আমি এখানে দুই ধরনের অ্যাংজাইটি বা ভীতির বিষয়ে আলোচনা করব। প্রথম ধরনটি হল, যেগুলি খুব অল্প বয়স থেকে আমাদের মধ্যে তৈরি হয় এবং বড় হওয়ার পরেও আমরা সেগুলি কাটিয়ে উঠতে পারি না। আর দ্বিতীয় ধরনটি হল, যেগুলি আমাদের সন্তান ও তাঁদের ভবিষ্যৎ ঘিরে।
প্রথম উদাহরণটির জন্য আমাকে বেশি ভাবতে হবে না। কুকুরদের ঘিরে আমার নিজের ভয়ের কথাই বলা যাক। আমি খুব ভাল করেই জানি এর সূত্রপাত কোথায়। আমার বাবা কুকুরকে খুব ভয় পেতেন। তাঁর এই ভীতির পেছনে নিজস্ব যুক্তি ছিল এবং এরকম প্রচুর ঘটনার কথা বলতেন যার কারণে তিনি কুকুর পছন্দ করতেন না। ঠিক এই কারণেই হয়তো আমার মধ্যে এই একই ভয় বংশানুক্রমে এসেছে। আমি যদিও এটি নিয়ে আলাদা করে কখনও ভাবিনি। আমার কাছে এটা একটা সাধারণ ব্যাপার। একমাত্র আমি যখন কুকুর পোষে এরকম কোনও বন্ধুর বাড়ি যেতাম তখন আমায় এই ব্যাপারটা ভাবাত। কিন্তু আমার বন্ধুটি তখন নিজের কুকুরকে অন্য ঘরে বন্ধ করে রাখত। আমার এই ভয়টা ছিল সামান্য মাত্র এবং তা কখনোই আমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কে গ্রাস করতে পারেনি।
এক সময় আমিও মা হলাম। এবার কি আমার মেয়ের মধ্যেও এই ভীতিটি জন্ম নেবে? না। তাই যখনই আমরা কোনো বাড়িতে যেতাম যেখানে পোষা কুকুর আছে আমি একটা সাহসী হাবভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতাম। যদিও আমার শরীরের মধ্যে তখনও একটা জড়তা কাজ করত। আমি হয়তো আমার মেয়েকে কুকুরটাকে আদর করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছি, কিন্ত আমি নিজে তা করে উঠতে পারতাম না। আমার স্বামীর এই নিয়ে কোনও ভয় না থাকার কারণে আমার খুব সুবিধা হয়েছিল। এর ফলে আমাদের মেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করত। সে শুধুমাত্র কুকুরদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যই ছিল না, বরং সে তাঁদের ভালবাসত এবং নিজেও একটি কুকুর পুষতে চাইত। আমিও তাই একদিন সাহস দেখিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ আমার এই সামান্য পদক্ষেপ এই প্রসঙ্গে ইতি টানতে সাহায্য করবে। আমার মেয়ের আব্দারের বশেই ঠিক তিন বছর পর বাড়িতে আনা হল সিনামন কে – পাঁচ বছর বয়সী একটি বিগল (এক প্রজাতির কুকুর)। আমার মনে আছে সেদিন সিনামন কে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আমি কাঁদছিলাম ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আমি কি কখনও নিজের বাড়িতেই আর স্বচ্ছন্দে থাকতে পারব? কিন্তু আজ তা ইতিহাস। এখন আমিও একজন কুকুর প্রেমী। এখন যখনই আমি কোনও মিষ্টি কুকুরছানা বা তাঁর ছবিও দেখি, তখনই আমার সেটিকে আদর করতে ইচ্ছে হয়। তাই আমি নিজের ওপরে খুবই গর্বিত।
কারণ আমার কুকুরের প্রতি যে বিদ্বেষ ছিল তা আজ ভালবাসায় পরিণত হয়েছে। তাছাড়া আমি আমার মেয়ের মধ্যেও কুকুর সম্পর্কে কোনও ভয় জন্মাতে দেইনি। কিন্তু এই ঘটনার পরিণতি এরকম নাও হতে পারত যদি আমি আমার নিজের ভয় সম্পর্কে সচেতন না হতাম। আমার সন্তানরা হয়ত আমার মতোই কুকুরকে ভয় পেত।
অ্যাংজাইটির দ্বিতীয় ধরনটি হল যা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। ভাল করে পড়াশুনা না করলে কি হবে? কি হবে তারা যদি পরীক্ষায় পাশ না করতে পারে? হোমওয়ার্ক বা প্রোজেক্ট যদি ঠিক সময়ে শেষ না করতে পারে? যদি তারা ভাল কলেজে ভর্তি না হতে পারে? কি ধরনের চাকরি তাদের কপালে জুটবে যদি তারা দেশের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সুযোগ না পায়?
