নিজের দৈহিক ভাবমূর্তি নিয়ে আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক অনুভূতি রয়েছে। আর এই জন্য আমি খুব দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগি। তাই আমি সবসময়ে বলি যে যতটা সম্ভব নিজেকে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করব আমি। ছোটবেলায় আমার দৈহিক ওজন প্রয়োজনের তুলনায় মোটেই বেশি ছিল না এবং এই বিষয়টা নিয়ে আমি নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগতাম না। তবে অধিকাংশ বাচ্চাই তাদের দৈহিক আকার-আয়তন নিয়ে লজ্জা বোধ করে না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, প্রায় তেরো বছর বয়সে পৌঁছে আমি মোটাসোটা, গোলগাল হতে শুরু করি। নাদুসনুদুস বাচ্চাদের যেমন অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তেমন আমাকেও স্কুলে অনেক নির্যাতন করা হয়েছিল। আমি নিজের দৈহিক গঠনকে ঘেন্না করতে শুরু করি। আমার শরীরের মেদবহুল অংশগুলো দেখে খুব রাগ হত। সেই সময়ে আর পাঁচজন স্বাভাবিক বাচ্চার মতো আমার দৈহিক গঠন ছিল না। কিন্তু এরকম অবস্থা আমার ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত চললেও তার পর থেকে নিজের দৈহিক আকার-আয়তনের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও চরম মনোভাব জন্মায়।
বয়ঃসন্ধিকালে আমার হাতে প্রচুর লোম জন্মেছিল। স্থূলকায় শরীর থেকেও এই অতিরিক্ত লোম আমার আরও বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। আমি কিছুতেই এই সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। আমি লোম তুলে হাত-পা পরিষ্কার করতে শুরু করেছিলাম। ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের লোকেরা আমার অতিরিক্ত লোমে ঢাকা পা দুটোর দিকে বারবার চেয়ে দেখত। এই জন্য আমি ছোট প্যান্ট-জামা পরতে পারতাম না। কারণ সেগুলো পরলে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যেতাম। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে ঘেন্না করতাম। আর ভাবতাম কীভাবে নিজেকে একটু সুন্দর, ভদ্রস্থ করে তুলতে পারব। খুব ব্যথা সহ্য করেও আমি লোমগুলো তোলার চেষ্টা করতাম। ফলে আমার ত্বকের যথেষ্ঠ ক্ষতি হয়েছিল। মাঝে মাঝে লোমগুলো আমি পুড়িয়েও দিতাম। এর সঙ্গে আমি এতটাই মোটা ছিলাম যে আমাকে মানুষরূপী দৈত্য বলে মনে হত। আর এজন্য আমি নিজের জামা খুলতেও সাহস পেতাম না। প্রত্যেকবার যখন আমি সুইমিং পুল বা সমুদ্রের ধারে যেতাম তখন অস্বস্তি হলেও আমি একখানা টি-শার্ট বা গেঞ্জি পরে থাকতাম। জামা ছাড়া জলে নামার যে আনন্দ তা আমি কখনোই উপভোগ করতে পারতাম না। কেউ যদি আমার গায়ে, পিঠে বা বুকে হাত দিত বা আমায় জড়িয়ে ধরত তাহলে আমার খুব অস্বস্তি হত। কারণ কেউ আমার কোমর বা বুকের দিকে জমা চর্বির প্রতি নজর দিলে আমার অত্যন্ত বিরক্ত বোধ হত।
ঘটনাক্রমে আমার সঙ্গে একজন অত্যন্ত ভালো মেয়ের পরিচয় হয়েছিল আর সে আমাকে আমার দৈহিক গঠন সংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করতে অনেক সাহায্য করেছিল। মেয়েটি আমার শরীরের অতিরিক্ত লোম, জমা চর্বি বা অন্য কোনও কিছুকেই পাত্তা দিত না। আমি যেমন দেখতে ছিলাম ঠিক সেই মানুষটাকেই মেয়েটি ভালোবেসেছিল। এই ঘটনা আমার জীবনে এক পরম প্রাপ্তি ছিল। এর ফলে আমি কোনও ভুল কাজ করে বসিনি। সে কখনও আমায় মিথ্যে কথা বলেনি। সে জানত যে আমার শরীরে অতিরিক্ত লোম রয়েছে। তবু সেটা তার কাছে কোনও সমস্যার কারণ ছিল না। সে কখনও বলেনি যে আমি একজন মোটা মানুষ। কারণ তার চোখে আমি ছিলাম শুধু নাদুসনুদুস বা গোলগাল একটা লোক। তাতে তার কোনও সমস্যা হত না। হতে পারে যে আমি স্থূলকায়, বেঢপ ছিলাম না। কিন্তু আমার নগ্ন শরীরটা আমার চোখে খুব অসুন্দর বলে মনে হত এবং আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না যে মেয়েটি আমার মধ্যে ঠিক কী দেখেছিল।