Santanu
Santanu
শৈশব

শারীরিক আঘাত কি আপনার শিশুর মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে?

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

অনেক সময় ছোটদের বাড়িতে হোক বা স্কুলে, নিয়মিত মারধর করা হয়। সেটাই কি তাদের শৃঙ্খলতা বজায় রাখার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়? নিশ্চিতভাবে এটা সবচেয়ে সহজ উপায়। কিন্তু কতটা কার্যকরী সেটাই হল আসল প্রশ্ন।

আমি বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে চিনি যাদেরকে নিয়মিত মারধর করা হয় তাদের ছোট ছোট ভুল ত্রুটির জন্য। কিছু প্রাপ্তবয়স্ক লোকজনকেও চিনি যাদের ছোটবেলায় মার খেতে হয়েছে – খালি হাত দিয়ে, স্কেল দিয়ে, আবার কখনও গরম লোহার দিয়েও (যেমন আমি আমার আগের প্রচ্ছদটিতে বর্ণনা দিয়েছি)। এইসব ঘটনা জানতে পারার পর আমার খুব রাগ হয় (কারণ এইসব বিষয় নিয়েই আমাকে কাজ করতে হয়), এবং আমি ভাবতে শুরু করি কি এমন কারণে বাচ্চাদেরকে মা-বাবারা মারধর করতে বাধ্য হয় এবং তাতে বাচ্চাদের ভাবাবেগে কতটা প্রভাব পড়ে?

একজন মা বা বাবা কেন নিজের শিশুকে মারধর করে? বেশ কিছু মা-বাবার সঙ্গে কথা বলার পর আমি এর অনেকগুলি কারণ জানতে পারি। তার মধ্যে একটি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হল, তাঁরা নিজেরাও এইরকম শাসনে বড় হয়েছে। ফলে তাঁদের এই একটি মাত্র উপায়ই জানা আছে। তারা নিজেরা যেহেতু এটি সহ্য করতে পেরেছেন, তাই তাদের ধারণা তাদের সন্তানও সেটি সহ্য করতে পারবে। কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছেন, “আপনি যদি নিজের সন্তানকে না মারেন, তাহলে কীভাবে তাদের শৃঙ্খলতা বজায় রাখবেন?” তাঁদের কাছে আমারও প্রশ্ন ছিল, “আপনাদের কি মার খেতে ভাল লাগত? মার খাওয়ার সময় আপনাদের ঠিক কি রকম অনভুতি হত?” যদিও এইসব অনেক আগেকার ঘটনা। তাও যদি তারা কিছু মুহূর্তের জন্য সেইসব দিনগুলি মনে করার চেষ্টা করেন তাহলে সেই পুরনো অনুভুতিগুলি আবার ভেসে উঠবে। সেই পুরনো ভীতি, রাগ, হতাশা, কষ্ট, নিজেকে খারাপ ভাবার অনুভুতি এবং যারা মারধর করতেন তাঁদের প্রতি ঘৃণাগুলি আবার জেগে উঠবে।

দ্বিতীয় কারণটি হল দুশ্চিন্তা ও অসহায় বোধ করা। মা-বাবারা নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় ভোগেন এবং সেটিকে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পেরে অসহায় হয়ে পড়েন। সমাজের অন্য সবাই কীভাবে তাদের সন্তানকে বিচার করবে এই ভেবে দুশ্চিন্তা, ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েরা কি করবে এই ভবে দুশ্চিন্তা। আর সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হয় এই ভবে যে যদি তাদের ছেলেমেয়েরা সঠিক পথে চালিত না হয় তাহলে অন্যেরা তাঁদেরকে মা-বাবা হিসেবে কি চোখে দেখবে। এই সব নিয়ে ভাবতে গিয়েই সচেতন ও অবচেতনে তাদের দুশ্চিন্তা, চাপ, হতাশা গুলির বহিঃপ্রকাশ সন্তানকে আঘাত করার মাধ্যমে ঘটে। এর ফলে তাঁরা নিজেদের হাতে ক্ষমতার রাশ আছে বলে মনে করেন।

মারধর করার পিছনে মা-বাবাদের কিছু কাল্পনিক ধারণা আছে যা সন্তান মানুষ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মা-বাবা মনে করেন যে তাদের ছেলেমেয়েকে সবসময় কড়া শাসনের মধ্যে রাখতে হবে যাতে তারা নিজের মা-বাবাকে ভয় পায়। এতে তারা নিজেদেরকে ক্ষমতাশালি বলে মনে করেন। অন্য দিকে, হয়তো এইসব ছেলেমেয়েরা  নিজেদের মা বাবার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলতে পারে।

