পুরুষ

বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়ার সম্ভাবনা পুরুষদের মধ্যে কম দেখা যায়

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

যুক্ত রাজ্যের মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে গত মাসে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার মুখোমুখি হওয়া ১৯% মহিলাদের তুলনায় ২৮% পুরুষরা বিশেষজ্ঞের সাহায্য এড়িয়ে গিয়েছেন। কয়েক দশক ধরে চলা একটি গবেষণার মূল লক্ষ্য হল সাহায্য গ্রহণের বিষয়টি বোঝা এবং তাতে দেখা গিয়েছে যে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের বিশেষজ্ঞের সাহায্য গ্রহণের সম্ভাবনা কম থাকে। ভারতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে এরকম লিঙ্গভিত্তিক গবেষণার অভাব থাকায়  আমরা এই প্রবণতার বিষয়টি নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। 

মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক তারতম্যের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে কি?

এবিষয়ে ২০১৫ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস (নিমহ্যান্স)-এর করা ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভে বা জাতীয়  মানসিক স্বাস্থ্যের সমীক্ষা থেকে কিছু সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

  • প্রায় ১৬.৭৫% পুরুষ তাদের জীবদ্দশায় কোনও না কোনও মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ১০.৮০%

  • বর্তমানে প্রায় ১৩.৯% পুরুষের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি হল ৭.৪৭%

  • বাইপোলার অ্যাফেকটিভ ডিসঅর্ডার এবং সাইকোটিক ডিসঅর্ডারের মতো গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় যেখানে প্রায় ২.১৫% পুরুষ তাদের জীবদ্দশায় আক্রান্ত হতে পারে, তার তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ১.৭৩%

  • ৩৫.৬৭% পুরুষের মধ্যে মাদক দ্রব্যের ব্যবহারজনিত সমস্যা নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে মাত্র ১০.০৫% মহিলার মধ্যে এই সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই সংখ্যাগুলোই পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করছে যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা এবং সেই সংক্রান্ত সাহায্য গ্রহণের প্রবণতা বোঝার ক্ষেত্রে পুরুষদের উপরেই বেশি করে আলোকপাত করা প্রয়োজন।

সাহায্য না নেওয়ার পিছনে যে কারণগুলো রয়েছে

পুরুষদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, সেই সমস্যা সমাধানের জন্য যখন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়ার সময় আসে তখন সেখানে একটা ফাঁক থেকে যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাঁদের সাহায্য গ্রহণের সম্ভাবনা কম থাকে। গবেষকরা এর কয়েকটি কারণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন-

ঐতিহ্যগত লিঙ্গ ভূমিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান- খুব ছোটবেলা থেকে সমাজ আমাদের শিক্ষা দেয় যে কোন লিঙ্গের সঠিক আচরণ কেমন হওয়া উচিত। এবিষয়ে কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট পারাস শর্মা বলেছেন, ''পুরুষদের উপর সাধারণভাবে চাপ থাকে নিজেদের অসহায়তা বা দুর্বলতা প্রকাশ করার। চিরকালীন ধারণা হিসেবে পুরুষকে রক্ষাকর্তা বা অভিভাবক হিসেবেই গণ্য করা হয়। মনে করা হয় যে পুরুষরা সাধারণভাবে তখনই একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেবে যখন তাদের উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করবে এবং সমস্যার সমাধান হয়ে গেলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা বিশেষজ্ঞের সাহায্য গ্রহণ বন্ধ করে দেবে।'' প্রায়শই একজন পুরুষকে তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখানো হয় এবং তাকে একজন সফল ও শক্তিশালী মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করাই মূল লক্ষ্য থাকে। এসব কারণে অনেক পুরুষই অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়াকে নিজেদের দুর্বলতার লক্ষণ বলে মনে করে।

সমগ্র পরিস্থিতির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারানোর অনুভূতি জাগা- পুরুষদের নিজেদের মধ্যেই সবসময়ে সমস্যা সমাধানের একটা চেষ্টা থাকে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তাদের নিজেদের মধ্যেই সমস্যার অস্তিত্ব রয়েছে ও সেগুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করতেও সক্ষম। তাই অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়ার অর্থ হল পরিস্থিতির উপর থেকে নিজের আধিপত্য বা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা।

