কৈশোর

বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দৈহিক ভাবমূর্তির সমস্যা

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

দৈহিক ভাবমূর্তির মানে হল আমরা কীভাবে নিজেদের শারীরিক গঠনকে দেখি। দৈহিক ভাবমূর্তি নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর সরাসরি প্রভাব পড়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরতার উপর। নিজেক কেমন দেখতে তা নিয়ে যারা সন্তুষ্ট থাকে ও যারা নিজেদের বিশ্বাসে অটুট থাকে, তাদের শারীরিক ভাবমূর্তি সাধারণত ইতিবাচক হয়। অন্যদিকে, যারা নিজেদের চলন-বলন নিয়ে খুশি থাকতে পারে না বা নিজেদের মধ্যে (দেখাশোনা, অনুভূতি) বারবার বদল ঘটাতে চায়, তাদের দৈহিক ভাবমূর্তি মূলত নেতিবাচক হয়।

কখন দৈহিক বা শারীরিক ভাবমূর্তির বিষয়টা সমস্যার রূপ নেয়?

আমরা সবাই যে পুরোপুরি নিজেদের শারীরিক গঠন, চলন-বলন, চিন্তাভাবনা, বোধবুদ্ধি প্রভৃতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি, তা নয়। তবে মাঝে মধ্যেই সবারই তো মনে হয় যে চেহারার একটু রুপান্তর ঘটলে ভালই লাগত। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অসন্তুষ্টির মনোভাবটাই চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে; তখন মানুষ তার অন্যান্য দায়িত্বগুলো, যেমন- পড়াশোনা, কেরিয়ার বা দৈনন্দিন রুটিনের দিকে মনযোগ দিতে পারে না। এটাই হল দৈহিক ভাবমূর্তির সমস্যা।

এই সমস্যায় ছেলে এবং মেয়ে দুজনেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু ক্ষতির ধরনটা আলাদা হয়ে থাকে। মেয়েরা চায় নিজেদের অল্পবয়সি এবং ছিপছিপে রাখতে। আর ছেলেরা চায় নিজেদের পেশিবহুল ও পুরুষালি করে গড়ে তুলতে।

দৈহিক ভাবমূর্তি এবং বয়ঃসন্ধি

বয়ঃসন্ধি নিজেকে চেনা, জানা এবং বোঝার বয়স। সেই সঙ্গে সারা পৃথিবীর সামনে নিজেকে তুলে ধরার একটা চেষ্টাও থাকে। বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েরা নিজস্ব পরিচয় আবিষ্কার করে এবং নিজেদের শারীরিক পরিবর্তনগুলো বুঝতে চায়। একজন বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়ের উপর তার শরীরগত ভাবমূর্তির প্রভাবের পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে, যেমন- পারিবারিক পরিবেশ, টেলিভিশন, সিনেমা, বিজ্ঞাপন এবং চলতি ফ্যাশন প্রবণতা প্রভৃতি।

এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের চলন-বলন সংক্রান্ত বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে বন্ধুদের দ্বারা নিজেদের ছবি 'লাইক' করার মধ্য দিয়ে।

নিচে লেখা কিছু কারণে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে নেতিবাচক শারীরিক ভাবমূর্তি দেখা দিতে পারে:

  • কিশোর-কিশোরীদের দৈহিক গঠন নিয়ে পরিবারের সদস্যদের হাসিঠাট্টা ও নেতিবাচক মন্তব্য, যেমন- কাউকে মোটা বা বেঁটে বলে উপহাস করা

  • কাউকে তার শরীরের আকার-আয়তন নিয়ে স্কুল,কলেজে আক্রমণ করা

  • রুপোলি পর্দায় দেখা মানুষের অবয়ব বা শারীরিক গঠনকে আদর্শ বলে মেনে নিয়ে নিজেকেও সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা

  • নিখুঁত হওয়ার মানসিকতা

  • আত্মবিশ্বাস বা আত্মনির্ভরতার অভাব

  • পারিপার্শ্বিক চলমানতা এবং সুন্দর ও নিখুঁত হয়ে ওঠার জন্য কাছের মানুষের চাপ

যে সব বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের শারীরিক গঠনে কোনও না কোনও দুর্বলতা থাকে তারা সাধারণত বদমেজাজি হয় এবং সামাজিক আচার-আনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে চায়। কারণ তাদের মনে হয় যে তারা জনসমাজের সামনে বেমানান। এই ধরনের চিন্তা একনাগাড়ে চলতে থাকলে তা অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর ফলে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা, যেমন- অবসাদ, উদ্বেগ বা খাদ্য বিকার অথবা দেহবিকারজনিত সমস্যার মতো জটিল রোগ দেখা দিতে পারে।

দুর্বল বা ত্রুটিযুক্ত শারীরিক ভাবমূর্তির লক্ষণ

অভিভাবক হিসেবে বাবা-মায়েদের উচিত সন্তানের দুর্বল শারীরিক ভাবমূর্তিজিনিত সমস্যার লক্ষণগুলোর প্রতি নজর রাখা। এই লক্ষণগুলো হল-

  • বারবার আয়নায় নিজেকে দেখা আর শরীরের গঠন সম্পর্কে খুঁতখুত করা

  • সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া বা এড়িয়ে চলা

  • শরীরে ক্যালোরির পরিমাণ নিয়ে দুশ্চিন্তা বা অলীক চিন্তাভাবনা করা ও অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করা

  • অন্যের থেকে বারবার নিজেকে কেমন দেখতে লাগছে সে বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়া

  • নিজেদের দৈহিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক ভাবনাচিন্তা করা, যেমন- 'আমাকে খুব খারাপ দেখতে লাগছে' বা 'আমি চাই আমাকে আরেকটু সুন্দর লাগুক' প্রভৃতি

  • শরীরের কসমেটিক পরিবর্তনের জন্য একজন কসমেটিক শল্যবিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা

  • জিমে যাওয়া নিয়ে অলীক ভাবনাচিন্তা করা অথবা অতিরিক্ত শারীরিক স্থুলতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাচ্চারা বড়দের আচার-আচরণ অনুকরণ করতে চায়। তাই যদি অভিভাবকরা সারাক্ষণ বাড়িতে নিজেদের খাওয়াদাওয়া এবং নিজেদের চলন-বলন সম্পর্কে সচেতন থাকে, তাহলে বাড়ির বাচ্চারাও ওই আচরণকেই আদর্শ বলে মনে করে। সেই কারণে এই বিষয়ে অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সতর্ক থাকা জরুরি।

শিশুদের দৈহিক ভাবমূর্তি সংক্রান্ত ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলার জন্য অভিভাবকদের করণীয় হল:

  • দুটো বাচ্চার মধ্যে কে কেমন দেখতে তা নিয়ে তুলনা করা কখনোই উচিত নয়

  • ভাই-বোন বা তুতো ভাই-বোনের মধ্যে কোনও বিষয় নিয়ে তুলনা এড়িয়ে চলতে হবে

  • বাচ্চাদের মধ্যে থাকা অন্যান্য গুণ, যেমন - তাদের দয়ালু মনোভাব, অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা বা অন্যান্য প্রতিভার প্রশংসা করতে হবে

  • পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে শারীরিক গঠন নিয়ে কথাবার্তা বলা বা বেফাঁস মন্তব্য করা ঠিক নয়

  • দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া এবং নিয়মিত শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি

অভিভাবকদের প্রয়োজন বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে তাদের সন্তানদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা এবং তারা যাতে তাদের এই দৈহিক বদল সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার কথা অভিভাবকদের কাছে মন খুলে বলতে পারে, সে বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করা।

এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য নিমহানসের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডাক্তার পৌলমী সুধীরের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

সূত্র: