Santanu
শৈশব

সন্তানের প্রস্রাব করে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার ঘটনায় আপনি কি বিব্রত?

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

দ্য লোনলিয়েস্ট রানার-এর নাম শুনেছেন আপনারা? এটা একটা আধা-আত্মজীবনীমূলক সিনেমা। মাইকেল ল্যাঙ্গডন নামক একটি বাচ্চা ছেলের শৈশবের  দিনগুলির উপর নির্মিত এই সিনেমায় ছেলেটির ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত প্রস্রাব করে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার সমস্যাজনিত লড়াইয়ের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল। মাইকেলের এই বিছানা ভিজিয়ে ফেলা বন্ধ করার জন্য তার মা পেগি আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। বিছানায় প্রস্রাব শুষে নেওয়ার জন্য তৈরি রাবারক্লথ তিনি বাড়ির জানলায় ঝুলিয়ে রাখতেন। কারণ তিনি চাইতেন মাইকেলের বন্ধুরা স্কুল থেকে ফেরার সময়ে ওই রাবারক্লথ দেখে যেন মাইকেলকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। এই ঘটনায় ভীষণ বিব্রত হয়ে মাইকেল প্রতিদিন বিকেলবেলায় স্কুল থেকে দৌড়ে বাড়ি ফিরে ওই রাবারক্লথটিকে জানলা থেকে সরিয়ে দিত। বন্ধুরা স্কুল থেকে বেরনোর আগেই সে এই কাজটি সেরে ফেলত। রাবারক্লথটি উদ্ধারের জন্য মাইকেল দৌড় শুরু করলেও পরে এই অভ্যাসটি তাকে একজন ভালো দৌড়বিদ হতে সাহায্য করেছিল। এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে এই দৌড়ের জন্য স্কলারশিপও পেয়েছিল। তবে মাইকেলের অলিম্পিকে দৌড়নোর স্বপ্ন কোনওদিনই বাস্তব হয়নি। কারণ কেরিয়ায় হিসেবে মাইকেল সিনেমার দুনিয়াকেই বেছে নেয়। আজকের পৃথিবী মাইকেল ল্যাঙ্গডনকে একজন টেলিভিশনের অভিনেতা, লেখক, পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবেই চেনে। তবে সেসব কথা ছেড়ে দিলেও একটা কথা ঠিক যে এক দীর্ঘ সময় ধরে মাইকেলের আত্মনির্ভরতা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছিল এবং জানলায় মায়ের রাবারক্লথ রাখার স্মৃতি বহুদিন ধরে তার মনে একপ্রকারের ভীষণ যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছিল।

সব অভিভাবকরাই মাইকেলের মায়ের মতো বাচ্চাদের বিছানা ভিজিয়ে ফেলার ঘটনায় এমন চরম পদক্ষেপ করে না। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অভিভাবক বা পরিচর্যাকারীরা তাদের সন্তানদের বিছানা ভিজিয়ে ফেলার বিষয়ে কীভাবে নিজেদের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন এবং সেই প্রতিক্রিয়া বাচ্চাদের মানসিক সুস্থতা বা আবেগানুভূতির উপর কীরূপ প্রভাব ফেলছে।

এই বিষয়টিকে বাচ্চাদের মৌলিক অধিকার হিসেবেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাচ্চাদের এই বিছানা ভিজিয়ে ফেলাকে এনুরেসিস বলা হয়। এর অর্থ হল অনিচ্ছাকৃতভাবে মূত্র নিঃসরণ বা প্রস্রাব করে ফেলা। দিনেরবেলায় যখন এনুরেসিস ঘটে তখন তাকে বলে ডিউরনাল (Diurnal) এবং রাতেরবেলায় ঘটা এনুরেসিসকে বলা হয় নকটারনাল (Nocturnal)। নকটারনাল এনুরেসিস বেশি দেখা যায়। এর দু'টি ভাগ রয়েছে- প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি। প্রাইমারি এনুরেসিস  একদম ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় এবং সেই সময়ে নিজে থেকে কোনও কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাদের থাকে না। অন্যদিকে, সেকেন্ডারি এনুরেসিস  একটু বয়সে বড় বাচ্চা বা বয়ঃসন্ধিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় (ক্ষেত্রবিশেষে পূর্ণবয়স্কদের মধ্যেও দেখা যায়)। এরা কয়েক মাস বা বছর ধরে আপাতভাবে স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রণের পরেও বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলে।

যদি আপনি দেখেন যে আপনার সন্তান বিছানা ভিজিয়ে ফেলছে তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে যে এই কাজটি সে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করছে না। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত এই ঘটনা ঘটা বাচ্চাদের পক্ষে স্বাভাবিক এবং অধিকাংশ বাচ্চার মধ্যেই ধীরে ধীরে স্বেচ্ছা-নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তৈরি হয়। এনুরেসিস-এর অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ব্লাডারের কর্মক্ষমতার পরিপূর্ণতা সময় মতো না হওয়া। কিছু  ক্ষেত্রে বাচ্চাদের জীবনে পরিস্থিতির বদল ঘটলে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার প্রবণতা বাড়ে (যেমন- নতুন স্কুলে যাওয়া, ভাই-বোনের জন্ম) অথবা বাচ্চারা যদি বাড়িতে বা স্কুলে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় ( যেমন- নির্যাতন, অবহেলা, বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ, স্কুলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটা, শিক্ষকদের দ্বারা শাস্তি পাওয়া বা উপহাসের পাত্র হওয়া) তাহলেও তাদের মধ্যে বিছানায় প্রস্রাব করার সমস্যা দেখা যায়।

