঞাসা করত। এই চাপের ফলে শরতের মধ্যে ঋজুকরণের সমস্যা দেখা দেয় এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যৌন তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। এই ঘটনা তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। আমার মতে এটাই 'সেক্স-অন-ডিমান্ড', যেখানে যৌনতার একমাত্র লক্ষ হল জননকার্য সম্পন্ন করা বা গর্ভধারণ করা।
যৌন-সংক্রান্ত সমস্যা ও মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এবং এটাই নির্দেশ করে আমাদের তাড়াতাড়ি এই বিষয়টা বুঝতে যে যৌন কার্য ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শারীরিক ও মানসিক উপাদানগুলোর সম্পর্ককে। সেক্সোলজিস্ট হিসেবে আমি আমার ক্লিনিকে প্রায়শই নীচের বক্তব্যগুলোকে বারবার খতিয়ে দেখার চেষ্টা করি-
যৌন-উষ্ণতা ভোগ করা মানে শুধুমাত্র বিবাহিত জীবনযাপন করা ও নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা নয়। যৌন-উষ্ণতার অন্য রূপও রয়েছে, যেমন- মানসিক, বিনোদনমূলক এবং নারী-পুরুষের সান্নিধ্য বা নৈকট্য, যেখানে একজন মানুষের উপস্থিতিই মূল লক্ষ্য হয়।
যৌনতা মানে শুধু ইন্টারকোর্স নয়। যৌনসঙ্গম নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একটা অংশ মাত্র।
ঋজুকরণ কোনও যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, যার কাজ একটা বোতামের সাহায্যে চালনা করা যায়। যৌন তাড়না বা যৌন উত্তেজনা (পুরুষের ঋজুকরণ এবং নারীর যোনি পিচ্ছিলতা [লুব্রিকেশন]) এমন একপ্রকার প্রক্রিয়া যার উৎসস্থল হল মন এবং শরীরের দ্বারা যার প্রয়োগ ঘটে। বিশেষ করে যৌনসঙ্গমের প্রাথমিক পর্বে যৌন তাড়না বা কামবাসনা না জাগলেও মানুষের উচিত স্বস্তিতে থাকা এবং তার জন্য অধীর হয়ে না ওঠা। আসলে উদ্বেগ অনেক ব্যক্তি এবং দম্পতির মানসিক স্থিতি নষ্ট করে দেয় এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে প্রতিহিংসার আগুনে ছারখার করে দেয়।
বুঝতে হবে যে, সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সুখ উপভোগ করা মানে পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে সুন্দর ভারসাম্য বজায় রাখা। যৌনসঙ্গম যে মানুষের পারস্পরিক একধরনের প্রক্রিয়া এবং তা যে শুধু একজন মানুষের পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, সে বিষয়েও মানুষকে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।
যদি যৌনসুখ অর্জন করার ক্ষেত্রে আপনার বা আপনাদের মনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তাহলে দয়া করে নারী-পুরুষকে একজন যোগ্য সেক্সোলজিস্টের কাছে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। সম্পর্কের যে কোনও পর্যায়ে আপনি সেক্সোলজিস্টের কাছে যেতে পারেন। এর মধ্যে প্রাক্বিবাহ কাউন্সেলিং পর্বটিও থাকতে পারে।
এই সমস্যাটি নিয়ে অবিলম্বে প্রত্যেকের উচিত খোলাখুলি কথা বলা; অভিভাবকদের উচিত যৌনতার বিষয়ে তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলা, শিক্ষকদের পক্ষে জরুরি এই বিষয়ে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা এবং সমাজের উচিত যৌন এবং যৌনতা বিষয়ক নিষিদ্ধতা, ভ্রান্তধারণা ও ভ্রান্তবিশ্বাস দূর করা।
এই প্রবন্ধে উল্লিখিত ব্যক্তিদের পরিচয় (নাম এবং অন্যান্য শনাক্তযোগ্য তথ্য) পরিবর্তন করা হয়েছে এবং মানাসই ছদ্মনাম বা পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে।