মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাবিনা রাও-এর ক্লিনিকে আটজন রুগির মধ্যে অন্তত দু'জন মহিলা রুগি থাকেন, যাঁরা বিয়ের পর ঝগড়াঝাটি ও নির্যাতনের (মানসিক, অর্থনৈতিক এবং শারীরিক) কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় জর্জরিত। ব্যাঙ্গালোরের সাক্রা ওয়ার্ল্ড হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রাও-এর মতে, প্রায়শই মহিলারা মানসিক উদ্বেগ ও অবসাদের লক্ষণ নিয়ে তাঁর কাছে যান। কিন্তু কখনও কখনও বিয়ে সেই সব মহিলাদের জীবনে এমন পরিবর্তন ও আঘাত নিয়ে আসে, যার ফলে তাঁরা একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়ে।
আমরা সবাই জানি, যে কোনওরকম নির্যাতনের ফলেই একজন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ডাক্তার রাও দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবেশের হঠাৎ বদলও একজন মহিলার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
মানুষের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন সিদ্ধান্ত, যার মধ্যে বিয়ে বা নারী-পুরুষের যৌথভাবে বসবাস করার বিষয়টিও রয়েছে, তা খুবই উত্তেজনাময় ও চ্যালেঞ্জিং হয়। বিয়ে যেমন দুটো মানুষের জীবনে স্বামী-স্ত্রী রূপে একসঙ্গে বসবাস করার আনন্দ বয়ে আনে, তেমন বিয়ের মধ্য দিয়ে একজন মহিলার জীবনে একদম নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলা, নতুনভাবে একটা পরিবার গড়ে তোলা এবং অনেকসময়ে নিজের চেনা-পরিচিত শহর ছেড়ে দূরে অন্য কোনও শহরে চলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
ব্যাঙ্গালোরের একজন খ্যাতনামা মনোরোগ সংক্রান্ত পরামর্শদাতা সিমি ম্যাথিউ বলেছেন, ''মানসিক চাপ ও চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পরিমাণ একজন মহিলার ক্ষেত্রেই সত্যিই খুব বেশি থাকে। একটা নতুন যৌথ জীবনের মানে হল অনেক অপরিচিত বিষয়ের মুখোমুখি হওয়া। আর এই ঘটনা ভারতে একজন পুরুষের তুলনায় মহিলাদের জীবনেই বেশি ঘটতে দেখা যায়।'' সদ্য বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে একজন মহিলাকে যেমন অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, তেমন এর ফলে তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাও দেখা দেয়।
নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলা
ভারতীয় মহিলাদের জীবনে বিয়ে তাদেরকে ভৌগোলিকভাবে নতুন কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। বিয়ের পরে মহিলারা হয় সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত একটা পরিবারে যায়, নাহলে স্বামীর সঙ্গে নিজের পরিবার, চেনা-জানা শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যায়। ম্যাথিউ-এর মতে, মহিলারা বিয়ের পরে অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য হয় ও এই ঘটনাকে তারা অনিবার্য পরিণতি হিসেবে স্বীকারও করে নেয়। এটাও সত্যি যে তাদের শহর বা গ্রাম যে কোনও জায়গাতেই যেতে হতে পারে। অনেকসময়ে নতুন জায়গায় যাওয়া নিয়ে কোনওরকম ঝামেলা এড়ানোর জন্য মহিলারা নিজেদের মানসিক অস্বস্তি বা সমস্যার কথা অন্যকে বলতে দ্বিধা বোধ করে। অথবা উল্টোটাও দেখা যায়। অর্থাৎ এই বিষয়টি নিয়ে তারা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। অনেক মহিলা একটু সময় লাগলেও এই ঘটনা স্বীকার করে নেয়। আর এটা নির্ভর করে নতুন পরিবার ও স্বামীর সাহায্য এবং নতুন পরিবেশের সঙ্গে তাকে কতটা মানিয়ে চলতে হচ্ছে, তার উপর। কিন্তু কিছু মহিলার ক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি তাদের মধ্যে মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা ও অসহায়তার জন্ম দেয়। আর এর থেকেই তাদের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা, মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগ দেখা দেয়।
আত্মানুভূতি বা নিজস্বতার বোধ
''যে সব মেয়েরা জীবনে প্রথম ২৫-৩০টা বছর খুব স্বাধীন চিন্তাভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠে তাদের ক্ষেত্রে বিয়ে (আমাদের দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে) অনেকসময়ে আঘাতের সূচনা করে। তাদের মধ্যে নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা ও স্বাধীন মতামত থাকে। কিন্তু বিয়ের পরে যখন তারা শ্বশুরবাড়িতে এসে হঠাৎ করে অন্যরকম পরিবেশের মধ্যে পড়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে নিজেদের মানসিকতা মেলাতে পারে না অথবা তাদের স্বামীরা স্ত্রীদের মতামতকে গ্রাহ্য করে না, তখন তাদের মধ্যে নিজস্বতার বোধ ক্রমশ হারাতে শুরু করে,''- এমনই মনে করেন ডাক্তার রাও। তিনি আরও বলেছেন যে, অনেকসময়ে মহিলাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া হতাশা ও অসহায়তার বোধ প্রকাশ্যে না আসার ফলে তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগের লক্ষণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। যে কোন চাপ, যা খুব সহজে সারে না, তাই মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় পরিণত হয়।
