জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা মিলেমিশে কীভাবে আমাদের সামগ্রিক মানসিকতাকে প্রভাবিত করে সেটা বেশ ইন্টারেস্টিং। কিছু অনেক, অনেক বছর পুরনো, আর কিছু যেন গতকাল ঘটেছে। কিন্তু শুনে যত অদ্ভুত মনে হোক না কেন, এই বোধ আপনার মধ্যে তখনই জাগে যখন আপনি জীবনের পুরনো অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করে, মেনে নিতে শুরু করেন, আর নিজের বর্তমান জীবনে এর ভূমিকা যাচাই করে দেখেন। এই বোধ আমার মধ্যে সাইকোথেরাপির সময় জাগে। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয় সাময়িকভাবে ভোঁতা হয়ে থাকা গোপন দুঃখকে খুঁড়ে বার করা, কিন্তু যা এখনো আমার মধ্যে এখনো জীবিত রয়েছে, আমি নিজেকে কোন চোখে দেখি, আর কীভাবে নিজের সাথে কথা বলি। আমার মনের একটি বড় ভাগ জুড়ে রয়েছে আমার শরীরের সাথে আমার সম্পর্ক।
যতদূর মনে পড়ে, প্রথম থেকেই আমার শরীরের সাথে আমার সম্পর্ক তিক্ত ছিল, আর সেটা এখনো চলে যাচ্ছে। রোগা বাচ্চা হওয়ার কারণে নানা রকমের ‘নিরীহ’ উক্তি, যেমন ‘হাড্ডি’, ‘হ্যাঁগার’, ‘কঙ্কাল’, ‘টিকটিকি’, ইত্যাদি প্রায়ই আমার দিকে ছুঁড়ে মারা হত। বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে আমাকে বারবার নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর কৃমি থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা ধরণের চিকিৎসা করা হয়েছে, কিন্তু কিছুই বদলায়নি। আমার শরীরের গঠনের জন্য হামেশাই আমাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করা হত, বিশেষত তখন যখন আমি এমন কোনও কাজ করতাম যেটায় দ্রুতগতিতে এবং সুসংগত শারীরিক সঞ্চালনের প্রয়োজন হত। একবার এক কাজিনের বিয়ের সময় সবাই আমাকে দেখে ঠাট্টা করছিল কারণ আমার শরীর নাকি ‘কাঠখোট্টা’, আর আমাকে দেখতে ‘এক বাণ্ডিল হাড্ডির’ মতো। এটা রীতিমত একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল; যখনই আমার ভাইবোনেরা একসাথে হত তারা আমার নাচের ভিডিও চালিয়ে আমাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করতে শুরু করত, আর আমি এই নিয়ে দুঃখ পেয়ে কাঁদতে শুরু করলে আমাকে ‘ছিঁচকাঁদুনে’ বলে ডাকতো। অন্য সময় আমাকে বলা হত যে জামাকাপড় আমার শরীরের উপর ‘ঝুলে’ থাকে, এবং কোনও আকার ধারণ করে না, কারণ আমার শরীর ‘চ্যাপ্টা’।
এর ফলে আমার আত্মবিশ্বাস এতটাই কমে গিয়েছিল যে আমি শারীরিক হেলদোল যুক্ত কোনও কাজ করতে চাইতাম না, যেমন নাচ, খেলাধুলো বা ব্যায়াম করা। আমার জোরে-জোরে হাঁটতে ভালো লাগত, কিন্তু সেটা নিয়ে আত্মবিশ্বাস অনুভব করতেও আমার অনেকটা সময় লেগেছে।
অন্যরা আমাকে দেখতে কেমন তা নিয়ে ব্যাঙ্গক্তির ধারালো ছুঁচ ফোটানোর আগে কখনো ভাবেনি। কেউ জিজ্ঞেস করত যে আমার মা আমাকে খেতে দেয় কি না, অন্যরা কিশোরীবয়সে আমার ভাবী স্বামীর দুর্ভাগ্য নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করত কারণ আমার শরীর তো চ্যাপ্টা, স্তন-ও নেই। অযাচিত জ্ঞানেরও অভাব ছিল না। তার মধ্যে যেটা আমার ভালো মনে আছে কারণ সব থেকে হাস্যকর মনে হয়েছিল সেটা হল “অদিশী, তোকে দেখতে এত সুন্দর। তুই প্যাডেড ব্রা পরতে শুরু করে দে। দেখবি কেমন সেক্সি লাগবে তোকে।”
নিজের শরীর নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাবের প্রভাব আমার জীবনের সব ক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এর সাথে যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠেছিল। নিজের শরীর নিয়ে বোধের অভাবের পাশাপাশি পরিস্থিতি আর সীমারেখা নির্ধারণ না করতে পারার কারণে আমার সাথে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেতে শুরু করে। এর প্রভাব আমার শরীর আর মন দুইয়ের উপরই পড়তে থাকে।
স্কুলের গণ্ডি যখন সবে পেরিয়েছি আমার ওজন হঠাৎ করে বেড়ে যায়। আমার দৃঢ় ধারণা যে এর মুখ্য কারণ ছিল স্কুল জীবনের অত্যন্ত কষ্টকর (যেখানে আমাকে অল্পস্বল্প ভয়-ও দেখানো হত) আর অপ্রয়োজনীয় বোঝাগ্রস্ত পরিবেশ থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। হঠাৎ করে আমার শরীরকে সবসময় ঘিরে থাকা সমস্যা যেমন পেটে আর গায়ে ব্যাথা, জ্বর-জ্বর ভাব, দুর্বলতা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো রোগ উধাও হয়ে গেল।
কিন্তু এত বছর ধরে মানসিক চাপ আস্তে-আস্তে বেড়ে উঠেছিল এবং আমি বুঝতে পারলাম যে হয়তো আগে থেকে ছিল বা কোনও এক সময় থেকে আমার মানসিক ভারসাম্য স্বাভাবিক ছিল না। ২০১৫তে যখন তা একেবারে তলানিতে ঠেকল তখন অনেকেই আমাকে বলতে শুরু করল যে দিনে অন্তত এক ঘণ্টার জন্য আমার ব্যায়াম করা উচিৎ। ওরা সবাই জানতো যে আমি ব্যায়াম করি না, কিন্তু এটা জানতো না যে কেন করি না। আমি রোজ হাঁটতে যাওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলাম, কিন্তু কোনও কোনও দিন সেটাও খুব কষ্টসাধ্য হয়ে উঠত, আর আমি কিছুতেই সেটাকে বদলাতে পারতাম না।
এবার চলে আসি ২০১৭য়। এখন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করার কারণ হল আমার ওজন প্রচুর বেড়ে গিয়েছে, আর এখন আমাকে নিয়মিতভাবে শুনতে হয় যে সময় থাকতে এর প্রতিকার করা উচিৎ। যখন রোগা ছিলাম তখন যে ধরণের অদ্ভুত উক্তি আমাকে শুনতে হত এখনো তেমনই কিছু চলছে, যেমনঃ “দেখে মনে হচ্ছে কেউ তোমাকে বেলুনে হাওয়া ভরার মতো ফুলিয়ে দিয়েছে।” সারাক্ষণ ব্যায়াম করার পরামর্শ আমাকে শুনতে হয়। তবে ভাগ্যিস আমার পরিবারের সদস্যরা জানে যে আমাকে এই ধরণের কথা বললে আমার অস্বস্তি হয়, তাই তাঁরা আমাকে নিজের মতো করে থাকতে দেয় (হাহ!)। কিন্তু আমি মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে ব্যায়ামের গুরুত্বের কথা জানি। তবুও ব্যায়াম করা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি তার কারণ মানুষের মনে আদর্শ চেহারা বা শারীরিক গঠন নিয়ে যে ধরণের ধারণা রয়েছে, তারা কখনো বলে না যে আমার শরীরকে সুস্থ রাখা প্রয়োজনীয়। আমি সবসময় দ্বন্দের পরিবেশে থাকি এবং স্বাভাবিক ভাবেই হতাশ হয়ে পড়ি।
এই যুদ্ধ অবিরাম আর আমার মনে হয় এমনটাই চলবে। কিন্তু যেমন এমন অনেক কিছু আছে যা আমাদের ভেঙে দিতে পারে, তেমনই আরও কিছু আছে যা আমাদের সাহায্য করে ধ্বংসের কারণ বুঝতে, তাকে জড়িয়ে ধরতে আর নিজের সাথে বয়ে বেড়াতে। নারীবাদ, সহমর্মী অনলাইন বন্ধুরা আর সাইকোথেরাপি আমায় বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। তারা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় যে নিজের যত্ন নেওয়াটাই সর্বোপরি।
এই বর্ণনাটি শারীরিক ধারণা আর মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি ধারাবাহিকের অংশ। আপনি এই কথোপকথনকে ফলো করতে পারেন টুইটার ও ফেসবুকে #ReclaimOurselves এর মাধ্যমে।