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার দৈহিক উচ্চতাও ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং আমার ভালোবাসার সম্পর্কও আরও দৃঢ় হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে আমি আমার শরীরে গজিয়ে ওঠা অতিরিক্ত লোম নিয়ে চিন্তাভাবনা করা ছেড়ে দিই এবং যতটা সম্ভব আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। ওজন কমানোর জন্য আমি খুব পরিশ্রম করতে থাকি এবং এর ফলে আমার দৈহিক ওজন অনেক কমে যায়। এই ঘটনা আমাকে অন্য কাজে মনোনিবেশ করতে খুবই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এভাবে একবছরের মধ্যে আমার শরীরের ওজন ক্রমশ কমে যায় এবং আমার হাতগুলোও মসৃণ হতে থাকে। কিন্তু তখনও আমার শরীরে একপ্রকার চর্বির আস্তরণ ছিল যার জন্য আমার মধ্যে তীব্র ঘৃণা বোধ জন্মাত। তাই জামা না পরে যখন আমি আয়নার সামনে দাঁড়াতাম তখন নিজেকে কেমন দেখত ছিল ভেবে রাগ করতাম এবং প্রার্থনা করতাম যে আগের অবস্থাটা যেন আর আমার জীবনে সত্যি না হয়। অর্থাৎ এইসময়ে আমার চারপাশের মানুষজন আমাকে বলত যে আমি এখন এতটাই রোগা হয়ে গিয়েছি যা সত্যিই অভাবনীয় ব্যাপার এবং এই অবস্থায় আমার প্রয়োজন আরেকটু ওজন বাড়ানো। ভাগ্যের কী পরিহাস! কারণ আমি তখন মোটেই হাড় জিরজিরের মতো বা কম ওজনবিশিষ্ট ছিলাম না। এইসময়ে আমার মুখ, হাত বা পায়ের যে গড়ন হয়েছিল, তা কয়েকবছর আগে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায় ছিল। ওইসময়ে আমি একটা সত্যি উপলব্ধি করলাম যে কাকে কীরকম দেখতে তা নিয়ে চারপাশের মানুষজন নিজেদের মতো নানারকম অসম্মানজনক, হেয় মন্তব্য করে থাকে। তাই এবিষয়ে বিরক্তি না দেখিয়ে আমার প্রয়োজন নিজেকে আরও মজবুত বা উন্নত করে গড়ে তোলা। তখন আমি জিমে ভর্তি হলাম এবং ম্যারাথনের মতো দৌড়তে লাগলাম। এখন আমি পুরোদমে সুস্থসবল একজন মানুষ। একবছর পরে ওজন বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমার আর তেমন আগ্রহ ছিল না তাই আমি জিম করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখনও মাঝে মাঝে দৌড়ই আর অল্পস্বল্প শরীরচর্চা করি। কারণ নিজের শরীরকে আমি একটা আদর্শ শরীর হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। তবে আমি একথা বলছি না যে নিজের দৈহিক গঠন নিয়ে আমার যে সমস্যা ছিল তা পুরোপুরি সমাধান হয়ে গিয়েছে। এই সমস্যার মধ্য দিয়ে আমি অনেকসময় কাটিয়েছি। এখনও গায়ে জামা না পরলে আমার মনে অনেক দ্বিধা হয়। যখন কোনও কোনও সময়ে আমি অভিযোগ করি যে আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি তখন আমার চারপাশের মানুষজন আমায় এমনভাবে দেখে যেন আমি একজন আস্ত পাগল এবং তারা ভাবে যে আমি যেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এমন আচরণ করছি। কিন্তু আগের থেকে বাস্তবটা এখন আমার কাছে অনেক আলাদা।
এভাবে আমি জীবনে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। আগের থেকে আমি এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং দু'বছর আগের থেকেও এখন আমি আমার দৈহিক গঠনের সঙ্গে নিজেকে আরও বেশি পরিমাণে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি। সৌভাগ্যক্রমে আমার মধ্যে খাদ্যাভ্যাসজনিত কোনও সমস্যা গড়ে ওঠেনি। আমি আমার রুচি মতো যা খেতে ইচ্ছে হয় তাই খাই। খাওয়ার ফলাফল নিয়ে আদৌ চিন্তিত হই না। মাঝে মাঝে গায়ে জামা না পড়ে সাঁতার কাটতে যাই এবং তা নিয়ে অন্যান্যরা কে কী বলছে সে বিষয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। যদি আমি চাই তাহলে সমুদ্রের ধারে একটা সুন্দর দিন কাটাতে পারি বা বাড়ির চারপাশে একটা তোয়ালে পরে হাঁটতেও পারি। এখন আমি নিজের মতামত অনুযায়ী নিজের দৈহিক গঠন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি। আমি চাই যে যারা আমার মতো মোটাসোটা, যাদের শরীরে আমার মতো অনেক লোম রয়েছে অথবা দেহের অন্যান্য কিছু গঠনের জন্য যারা অন্যের কাছে হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায় তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে। কারণ আমি বিশ্বাস করি এসব সমস্যা একদিন আমার জীবনেও ছিল। আমাকে কেমন দেখতে লাগা উচিত তা নিয়ে আমার মনে অনেক প্রত্যাশা রয়েছে এবং আস্তে আস্তে আমি সেই প্রত্যাশা পূরণ করব বলেও আমার বিশ্বাস।
প্রবন্ধটি ব্যাঙ্গালোরের একজন আইটি বিশেষজ্ঞ কৌশিক রবি কুমারের লেখা।