যখন মহিলাদের ঋতুচক্র শেষ হয়ে আসে তখন তাকে মেনোপজ বলা হয় (এই প্রবন্ধে যে তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছে তা ট্রান্সমেন বা রূপান্তরকামী পুরুষ, ইন্টারসেক্স বা আন্তঃলিঙ্গ এবং জেন্ডারকুয়্যার বা বিচিত্রলিঙ্গদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য)। মেনোপজের বছরটাই মহিলাদের নিশ্চিত করে জানান দেয় যে এই বছরের পরেই তাদের ঋতুস্রাব পাকাপাকিভাবে বন্ধ হতে চলেছে। বন্ধ হওয়ার আগের পর্যায়টাকে বলা হয় পেরিমেনোপজ। এইসময়ে মহিলাদের শরীরে কয়েকটি হরমোনের উত্থান ঘটে এবং সেগুলোর ওঠা-পড়া চলতে থাকে। হরমোনের এই তারতম্য মহিলাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করে এবং তার ফলে তাদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। পেরিমেনোপজাল পর্যায়টিকে নিয়ে মেনোপজের প্রক্রিয়াটি পাঁচবছর ধরে চলে।
যাদের মেনোপজ দেখা দিয়েছে, সেসব অধিকাংশ মহিলাদের নানারকম দৈহিক ও মানসিক উপসর্গের সাথে লড়াই করতে হয়। কিছু কিছু মহিলাদের ক্ষেত্রে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এই পর্যায়ের প্রভাব পড়তে দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রে এইসময়ে মহিলাদের দৈহিক নানারকম বাধার মুখোমুখি হতে হয়। মেনোপজের সময়ে কর্মক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয় সেগুলোর অধিকাংশের কারণ হল নিয়োগকর্তা ও কর্মচারী- দু'পক্ষের সচেতনতার অভাব।
মেনোপজ ও তার উপসর্গগুলো সম্পর্কে যখন নিয়োগকর্তাদের সঠিক শিক্ষা ও সচেতনতা জন্মাবে তখন তারা খুব সহজেই তাদের সেইসব কর্মচারীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে সক্ষম হবে, যারা মেনোপজের সময় শারীরিক ও মানসিকভাবে একপ্রকার লড়াই-এর মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করে। সেই সঙ্গে তারা যাতে ভালোভাবে কাজ করতে পারে সেক্ষেত্রেও সহায়তা করা নিয়োগকর্তাদের একান্ত কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া জরুরি।
দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন
ইন্ডিয়ান মেনোপজ সোসাইটি সারা ভারতে মেনোপজ নিয়ে যে সমীক্ষা চালিয়েছে তাতে দেখা গিয়েছে ভারতীয় মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজের গড় বয়স ৪৬.২ বছর। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে মেনোপজের লক্ষণ চল্লিশের আগেই বা ঠিক পরে দেখা দিতে পারে।
এইসময়ে ঋতুস্রাবের ধরনে কম-বেশি অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ঋতুস্রাবের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে এবং শেষমেশ তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। রক্তপাত বেশি হওয়ার ফলে ক্লান্তি এবং শারীরিক চাপ দেখা দেয়। গা জ্বালা করে। এছাড়া ঘুমের সমস্যা দেখা যায়। এইসময় হয় মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যায় আর না-হয় বহুক্ষণ ধরে ঘুমাতে দেখা যায় মহিলাদের।
মেনোপজের সময়ে মানসিক দিক থেকে মহিলাদের মধ্যে নানা রকম লক্ষণ জন্মাতে দেখা যায়, যেমন - ঘন-ঘন মেজাজ-মর্জির বদল, রাগ (এটি পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে), একাকিত্ব, শূন্যতা বোধ হওয়া (এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম), অসন্তুষ্ট মনোভাব, খিটখিট করা, সন্দেহ বা অবিশ্বাসের মনোভাব এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবসাদ (বিশেষ করে যারা আতঙ্কের শিকার হয়, সম্পর্কজনিত সমস্যার শিকার হয়, একাকিত্বে ভোগে বা একজন পরিচর্যাকারী হিসেবে কাজ করে)।
তবে এই পরিবর্তন প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা-আলাদা হয়। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ শৈব্যা সালদানহা-র মতে, ''অধিকাংশ মহিলার জীবনে মেনোপজ একপ্রকার স্বাধীনতার স্বাদ এনে দেয়। এটা সেইসময়, যখন তারা সত্যিই নিজেদের এবং তাদের চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তাগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে।''
সাংস্কৃতিক বাধা, সচেতনতা এবং রূপান্তর
যেসব মহিলারা সমাজে নেতৃত্ব দান করেন তাঁরা আশা করেন যে মেনোপজের সময়েও তাঁরা তাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা বজায় রাখতে পারবেন অথবা যদি তাঁরা মেনোপজের সময়ে হওয়া সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তাহলে তাঁদের নিজেদের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে বলা হয়। কাউন্সেলর লিনেট নাজারেথ, যিনি আগে এমপ্লয়ি অ্যাসিসট্যান্স প্রোগ্রাম (ইএপি)-এর একজন পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি জানিয়েছেন, ''সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই পর্যায়টিকে আমরা অনেক গভীরভাবে বিবেচনা করতে পারি। ভারতীয় মহিলারা মেনোপজকে জীবনের একটি অংশ বলে ভাবনাচিন্তা করে মাত্র এবং এই বিষয়টা নিয়ে তেমন আলাপ-আলোচনাও করে না তারা।''
