মহিলা

ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হিংসা বলতে কী বোঝায়?

ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স (আইপিভি) বা জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষের হিংসা বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার অর্ন্তগত। প্রতিরোধযোগ্য এই সমস্যাটির কুপ্রভাবের দ্বারা পৃথিবীব্যাপী লাখ লাখ মহিলা আজ আক্রান্ত

ডা. ব্রান্দা এম এন

২০১০ সালে 'হু' বা ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স মানুষের এমন একটি আচরণ, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে মূলত আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কগুলির মধ্যে। এর ফলে আমাদের শারীরিক, মানসিক এবং যৌন সপম্পর্কগুলির বন্ধন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এহেন আচরণের মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি মারমুখো হয়ে ওঠে, তার মধ্যে যৌন নির্যাতন ও মানসিক নিপীড়ন করার প্রবণতা এবং সংযত ব্যবহারের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এহেন হিংসাত্মক  মনোভাব জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বয়স, যৌন প্রবৃত্তি এবং ব্যক্তি নির্বিশেষে প্রতিফলিত হয়। এই ধরনের ঘটনা দম্পতি, একছাদের তলায় বাস করা দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ বা অন্য যে কোনও নিবিড় সম্পর্কের মধ্যে ঘটে থাকে। যে কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি এবং সব রকমের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মানুষ এই ঘটনার প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়।

মহিলাদের প্রতি যে অত্যাচার ঘটে, তা-ও একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। দি ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ (এনএফএইচএস-৩) সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মহিলা ভয়াবহ শারীরিক হিংসার শিকার। অন্যদিকে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জনকে সহ্য  করতে হয় যৌন নির্যাতন। এছাড়া একজন বিবাহিত মহিলাকে প্রতিনিয়ত তার স্বামী বা পরিবারের অন্য কারও দ্বারা শারীরিক অথবা যৌন আক্রমণের শিকার হতে হয়। এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রতি ৬ জন বিবাহিত মহিলার মধ্যে ১ জনকে তার স্বামী মানসিক ভাবে নিপীড়ন করে।

যে সব মহিলারা ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স বা আইপিভি-র শিকার, তাদের মধ্যে গভীর এবং লাগাতার মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া খুব বেশি মাত্রায় মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, নিজেকে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রবণতা, সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডার, কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্টস, সাবস্ট্যান্স আবিউজ এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এই মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়।

আইপিভি-তে আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা বা ঝুঁকি অত্যন্ত প্রবল। যে সব মেয়েরা তাদের কাছের মানুষের দ্বারা মারাত্মক হিংসার শিকার হয়,   তারা কোনোভাবেই এই দমনমূলক সম্পর্ক থেকে দূরে যেতে পারে না। কারণ অধিকাংশ মহিলার মনেই ভয় থাকে যে, যদি তারা অত্যাচারী সঙ্গীকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সেই সঙ্গী ঠিক তাদের খুঁজে বের করবে এবং আবারও ক্ষতি করতে উদ্যত হবে। এই পরিস্থিতিতে বিবাহিত মহিলারা তাদের সন্তানের কথা ভেবেও দিশাহারা বোধ করে। স্বামীর আচরণে পরিবর্তন আসবে এই আশায় দিন গুনতে গিয়ে বিবাহিত মহিলারা উত্তরোত্তর বেড়ে চলা অত্যাচারের শিকার হতে শুরু করে।

শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ উভয়েই মহিলাদের এহেন সমস্যা থেকে মুক্ত করতে যথাযথ পরামর্শদানের মধ্যে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই উপযোগী এবং কার্যকরী মানসিক চিকিৎসা বা সহায়তাদানের নির্দিষ্ট অভিমুখগুলি হল —

  • বিহেভিয়ারাল ডোমেন বা আচরণগত স্থিতিশীলতা প্রদান — এর মাধ্যমে আক্রান্তের মানসিক নিরাপত্তা বোধ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয়।

  • কগনিটিভ ইন্টারভেনশনস্‌ -- এর সাহায্যে অত্যাচারিতার মনে হিংসা, পারসেপশন, কগনিটিভ আচরণ, আত্মবিশ্বাস, প্রত্যাশা, নিজের কার্যক্ষমতা এবং গুণ বিষয়ক কার্যকারণ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণার জন্ম হয়।

  • সাইকোলজিকাল ইন্টারভেনশনস্‌ -- এহেন মনোগত সহায়তার মূল উদ্দেশ্য হল হিংসার দ্বারা সংকটাপন্ন ব্যক্তিদের উদ্বেগ, অবসাদ, ট্রমা এবং সবরকম মানসিক বিপর্যয়ের থেকে রক্ষা করা।

এছাড়া, সামগ্রিকভাবে সমাজের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা আক্রান্তদের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে পারে। এই সর্বাঙ্গীন সামাজিক সাহায্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিপদকালীন প্রতিষ্ঠান, ঘরের আশ্রয়, আইনি সহায়তা এবং পুলিশের হস্তক্ষেপ। এগুলি চিকিৎসার পরিপূরক অঙ্গ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

ডা ব্রান্দা এম এন নিমহানসের সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্ক (পিএসডব্লিউ) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি এবং তাঁর গড়া দল 'AWAKE' নামের একটি বিশেষ ক্লিনিক পরিচালনা করে। এই ক্লিনিক সেই সব মহিলাদের সাহায্য করে, যারা তাদের অন্তরঙ্গ সঙ্গীর হিংসা বা অত্যাচারের মাধ্যমে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই ক্লিনিক নিমহানসের সেন্টার ফর ওয়েলবিইং-এর অর্ন্তগত। এর বিষয়ে বিশদে জানতে এই নম্বরে ফোন করতে পারেন। নম্বরটি হল—০৮০-২৬৬৮ ৫৯৪৮।