কিছুদিন আগে আমি একজনকে বলতে শুনেছিলাম, সবসময় আমাদের মনে রাখা উচিত যে, পাঁক ঘেঁটে নোংরা নয়, বরং সন্ধান করতে হবে সোনার মতো দামী জিনিসের। কিন্তু এমন কথা শুনতে ভালো লাগলেও, বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটানো মোটেই তত সহজ কাজ নয়। কথাটি নিঃসন্দেহে আমাকে নাড়া দিয়েছিল এবং এর সূত্র ধরেই আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছিল পুরনো কিছু দৃষ্টান্ত, যা তখন তত মূল্যবান বলে গণ্য হয়নি ও ক্রমশ অবহেলায় ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছিল।
এটা খুব মিথ্যে নয় যে, আমাদের চারপাশে থাকা শিশু এবং কৈশোর-উত্তীর্ণ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশের বেশি সংখ্যক, যারা আমাদের কাছে কাউন্সেলিং-এর জন্য আসে, তাদের আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। শুধু এই সমস্যাই নয়, তাদের প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা অসুবিধা এবং ভারসাম্যহীনতা। তাদের আত্মপলব্ধি হল যে, তারা একেবারেই যথাযথ, সপ্রতিভ নয়। এমনকী তারা ভালো দেখতেও নয়। তাদের ধারণা হল যে, তারা পরীক্ষায় এমন কিছু ভালো ফল করেনি যার জন্য অন্য কেউ তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আসবে, বা কথাবার্তা বলবে। তারা শিক্ষকদের কাছে কোনও প্রশ্ন করে না, কারণ তারা ভয় পায় যে, শিক্ষকরা তাদের এমন বকাঝকা করবে সেই দেখে অন্য সবাই হাসাহাসি করবে। শুধু তাই নয়, এই সব ছেলে-মেয়েরা মানুষের ভিড়ের সামনে বা কোনও মঞ্চে দাঁড়াতে ভয় পায়। কারণ তাদের মনে হয় যে, অন্যেরা তাদের দেখে ঠাট্টা-তামাশা করবে। এইরকম আরও কত উদ্ভট ভয় যে তাদের মনে চেপে বসে রয়েছে তার সীমা-পরিসীমা নেই।
আত্মবিশ্বাসের জোরেই মানুষ তার ভালো-মন্দ এবং আবেগ-অনুভূতির সঠিক মূল্যায়ণ করতে সমর্থ হয়। এর মাধ্যমেই একজন নিজেকে জানতে ও চিনতে চেষ্টা করে এবং নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারে। উপরের বক্তব্যগুলি থেকে মানুষের আত্মবিশ্বাসের অভাবজনিত লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং এ-ও বোঝা দরকার যে, এ হেন লক্ষণগুলি কোন শিশুরই জন্মগত সমস্যা নয়। এর জন্য দায়ী আমরা বড়রা অর্থাৎ শিশুর অভিভাবকরা। ছোটদের প্রতি আমাদের উদাসীন আচরণ, রূঢ় মন্তব্য, অপ্রয়োজনীয় মতামত প্রকাশের মতো বিষয়গুলি মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে। বড়দের অদূরদর্শীতা অনেক সময় কোনও কিছুকে শুরুর আগেই শেষ করে দেয়। তাই আমাদের অর্থাৎ অভিভাবকদের উচিত অর্থবহ প্রচেষ্টা, সদিচ্ছা এবং শুভেচ্ছার মাধ্যমে একজন শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশে সাহায্য করা।
অভিভাবকরা কী বলছেন এবং কেমনভাবে বলছেন— এই দুটি বিষয় একান্তভাবে মনে রাখা জরুরি। অনেক সময় কোনও ভাবনা-চিন্তা না করে একদম হালকা ভাবে আমরা বড়রা ছোটদের বোকা, নির্বোধ বা অক্ষম প্রভৃতি বলে বকাবকি করি। কখনও আবার তাঁদের অসফল, পরাজিত ইত্যাদি রূপেও বিচার করি। কিন্তু আমরা কি সত্যিই চাই যে, আমাদের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের বোকা, নির্বোধ, অক্ষম বা পরাজিত বলে ভাবুক বা মনে এহেন বিশ্বাস নিয়েই বড় হোক?
প্রাইমারি স্কুলের একজন বাচ্চার মা কিছুদিন আগে আমার কাছে এসেছিল তার সন্তানের একটি সমস্যার সমাধানের জন্য। স্কুলে শিক্ষক-অভিভাবকদের মিটিং-এর পর ওই বাচ্চাটির সমস্যা নিয়ে তার বাবা-মা এবং শিক্ষক উভয়েই খুব চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছিলেন ও স্কুলের ভারপ্রাপ্ত কাউন্সেলরের পরামর্শ নেওয়ার জন্যও উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। আমার সঙ্গে কথপোকথনের সময় তাঁরা বলেছিলেন যে এই ছেলে তাঁদের কাছে একটি 'সমস্যা' এবং এইজন্য তাঁরা খুবই অসহায় এবং ছেলেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ বা ম্যানেজ করবেন সে বিষয়ে তাঁরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তার সময়ে তাঁদের মুখে ব্যবহৃত দুটি শব্দ শুনে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে উষ্ণ স্রোত বয়ে গিয়েছিল। শব্দ দুটি হল— ছেলে বাবা-মার কাছে 'সমস্যা' এবং ছেলেকে 'নিয়ন্ত্রণ' করার চেষ্টা। সন্তান কি কখনও বাবা-মায়ের কাছে সমস্যা হতে পারে? যদি অভিভাবকদের চিন্তায় তাঁদের সন্তান 'সমস্যা' হিসেবে গণ্য হয়, তাহলে তাঁদের কাজকর্মে, আচার-আচরণে বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। এবং এর ফলে ক্রমশ শিশুদের মনেও এই বিশ্বাস গাঢ় হবে যে, তারা বাবা-মায়ের কাছে একপ্রকার বোঝা বা 'সমস্যা'।
আরো একটি বিষয়ে আমি অবাক হলাম যে, যখন আমি ছেলেটির বাবা-মাকে তাঁদের বাচ্চার শক্তি বা ক্ষমতার বিষয়ে জানতে চাইলাম তখন দেখলাম তার বাবা বা মা কেউই এই ব্যাপারে অবহিত নন। এবং আমাদের কথাবার্তার সময়ে আমি নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার এই প্রশ্ন সেই অভিভাবকদের সামনে রাখলাম ও অবশেষে ক্লান্ত বোধ করলাম। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে কোনও সদুত্তর
পেলাম না।
এইসবের পর আমার কাছে বাবা-মায়ের এহেন আচরণই হয়ে উঠল মূল সমস্যা এবং তা 'নিয়ন্ত্রণ'-এর প্রয়োজনও বোধ করলাম। বাচ্চাটির সমস্যা আমার কাছে মোটেই গুরুতর বলে মনে হয়নি।
এত সব ঘটনার পর একটি বাচ্চা এই বিশ্বাস নিয়েই বড় হবে যে, তাদের মধ্যে কোনও অভিনবত্ব বা বিশেষত্ব নেই। এবং এই ঘটনায় আমাদের মোটেই অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসলে অভিভাবকরাই যখন তাঁদের চিন্তাভাবনা ও আচরণের ক্ষেত্রে অভিনবত্বের পরিচয় দিতে পারেন না, তখন তাঁদের সন্তান কীভাবে বৃহত্তর জীবনে প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাবে? আসলে গাছের গুঁড়ি যদি শক্ত না হয় তাহলে তা থেকে সতেজ এবং টাটকা ফল আশা করা কি যুক্তিসংগত? একটি বাচ্চার বড় হওয়ার পিছনে তার অভিভাবক, শিক্ষক ও বড়দের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য তাদের খারাপ দিকের থেকে ভালো দিকগুলিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাদের গুণগুলি প্রকাশ্যে এনে মানসিক ভাবে তাদেরকে সুস্থ এবং চাঙ্গা রাখার দায়িত্ব তো বাবা-মায়েদেরই। সন্তানের জীবনে তার বাবা-মা বা বড়দের অনুপ্রেরণা বাড়তি শক্তি জোগায়। বড়রা বাচ্চাদের চোখ, কান খোলা রাখতে শিখিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। ভালো কথা শুনিয়ে, পরিষ্কার করে কাজ করতে শিখিয়ে, নিজেদের সুব্যবহার ও উন্নত আচরণ এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে সন্তানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা একান্ত জরুরি।
সুতরাং বাবা-মা হিসেবে সন্তানের জন্য আপনি কতটা কী করছেন তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল আপনি কেমন ভাবে সেই কাজটা করতে সমর্থ হচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে সঠিক দিশা পেতে গেলে সন্তানের দৈনন্দিন জীবনের ইতিবাচক দিকগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়াটাই কাম্য। এবং যদি প্রতিদিন একটি নতুন আশা নিয়ে কাজ শুরু করেন তাহলে তা সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস তথা বছরের পর বছর ভালো ফল দেবে।
এইভাবে চলতে থাকলে একসময় অভিভাবকরা এটা অনুভব করেই বিস্মিত হবেন যে, কীভাবে তাঁদের আন্তরিক চেষ্টা সন্তানকে উন্নত থেকে উন্নততর হওয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, বাচ্চারা কখনও তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রশংসা শুনতেই পায় না। অথচ এই ধরনের অবহেলার কোনওরকম প্রতিকারও চোখে পড়ে না। আমরা ভুল কাজের নিন্দা করতে যতটা সক্রিয় এবং ওয়াকিবহাল, সঠিক কাজের প্রশংসায় ততটা পঞ্চমুখ হতে পারি না।
সব সময় ভালোর সন্ধান করাটাই বাঞ্ছনীয় এবং এই মানসিকতাকেই অভ্যাসে পরিণত করা জরুরি। সোনাকে বারংবার ঘষলে যেমন তার ঔজ্জ্বল্য বাড়ে, তেমনই সু-অভ্যাসের অনুশীলনের মাধ্যমে পাঁক না ঘেঁটে পরিচ্ছন্নতার সন্ধান করাই যুক্তিযুক্ত এবং শ্রেয়।
মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত একজন কাউন্সেলার যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন।আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিকভাবে ছাপানো হবে।