মহিলাদের উচিত নিজেদের দৈহিক অবস্থান এবং মেনোপজের বিষয়ে শিক্ষিত ও সচেতন হওয়া। এজন্য তাদের প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এর ফলে তারা নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্যকে ভালভাবে বুঝতে সক্ষম হবে।
মেনোপজের সময়ে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য যে মহিলাদের মানসিক পরিবর্তন ঘটে, তা চিহ্নিত করার জন্য তাদের নিজের প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল হওয়া জরুরি। এটা সেই সময় যখন একজন মহিলার নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন এবং নিজের শরীরের বদলগুলোকে মেনে নিতে শুরু করাও দরকার। কর্মক্ষেত্রে মেনোপজের বিষয়ে মহিলাদের শিক্ষিত করা এবং তাদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়াও একান্ত জরুরি।
নিজের জন্য আপনি কী করতে পারেন
যদি আপনার জীবনে মেনোপজ পর্যায় চলে তাহলে নিম্নলিখিত উপায়ে আপনি নিজের যত্ন নিতে পারেন-
নিয়মিত শরীরচর্চা, যোগব্যায়াম (উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে, মানসিক আতঙ্কের আঘাত নিয়ন্ত্রণ করে) অথবা ধ্যান- এগুলোর মধ্যে যেটা করলে আপনি সুস্থ থাকতে পারবেন তা অনুশীলন করা একান্তই জরুরি। এগুলো আপনাকে আরাম ও স্বস্তি দিতে সাহায্য করে। নিজের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনকে মেনে নিতে শিখুন। যখন এই বদলগুলো দেখা দেবে তখন নিজেকে মনে মনে বোঝান ও বলুন যে আপনার জীবনে সব ঠিক আছে।
আপনি আপনার মূল্যবান সময় স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে ব্যয় করুন। পরার্থপরতা অর্থাৎ পরের জন্য কিছু করার মধ্যে দিয়ে নিজে সুস্থ থাকা যায়।
এমন মানুষের সঙ্গে সময় কাটান যারা মেনোপজ পর্বকে ভালোভাবে বোঝে ও জানে।
যদি দরকার হয় তাহলে কাজের সময় বাড়ানো-কমানো বা আগে-পিছে করার ব্যবস্থা করুন।
ভালো থাকার প্রতি যত্নবান এমন সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দিন।
নাজারেথ বলেছেন, ''মহিলাদের জন্য এইসময়ে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল অবসর সময় কাটানো বা কাজ থেকে বিশ্রাম নেওয়া। এই বিষয়টা একেকজনের কাছে এক-একরকম হয়, এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো কাজের সময়ে পরিবর্তন ও ছুটির ব্যবস্থা করুন। এক্ষেত্রে নিয়োগ কর্তাদের সংবেদনশীলতা সবচেয়ে জরুরি বিষয়।''
মেনোপজের সময়ে আপনার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারে-
মেনোপজ মহিলাদের জীবনে একটি সাময়িক পর্যায়, যেখানে সঠিক সাহায্য পাওয়া গেলে সমস্যার মোকাবিলা করা সহজ হয়। কর্মক্ষেত্রে একজন মহিলা কর্মীকে মেনোপজের সময়ে নিম্নলিখিত উপায়ে সাহায্য করা যেতে পারে-
সমানুভূতি দেখানো
কাজের পরিবেশে বিভিন্ন চাপ কমানোর চেষ্টা করা
নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিশ্রামকক্ষ থাকা জরুরি
প্রয়োজন মতো কাজের সময়ের পরিবর্তন বা অদল-বদল ঘটানো দরকার
বেশি রাত পর্যন্ত কাজ করা বা বহুক্ষণ ধরে কাজ করার প্রত্যাশা না রাখা
মহিলা কর্মীরা যাতে নিজেদের কাজের ধরনের পরিবর্তন করতে পারে তার জন্য তাদের সুযোগ করে দেওয়া। যদি তারা চায় তাহলে তাদের উপর অপেক্ষাকৃত হালকা কাজের দায়িত্ব দেওয়া বা নির্দিষ্ট এই সময়কালের জন্য কম চাপ রয়েছে এমন কাজের সুযোগ করে দেওয়া
তাদের সাহায্য করা বা একটা সাহায্যকারী দল গড়ে তোলা
কাজের থেকে তারা যেন নিয়মিতভাবে অবকাশ পায় সেই দিকে নজর রাখা
মেনোপজের সমস্যাগুলি ভালোভাবে বোঝেন এমন মহিলা কর্মীদের সাহায্য নিয়ে লিখিত গাইডলাইন তৈরি করা
মহিলা কর্মীদের প্রয়োজন মতো বাড়ি থেকে অফিসের কাজ সম্পূর্ণ করার অনুমতি দেওয়া। এক্ষেত্রে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া, পুরো দিনের বদলে অর্ধেক দিনের মধ্যে বাড়িতে বসে অফিসের কাজ শেষ করার ব্যবস্থা করা
এই প্রবন্ধটি লিখতে সাহায্য করেছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ শৈব্যা সালদানহা, কাউন্সেলর লিনেট নাজারেথ, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট ঋতু চৌহান এবং সিনিয়র আইটি লিডার বন্দনা মালাইয়া।