কিছু মা-বাবা বিশ্বাস করেন তাদের সন্তানকে মারধর করলে তারা তাঁদের ভয় পাবে এবং নিজেদের কাজে মনোযোগী হতে পারবে, সঠিক পথে চালিত হয়ে জীবনে কিছু অর্জন করতে পারবে। অপরদিকে, যে সকল ছেলেমেয়েদের মার খেতে হয় তারা নিজেদের মা-বাবার নাগালের বাইরে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজকর্ম করে এবং খেয়াল রাখে যাতে সেগুলি মা-বাবারা কখনো জানতে না পারে। অনেক সময় ভয়ের কারণে তারা কোন বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেনা। ভয় হয়তো তাদেরকে অসফল হতে আটকায়, কিন্তু তারা নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী সফলতা অর্জন করতে পারে না এবং তাদের জীবন কখনও আনন্দের হয় না।

কিছু মা-বাবারা মনে করেন মারধর করাই সন্তান মানুষ করার সবচেয়ে ভাল উপায় এবং এটিই একমাত্র উপায়। অথচ এটিই হল সবচেয়ে কম কার্যকরী উপায়। এর ফলে তারা শেখে যে হিংসা একটি সাধারণ প্রবৃত্তি এবং অন্যের অনুভূতিগুলির মর্যাদা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনা।

কিছু মা-বাবা মনে করেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে শৃঙ্খলতা বজায় রাখতে হলে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া খুবই প্রয়োজন। অথচ এর ফলে বাচ্চাদের মধ্যে মা-বাবার প্রতি রাগ ও ঘৃণা জন্ম নেয়। ঠিক ভাবে শাসন করতে হলে তার পরিণামগুলি আগে থেকে জেনে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।

কিছু কিছু মা-বাবা মনে করেন নিজের সন্তানকে তার কোন আগেকার ভুল ত্রুটির জন্য শাসন করা প্রয়োজন। অথচ শাসন করা হয় যাতে সে ভবিষ্যতে ভুল ত্রুটি গুলি না করে। আর এটা বুঝতে হলে মা-বাবার মনোভাবে একটা পরিবর্তন আসা দরকার। মারধর করার কষ্টটা সম্পূর্ণ ভাবে অপ্রয়োজনীয়। শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কখন, সেটা জানা খুব দরকার।

মারধর করে নিজের সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করলে তা ছোটদের ভাবাবেগে প্রভাব ফেলে। তাদেরকে সবসময় ভয়ে থাকতে হয় এবং হিংসার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে তারা নিজেরাও হিংস্র হয়ে ওঠে। তারা স্কুলে গিয়ে অন্যদের উপর গায়ের জোর ফলায় কারণ তারাও নিজেদেরকে কোথাও ক্ষমতাশালী বলে প্রমাণ করতে চায়। আবার কখনও ভয়ে কুঁকড়ে যায় এবং অন্যের দুর্ব্যবহারের স্বীকার হয়। ধীরে ধীরে তারা নিজের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয় আর নিজের চিন্তাভাবনা আর কাজকর্মগুলি আত্মগোপন করে রাখে। ভালবাসা, বিশ্বাস, স্নেহের গণ্ডি গুলি ভেঙ্গে মা-বাবার সঙ্গে শুধু স্বার্থের সম্পর্ক বজায় রাখে।

তাহলে আপনারা একটু চেষ্টা করুন নিজেদের দুশ্চিন্তাগুলি বা আগেকার সমস্যাগুলির সাথে বোঝাপড়া করার। এর জন্য আপনি ধ্যান করে দেখতে পারেন। তাছাড়া বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে বা কোন একজন কাউন্সেলারের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে দেখতে পারেন। একবার আপনার সন্তানের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখুন আর ভাবুন ওকে কত কি সহ্য করতে হয়।    

আমি এটা ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যে মা-বাবারা চিন্তাভাবনা না করেই নিজেদের সন্তাদের গায়ে হাত তোলে, কারণ সেটাই হল তাঁদের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া। তারা কেউই সন্তানকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কাজটি করেন না। তাই আমি সমস্ত মা-বাবাকে বোঝাতে চাই যে আপনার এই তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু আপনার সন্তানের উপর অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রভাব ফেলছে। এর পরেও যদি আপনারা সজ্ঞানে সন্তানের সাথে এই রকম ব্যাবহার করেন তাহলে পরিণতি কি হতে পারে তা আশা করি বুঝতেই পারছেন।

মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুর একজন কাউন্সেলার, যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিকভাবে ছাপানো হবে।