প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা
বিবাহিত জীবন মানিয়ে নিতে গিয়ে যে ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা দেখা দেয় তার পিছনে বাহ্যিক পরিবেশের অনেক প্রভাব থাকে। সেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যেই নানারকম অযৌক্তিক, অবাস্তব প্রত্যাশা থাকে। ম্যাথিউ বলেছেন, ''দুর্ভাগ্যবশত, অনেক দম্পতিই প্রত্যাশা করে বিয়ে জীবনের সব সমস্যার সমাধান করে দেয়।'' যৌথ জীবনযাপন করতে গিয়ে প্রত্যেক দম্পতিরই উচিত নিজেদের প্রত্যাশাগুলো নিয়ে পারস্পরিক কথাবার্তা বলা। সেই সঙ্গে এই কথাটাও বুঝতে হবে যে প্রতিটি সম্পর্ক সুস্থভাবে টিকিয়ে রাখতে গেলে দরকার সেই সম্পর্কের ভিতকে শক্তিশালী করা। অন্যান্য যে কোনও সম্পর্কের মতো বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যেও দুটো মানুষের ভিন্ন অনুভূতি, আলাদা পারিবারিক পরিবেশ এবং পৃথক মূল্যবোধ থাকে। এসব নিয়েই বিয়ের পরে দুটো মানুষ একসঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে। ম্যাথিউ-এর মতে, সব অশান্তির সমাধান হল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক কথাবার্তা। তবে ম্যাথিউ আরও বলেছেন, প্রয়োজন হলে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। কিন্তু একজন মানুষ কেন বিয়ে করছে সে সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি।
কীভাবে বিবাহিত জীবনের চাপ মোকাবিলা করা সম্ভব
বিবাহজনিত মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা অনেকসময়েই নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। যদি সমস্যার লক্ষণগুলো খুব গুরুতর না হয়, তাহলে শুধুমাত্র সেই লক্ষণগুলোকে বিবাহজনিত জটিলতা, পারস্পরিক সহমতের অভাব বা প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার সমস্যা বলে মনে হয়। তাই সেক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়রেই একে অপরকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য সাহায্য করা একান্ত জরুরি।
১) বিয়ে বলতে ঠিক কী বোঝায় সে বিষয়ে সঙ্গীর সঙ্গে কথাবার্তা বলা প্রয়োজন। একে অপরকে বোঝানো উচিত যে তারা একটা বিবাহিত জীবনের থেকে কী প্রত্যাশা করছে। এক্ষেত্রে আলোচনাকে আরও যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ বা সঠিক পরামর্শদাতার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
২) বুঝতে হবে কীভাবে নিজের সঙ্গীর সঙ্গে জীবনযাপন করলে তা দুজনের দৈনন্দিন রুটিন এবং জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করবে। সেক্ষেত্রে যদি কোনও অস্বস্তি বা অসুবিধা বোধ হয় তাহলে নিজের সঙ্গীর কাছে সে কথা খুলে বলা দরকার।
৩) যৌথ পরিবারের সদস্য হিসেবে মহিলার স্বামীর নতুন পরিবেশে কীভাবে মানিয়ে নিতে হয় সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা উচিত। বুঝতে হবে নিজের সঙ্গী এমন একজন মানুষ, যার নিজস্ব পরিচয় ও মতামত রয়েছে।
যদি একজন মহিলার মধ্যে বিয়ের আগে থেকেই কোনও মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা থাকে
মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা একজন মানুষের মধ্যে কলঙ্কের বোঝা বাড়িয়ে দেয়। তার উপর পুরুষ ও মহিলা দু'জনের ক্ষেত্রেই বিয়ে আগুনে ঘি ঢালার মতো একটা ঘটনা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অসলেশা বাগাডিয়া-র মতে, ''যখন একজন মহিলার উপর বিয়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় তখন গোপনীয়তা বা সাহায্যের দিক থেকে নতুন পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে''
জটিল পরিস্থিতি বা সমস্যা লুকিয়ে রাখার জন্য মহিলারা প্রায়শই ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। যখন তার সঙ্গে নতুন পরিবেশের চাপ যুক্ত হয় তখন মহিলাদের মধ্যে মানসিক অসুখ আবার মাথাচাড়া হয়ে ওঠে। যদি পরিবেশের চাপ নাও থাকে তাহলেও শুধু ওষুধ খাওয়া বন্ধ করার জন্য মানসিক অসুস্থতার জন্ম হতে পারে।
যদি একজন বিবাহিত মহিলার মধ্যে বিয়ের আগে থেকেই কোনও মানসিক সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সেই সমস্যার জন্য বিয়ের পর সন্তানধারনের ক্ষেত্রেও মহিলাদের অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
কিন্তু এই সমস্যার মোকাবিলার ক্ষেত্রে মহিলার পরিবারের সাহায্য একান্ত জরুরি। এক্ষেত্রে ম্যাথিউ-এর সুপারিশ হল- ''নতুন জীবনে প্রবেশ করে যতক্ষণ না একজন সম্পর্ক রক্ষার জন্য স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও কিছুকেই নিজের অধিকার বলে ভাবা বা স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে করা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে ধৈর্যের সঙ্গে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। একটা বিয়ে কখনও মানসিক স্বাস্থ্যর সমস্যার সমাধান করতে পারে না। অসুখের বিষয়ে নিজের সঙ্গীকে ওয়াকিবহাল করা জরুরি। আর এজন্য প্রয়োজন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একসঙ্গে কাউন্সেলিং করা।''