যদি আপনার সন্তানের মধ্যে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার সমস্যা থাকে তাহলে তা সমাধান করার জন্য আপনি কীভাবে তাকে সাহায্য করবেন-

১. কখনও এর জন্য বাচ্চাকে শাস্তি বা দোষ দেওয়া উচিত নয়। নকটারনাল এনুরেসিস অচেতন অবস্থায় ঘটে এবং এর জন্য বাচ্চাকে শাস্তি দিলে তার থেকে ভালো ফল পাওয়া যায় না।

২. এমন ভাষা ব্যবহার করতে হবে যার সঙ্গে স্নেহ-মমতা জড়িয়ে থাকে। নেতিবাচক বক্তব্য থেকে দূরে থাকা জরুরি। মনে রাখতে হবে যে, রূঢ় সমালোচনা একটি বাচ্চার আত্মবিশ্বাসের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. বাচ্চাদের সামনে বাস্তব সত্য তুলে ধরতে হবে। বাচ্চাদের বোঝাতে হবে কীভাবে এই বিছানা ভিজিয়ে ফেলার ঘটনা ঘটে এবং তাদের বয়সি অন্য বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা দেখা যায়।

৪. পরিষ্কারের কাজ বাচ্চাদের দিয়ে অবশ্যই করাতে হবে। তবে এই কাজের মধ্য দিয়ে তাদের শাস্তি দিলে চলবে না। বরং পরিষ্কার করার মাধ্যমে যাতে বাচ্চারা বুঝতে পারে যে বিছানা ভিজিয়ে ফেলার ফল কী হতে পারে সেই বিষয়ে নজর রাখা জরুরি।

৫. বিছানায় প্রস্রাব করার জন্য সন্তানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা কখনোই উচিত নয়। এই ঘটনা যেন আলোচনা বা হাসি-ঠাট্টার বিষয় হয়ে না দাঁড়ায়। অন্যরাও যাতে বাচ্চাদের নিয়ে হাসাহাসি না করে সে দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। বাচ্চারা যে বিছানা ভিজিয়ে ফেলা বন্ধ করতে সক্ষম সে বিষয়ে অভিভাবকদের আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার।

৬. বাচ্চারা যদি দেখে যে বাবা-মায়েরা তাদের এহেন কাজ বন্ধ হয়ে যাবে বলে আত্মবিশ্বাসী তাহলে ছোটরাও বিছানায় প্রস্রাব করার মতো কাজ না করতে উৎসাহ পাবে। বাচ্চাদের ছোট ছোট সাফল্যগুলোকে প্রশংসা করলে আদপে তাদেরই সাহায্য  করা হয়।

৭. এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাচ্চাদের সঙ্গে একযোগে অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। রাতের খাবার খাওয়ার পর কত পরিমাণ প্রস্রাব ব্লাডারে জমা হতে পারে এবং শুতে যাওয়ার আগে যে ব্লাডার খালি করতে হয় সে বিষয়ে সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব। রাতে ঘুমানোর সময়ে বাচ্চারা যাতে একবার ঘুম থেকে উঠে প্রস্রাব করে সে দিকে সচেতন থাকতে হবে।

৮. বিছানা ভিজিয়ে ফেলা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা। তাই এই বিষয় নিয়ে অভিভাবকদের অতিরিক্ত ওয়াকিবহাল হওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমন সন্তানদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে এই কাজ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে বাচ্চাদের  সঠিক শিক্ষা দেওয়া একান্ত জরুরি।

কীভাবে বাচ্চারা বিছানা ভিজিয়ে ফেলে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে দেওয়া হল-

১. মানুষের কিডনি বা বৃক্ক মূত্র উৎপন্ন করে এবং টিউবে বা নলের মাধ্যমে তা ব্লাডার বা মূত্রথলিতে জমা হয়।

২. ব্লাডারে মূত্র জমা হওয়ার পরে মস্তিষ্কে বুঝতে পারে যে তা ভর্তি হয়ে গিয়েছে।

৩. মস্তিষ্কই বলে দেয় কতক্ষণ তা ব্লাডারে জমিয়ে রাখতে হবে এবং ঠিক কোন সময়ে বাচ্চাদের বাথরুমে গিয়ে সেই মূত্র শরীর থেকে বের করে দিতে হবে।

ঘুমের সময়ে যখন ব্লাডার এবং মস্তিষ্ক মূত্র নিঃসরণের ব্যাপারে ঠিকঠাক খবর আদান-প্রদান করে তখনই একজন বাচ্চার পক্ষে বিছানা না ভিজিয়ে যথাসময়ে বাথরুমে গিয়ে প্রস্রাব করা সম্ভব হয়।

(এই প্রবন্ধটি লিখতে নিমহানসের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডাক্তার নিথ্য পূর্ণিমার সাহায্য নেওয়া হয়েছে।)