প্রতিদান- একজন পুরুষ অন্যের সাহায্য চাইবে কি চাইবে না, তা নির্ধারিত হয় একটি বিষয়ের উপর আর তা হল তাদের প্রতিদানের মানসিকতা। একারণে যখন একজন পুরুষ তার দুর্দশার সময়ে অন্যের সাহায্য চায় তখন তার মধ্যে এই বোধই কাজ করে যে সে ওই সাহায্যকারী ব্যক্তিকে তার সাহায্যের বিনিময়ে ভবিষ্যতে কোনও না কোনওভাবে সাহায্য করবে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে 'নিজেদের  অবস্থান বজায় রাখা' এবং 'নিজেদের শক্তিশালী এবং যোগ্য ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখাই' একজন পুরুষের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সামাজিক সহায়তা- একজন অন্যের সাহায্য গ্রহণ করবে কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য সামাজিক সহায়তা একটা বড় ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পুরুষদের সাহায্য না চাওয়ার এই প্রবণতার কারণ হল অধিকাংশ পুরুষ যে সামাজিক বৃত্তের মধ্যে থাকে সেখানে তারা নিজেদের আবেগানুভূতির চাইতে কাজকর্ম নিয়েই বেশি কথাবার্তা বা মত আদান-প্রদান করে। তাই বেশিরভাগ পুরুষ তাদের ব্যথা-বেদনার বোধ দূর করার চেষ্টা নিজেরাই করে।

পুরুষ ও মহিলারা ভিন্ন ভিন্নভাবে নিজেদের মানসিক চাপের মোকাবিলা করে

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের অবশ্যই মনে রাখা জরুরি যে মানসিক চাপ মোকাবিলার ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলারা আলাদা আলাদা পন্থা অবলম্বন করে। স্পন্দন হেলথকেয়ার-এর ডাইরেক্টর ও অনুশীলনরত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ মহেশ গৌডা বলেছেন, ''আমি লক্ষ্য করেছি দুটি লিঙ্গের মধ্যে গোড়াতেই অনেক পার্থক্য রয়েছে; মহিলারা যেখানে সামান্য সমস্যায় পড়লেই খোলাখুলিভাবে অন্যের সাহায্য চায় সেখানে পুরুষরা তখনই অন্যের সাহায্য চায় যখন পরিস্থিতি তাদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়।''

একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে সমস্যা সমাধানের জন্য পুরুষরা যে কৌশল নেয় তাতে আদ্যোপ্রান্ত মাথা খাটিয়ে কাজ করা হয়। অন্যদিকে, মহিলারা সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে আগেবকেন্দ্রিক কৌশল ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে সমস্যার সঙ্গে তাদের নেতিবাচক আবেগগুলো মিশে থাকে।

সুইসাইড প্রিভেনশন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন-এর প্রতিষ্ঠাতা নেলসন বিনোদ মোসেস বলেছেন, ''অধিকাংশ পুরুষকে আপনি সমাধান সূত্র দিতে পারেন এবং তা খোঁজার কথা বলতে পারেন, তবে নিজেদের প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তাদের মুখে ভাষা খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর হয়।'' মহিলারা কিন্তু নিজেদের সমস্যার কথা সহজেই খোলাখুলিভাবে বলতে পারে এবং তা সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের নেতিবাচক অনুভূতি (যেমন- উদ্বেগ এবং দুঃখবোধ) পুরুষদের চেয়ে বেশি থাকে।

সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি প্রচার করা

গ্লাসগোর ইয়ুথ জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের দ্বারা আলোচিত এক রিপোর্টে এমন কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে যার সাহায্যে একজন পুরুষের বন্ধু বা তার পরিবারের সদস্যরা ওই পুরুষটিকে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত বা উদ্যোগী করে তুলতে পারে:

  • সমানুভূতি সহকারে মানুষের সমস্যার কথা শোনা

  • মানুষকে বেশি করে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে যোগদান করানো

  • একজন বিশ্বাসযোগ্য থেরাপিস্টের নাম সুপারিশ করা যিনি মানুষকে সাহায্য গ্রহণের জন্য ইতিবাচক পথ বা দিশা দেখাতে পারেন

  • যখন কেউ চিকিৎসার দ্বারস্থ হবে তখন তার মধ্যে নিয়ন্ত্রণের বোধ জাগিয়ে তোলা