তারা যদি জীবনে লড়াই করতে না পারে, তাহলে কি করে তাঁরা সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে? তাঁরা যদি এতটাই স্বার্থপর হয়, তাহলে তাঁরা কি করে নতুন সম্পর্ক তৈরি করবে? আশেপাশের সবাই আমাকে দায়ী করবে না তো যদি আমার সন্তান কোন সম্মানজনক পেশায় যোগদান না করতে পারে? কি হবে যদি আমার সন্তান কোন অসত সঙ্গে পড়ে? আমি না থাকলে আমার সন্তানের কি হবে? যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে? কি হবে যদি...
এরকম নানা ধরণের অ্যাংজাইটি আমাদের হয় এবং হওয়াটাও স্বাভাবিক। মা বাবার অর্ধেক জীবনটা কেটে যায় দুশ্চিন্তায়, কিন্তু আমাদের সচেতন হতে হবে যাতে এটি আমাদের পুরোপুরি গ্রাস না করে ফেলে।
সন্তানদের ভবিষ্যৎকে ঘিরে আমাদের এই অ্যাংজাইটি কি আমাদের বাঁধা দেয় তাঁদেরকে বর্তমানে সময় দিতে? আমরা তাঁদের সাথে খেলাধূলো করিনা, তাঁদের কে বেশি করে পড়াশুনো করতে বলি, যাতে পরে তাঁরা দেশের সেরা কলেজগুলিতে ভর্তি হতে পারে (যা অবশ্যই আমাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে)। সন্তানদের ভবিষৎ সুরক্ষিত করতে আমরা অর্থ উপার্জনে অনেক বেশী সময় ব্যয় করি (যা আবারও আমরা নিয়ন্ত্রন করতে পারিনা)। ফলে তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটাতে পারি না। এই সমস্যার সমাধান কী আদৌ সম্ভব।
আমার মতে সেটি করার শ্রেষ্ঠ উপায় হল তাঁদের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ না করা, যা অনেক চেষ্টা সত্বেও আমরা পারিনা। এর চেয়ে বেশী প্রয়োজন তাঁদের সাথে একটি সহজ সম্পর্ক বজায় রাখার।
আমাদের চেষ্টা করতে হবে বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এই অ্যাংজাইটিগুলোর প্রতিরোধ করার। অ্যাংজাইটির কারণগুলি আমাদের বুঝতে হবে এবং প্রয়োজন হলে এই বিষয়ে কোন এক পরামর্শদাতা বা বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুর সাথে কথা বলতে হবে। আমাদের শিখতে হবে কিভাবে মনোযোগ সহকারে বর্তমান সন্তানদের সময় দিতে পারি। সন্তানদের সাথে এমন একটি সম্পর্ক বজায় রাখুন যাতে তাঁরা আপনার ওপর ভরসা করতে পারে এবং যে কোন কাজে অসফল হলেও তা আপনাকে এসে বলতে পারে। শুধু এইটুকু জানলেই তাঁদের মধ্যে মনের মধ্যে একটি দৃঢ়তা, বিশ্বাস আর সাহসিকতা জন্ম নেবে, যা তাঁদের পুরো দমে পছন্দের বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে নির্দ্বিধায় এগোতে সাহায্য করবে।
আবারও বলছি, সম্পর্কই শেষ কথা, উপার্জিত অর্থ নয়!
মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুর একজন কাউন্সেলার, যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিকভাবে ছাপানো হবে।