কৈশোর

কিশোর বয়সকে উপলব্ধি করা

কিশোর বয়সের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো মা-বাবার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এমন একটা সম্পর্ক যেখানে তারা মা-বাবাকে মন খুলে নির্ভয়ে সব বলতে পারবে। মা বাবা সর্বদাই সন্তানের মঙ্গল চান। এই নিয়ে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে। এতে উভয় পক্ষেরই দোষ থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারে

ডাঃ শ্যামলা বৎসা

যেরকম আগেও আমরা বলেছি, কিশোর বয়সের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো মা-বাবার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এমন একটা সম্পর্ক যেখানে তারা মা-বাবাকে মন খুলে নির্ভয়ে সব বলতে পারবে। মা-বাবা সর্বদাই সন্তানের মঙ্গল চান। এই নিয়ে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে। এতে উভয় পক্ষেরই দোষ থাকতে পারে, আবার না-ও পারে।

কয়েকটি খুব সাধারণ মনোমালিন্যের বিষয় নীচে দেওয়া হল:

  • সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে মা বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা।

  • ইন্টারনেট এবং সোশাল মিডিয়াতে বেশি সময় কাটানো।

  • বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেশি রাত অবধি বাইরে থাকা।

  • প্রেমঘটিত সমস্যা।

  • মদ্যপান, সিগারেট খাওয়া বা অন্যান্য মাদকাসক্তি।

  • মা-বাবার প্রতি অভব্য আচরণ বা মেজাজ দেখানো।

  • উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন।

  • মানসিক রোগের উপসর্গ।

এই সব সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র মা বাবা এবং সন্তানের মধ্যে সময়ের ব্যবধানে গড়ে ওঠা সুন্দর সম্পর্কের মাধ্যমেই সম্ভব। যেকোনও সম্পর্কের ভিত্তি হলো মূলত ভরসা এবং শ্রদ্ধা। শৈশবেই মা বাবার প্রতি জন্মানো ভরসাকে কৈশোর অবস্থা অবধি বজায় রাখতে পারাটাই প্রধান কাজ। অশান্তি এবং ঝগড়াঝাঁটি এড়াতে সন্তানের মনে শ্রদ্ধা থাকাটা প্রয়োজন। গায়ের জোরে সমস্যার সমাধান না করে যুক্তির আশ্রয় নিলে শ্রদ্ধা ও ভরসার সম্পর্ককে বজায় রাখা সম্ভব। এতে সন্তান অবাধ্য হবার বদলে বুঝবে যে সংসারে তাঁর মতামতের একটা দাম আছে।

কখনও কখনও মা বাবা এবং সন্তান একসাথে বসে কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেন না। সেইক্ষেত্রে তাঁরা তৃতীয় কোন ব্যক্তির সাহায্য নিতে পারেন। সাধারনত সেটা পরিবারের কোন সদস্য বা বন্ধুবান্ধব হয়। তাতেও কোন লাভ না হলে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। একটি ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যাক। গত বছর একটি ১৫ বছর বয়সী মেয়ে নিজের মা বাবার সাথে এখানে এসেছিল। সে পড়াশুনো করত না। তাঁর মা বাবা এইসবের পেছনে মেয়ের আলসেমিকেই দোষ দিতেন। কিন্তু দেখা গেল যে সে এডিএইচডি বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার‍্যাক্টিভিটি ডিস্‌র্ডারে ভুগছে। চিকিৎসার সাহায্যে সে আইসিএসইতে খুব ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করে।

যেটাকে আমরা তাঁদের অভব্য আচরণ ভাবি তা প্রতিবাদের ভাষাও হতে পারে। এঁর পেছনে অনেক সময় মানসিক সমস্যাও কাজ করে।  স্বাভাবিক ভাবেই তা অনেক মা বাবা চিনতে পারেন না। মানসিক অশান্তির ফলে অনেক সময় অল্প বয়সেই তাঁরা ধুমপান অথবা মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যা যেমন কাল্পনিক কণ্ঠস্বর শোনা বা নিজের কম্পিউটার হ্যাক হয়ে গেছে ভাবার ফলেও অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। অনেকেই নালিশ করেন যে ছেলে মেয়ে কলেজে নিয়মিত যায় না বা সারাদিন ঘুমিয়ে সারারাত ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে। কিন্তু এই সমস্যা আশলে অনেক বেশী গভীর।

আরেকটা কথা এখানে উল্লেখযোগ্য - অনেক বাচ্চারা নিজের নিজের ভালমন্দ বুঝতে পারেনা। তাই তাঁরা যেখানেই যায় একটা সমস্যা বাঁধিয়ে ফেলে। অন্যের মনোভাব বোঝা বা চারপাশের সমাজ এমনকি নিজের পরিবারের প্রত্যাশা কে উপলব্ধি করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। এই ধরনের ছেলেমেয়ের সমস্যা বুঝতে অনেক ধৈর্য এবং সময়ের প্রয়োজন। এইরকম পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের সাহায্য নিতে লজ্জা পাওয়া উচিৎ নয়। কিশোর বয়সের আচরণ একজন প্রাপ্তবয়স্কের কাছে উৎপাত মনে হলেও সাধারণ সংক্রমণ বা জ্বরের থেকে তা কোন অংশে আলাদা নয়।

যেরকম একজন সন্তান মা বাবার একমাত্র আনন্দের উৎস, সেরকমই একজন সন্তানের সব চেয়ে বড় বিশ্বাসের পাত্র তাঁর মা বাবা। তাই এই পবিত্র সম্পর্ককে অত্যন্ত যত্ন সহকারে পালন করা উচিৎ।

ডাঃ শ্যামলা বৎসা বেঙ্গালুরুর একজন মনোবৈজ্ঞানিক (সাইকিয়াট্রিস্ট), যিনি কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পেশার সাথে যুক্ত। এই সংক্রান্ত আরো লেখা এখানে পাক্ষিকভাবে প্রকাশিত হবে। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন।