আপনি কি আপনার শরীরের একটা বিশেষ অংশ সম্পর্কে আত্মসচেতন (যেমন ‘আমার ঊরু দুটো খুব ভারী’)? অথবা আপনার মনে কি মানুষের দৈহিক বা শারীরিক গঠন নিয়ে কোনও বদ্ধমূল ধারণা বা বিশ্বাস রয়েছে, যদিও আপনি জানেন যে এর সপক্ষে কোনও প্রমাণ আমাদের কারোর কাছেই নেই (যেমন- ''মোটা লোকেরা খুব খারাপ মানুষ হয়'' বা ''কালো লোকজন বিশ্বাসযোগ্য নয়'')? আপনি কি জানেন কোথা থেকে এই বিশ্বাসগুলো মানুষের মনে জন্মায়?
অনেকসময়েই চারপাশের মানুষজনের কাছ থেকে আমরা যা শুনি তার উপর ভিত্তি করে আমাদের কেমন দেখতে বা নিজেদের দৈহিক গঠন নিয়ে মনে নানারকম ধারণা বা বিশ্বাস জন্মায়। শিশুদের ক্ষেত্রে যখন তাদের অভিভাবক, শিক্ষক বা অন্যান্য বয়স্ক মানুষ তাদের দৈহিক গঠন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে তখন বাচ্চাদের মনেও এমন ধারণা জন্মায়। কোনও কোনও সময়ে আমরা এই ধারণা মন থেকে দূর করতে পারি। বিশেষ করে যখন সেগুলো আমাদের পক্ষে অপকারী হয়। অনেকসময়ে আমরা কীভাবে নিজেদের দেখছি এবং অন্যেরা কীভাবে আমাদের নিজস্বতাকে ব্যাখ্যা করছে তার উপর ভিত্তি করে আমাদের মনে নিজেদের সম্পর্কে বিশ্বাস গড়ে ওঠে। এবং অধিকাংশ সময়ে আমরা নিজেদের কাজকর্ম সম্পর্কে সচেতন থাকি না।
বাচ্চাদের উপর দৈহিক ভাবমূর্তির প্রভাব কী কী হতে পারে-
একটা তিন বা চার বছর বয়সি বাচ্চা তার চারপাশে যা দেখে বা শোনে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারে। অভিভাবক বা বড়রা অনেকসময়ে এমন কিছু মন্তব্য বা আচরণ করে যার প্রভাব একজন বাচ্চার উপর খুব গভীরভাবে পড়ে-
কীভাবে একজন বয়স্ক মানুষ নিজের সম্পর্কে কথা বলছেন- বাচ্চারা তাদের বাবা-মা বা অন্যান্য বয়স্ক মানুষের আচার-আচরণ শুধু লক্ষ করে তা রপ্ত করে নিতে পারে। সেজন্য বড়দের উচিত নিজের সম্পর্কে কথা বলা এবং নিজের দৈহিক চালচলন বিষয়ে সতর্ক থাকা। যদি অভিভাবকরা বাচ্চাদের মোটা বা কালো বা যদি বলে যে বাচ্চাটির একটা বিশেষ জামা পরা উচিত নয় কারণ সেটা পরলে তাকে বেমানান লাগবে তাহলে সেই ধরনের মন্তব্যগুলো শুনে বাচ্চা বুঝতে পারবে যে তার দৈহিক গঠনের মধ্যে কিছু গন্ডগোল রয়েছে।
অন্যের বিষয়ে আপনি কীভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করছেন- প্রায়শই আমরা সবদিক ভালোভাবে বিচার-বিবেচনা না করে মানুষের দৈহিক গঠন সম্পর্কে নানারকম তকমা দিয়ে থাকি, যেমন- রোগা মেয়ে, ভুঁড়িওয়ালা লোক, বোঁচা বা থ্যাবরা নাকওয়ালা মহিলা, ফর্সা বাচ্চা প্রভৃতি। যখন এসব তকমাগুলো একজন বাচ্চার কানে পৌঁছয় তখন সে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে একজন মানুষের নিজস্ব পরিচয় গড়ে ওঠে তাকে কেমন দেখতে অর্থাৎ তার বাহ্যিক গড়নের উপর নির্ভর করে।
আমাদের ব্যবহৃত নির্দিষ্ট কতগুলো শব্দের দ্বারা একজন বাচ্চা প্রভাবিত হয়- অনেক পরিবারের কাছে 'মোটা' বা 'কালো' শব্দের পরিবর্তে 'কুৎসিত', অথবা 'ছিপছিপে' এবং 'ফর্সা' ইত্যাদি বিশেষণগুলো বেশি গ্রহণযোগ্য হয়। এই শব্দগুলোকে কেন্দ্র করে যে কলঙ্কের বোধ জেগে ওঠে তা দূর করার জন্য বাচ্চাদের বোঝানো জরুরি যে এই শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের শুধু দৈহিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু মানুষের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এগুলোর কোনও যোগাযোগ নেই।
কীভাবে একজন মানুষের শারীরিক গড়নের সঙ্গে তার খাদ্যাভ্যাস জড়িত থাকে সে বিষয়ে আমাদের মধ্যে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে- কোনও কোনও খাবারের দিক থেকে কি আপনি একেবারে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন? কারণ আপনি কি এই ভেবে চিন্তিত যে ওইসব খেলে আপনি মোটা হয়ে যেতে পারেন? দৈহিক ওজন নিয়ে চিন্তিত হওয়ার জন্য আপনি কি নির্দিষ্ট কয়েকটি খাবার একেবারেই বর্জন করেছেন? বাচ্চাদের উপস্থিতিতে খাওয়াদাওয়া নিয়ে এসব বিধিনিষেধ বা ছুঁতমার্গের কথা এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কারণ এর ফলে একজন বাচ্চার মনে ধারণা জন্মায় যে দেহের ওজন সংক্রান্ত সমস্যার পিছনে থাকে নির্দিষ্ট কিছু খাবারদাবার।
এগুলোর পরিবর্তে কী ধরনের আচরণ করা জরুরি
নিঃশর্ত গ্রহণযোগ্যতা- বাচ্চাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করে তাদের বোঝাতে হবে যে মানুষের পরিচয় আসলে ঠিক কীভাবে গড়ে ওঠে এবং অনেকরকম বৈশিষ্ট্য দিয়েই একজন মানুষকে ব্যাখ্যা করা যায়। মানুষের বাহ্যিক গড়ন বা গঠন তারই একটা অংশ মাত্র। বড়রা বাচ্চাদের বলতে পারেন যে বাচ্চারা কে কেমন দেখতে বা তাদের দৈহিক ওজন কত এসবই তাদের একমাত্র পরিচয় নয়। তাদের গায়ের রং কালো না ফর্সা তা দিয়েও তাদের সৌন্দর্য বিচার করা যায় না। যখন বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে তখন কোনওরকম বিশেষ তকমা দিয়ে তাদের চিহ্নিত করা ঠিক নয়, যেমন- লম্বু, মোটা প্রভৃতি বলে বাচ্চাদের ডাকাডাকি করা উচিত নয়। অনেকসময়ে বাবা-মা বা অভিভাবকরা বাচ্চাদের আদর করে নানা নামে ডাকে এবং মানে না বুঝেই সেই সব নাম ধরে তারা বাচ্চাদের সম্বোধন করে থাকে। কিন্তু বাচ্চাদের অবচেতন মনে সেই সব তকমাগুলোর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যদি তারা ভাবে যে ওই নামগুলো ধরে তাদের ডাকা মানে তাদের উপহাস করা হচ্ছে তাহলে বাচ্চাদের বোঝাতে হবে যে অভিভাবকরা তাদের ভালোবেসে, আদর করে ওই নামে ডাকছে। বাচ্চারা কেমন দেখতে তার উপর ভিত্তি করে তাদের প্রশংসা করা উচিত নয়। বাচ্চাদের কাজ, তাদের গুণাবলী বা প্রতিভার বিচার করে তাদের প্রশংসা করাই বাঞ্ছনীয়।
শারীরিক খুঁটিনাটি এবং প্রত্যাশাজনিত দৈহিক পরিবর্তনগুলোর বিষয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে কথাবার্থা বলতে হবে- বয়ঃসন্ধিকালে একজন বাচ্চা যখন তার শরীরে নানারকম পরিবর্তন ঘটতে দেখে তখন সে আত্মসচেতন হয়ে ওঠে বা নিজের দৈহিক গঠন নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বাচ্চাদের সঙ্গে অভিভাবকদের কথপোকথনের সময়ে তাদের বোঝাতে হবে কী ধরনের শারীরিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং কেন এই বদল হয়েছে। যে সব বাচ্চারা তাদের কাছের মানুষের চাইতে আগে বা পরে পরিণত (বিকশিত দ্বিতীয় শ্রেণির যৌন বৈশিষ্ট্য) হয়ে ওঠে তাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। মনে রাখা দরকার যে প্রতিটি বাচ্চার দৈহিক বিকাশের গতি আলাদা-আলাদা হয়।
যোগাযোগের মাধ্যম খুলে রাখতে হবে- বাচ্চাকে জানিয়ে দিতে হবে যে তাদের কথা, ভাবনা শোনা ও জানার জন্য অভিভাবক হিসেবে আপনারা ইচ্ছুক। সেই সঙ্গে বাচ্চাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেও বড়রা প্রস্তুত। যখন বাচ্চারা কথা বলবে তখন বড়দের কোনওরকম প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে তা শোনা প্রয়োজন। চেষ্টা করা উচিত যে বাচ্চা যা বলতে চাইছে সেটাকে সমস্যা ধরে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকারের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা না করা। বাচ্চার কীরকম বোধ বা অনুভূতি হচ্ছে সে সম্পর্কে কথা বলার স্বাধীনতা দিতে হবে তাদের। তাদের চিন্তাভাবনাকে স্বাভাবিক করতে হবে (যেমন- বড়রাও যে বয়ঃসন্ধির সময়ে নানারকম সমস্যায় পড়েছিল এবং অন্য লোকে তাদের সম্পর্কে কী ভাবছে তা নিয়ে তারা চিন্তিত থাকত সেকথা বাচ্চাদের কাছে বলতে হবে) ও বাচ্চাদের সঠিক অবস্থা ভালোভাবে বুঝতে হবে।
শারীরিক সুস্থতার উপর জোর দিতে হবে, তার আকার-আয়তনের উপর নয়- বাচ্চাদের বোঝাতে সাহায্য করতে হবে প্রত্যেক মানুষের শারীরিক গঠন আলাদা-আলাদা হয় এবং সেক্ষেত্রে ঠিক বা ভুলের কোনও সঠিক মাপকাঠি নেই। বাচ্চাদেরকে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। যেমন- দেখতে হবে একজন বাচ্চা তার সমবয়সি আরেকজন বাচ্চার মতো জীবনযাপন করতে পারছে কিনা? তারা শারীরিকভাবে সক্রিয় কিনা? তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাচ্ছে কিনা? দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তাদের যথাযথ শক্তি রয়েছে কিনা? দৈহিক ওজনের চেয়ে এগুলোই একজন বাচ্চার জীবনের লক্ষ হওয়া উচিত। যদি অভিভাবকরা চান যে বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের দৈহিক ওজন নিয়ে কথা বলবেন তাহলে খুব সৎ এবং বাস্তববাদী হতে হবে। সেক্ষেত্রে অভিভাবককে বলতে হবে ''তোমার শরীরের ওজন তোমার হৃদযন্ত্র বা হাড়ের উপর প্রভাব ফেলছে কিনা তা নিয়ে আমি যথেষ্ঠ চিন্তিত; ঠিক যেমনভাবে জ্বর বা সর্দিকাশিও তোমার শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।''
খাবারদাবারের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা- বাচ্চাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে মানুষের শরীরের চাহিদার গুরুত্ব সম্পর্কে। এবং চাহিদা পূরণ করার জন্যই যে আমাদের যখন খিদে পায় তখন খেতে হয় সেকথাও তাদের বলা জরুরি। যদি অভিভাবকরা বাচ্চাদের সুস্থতা সম্পর্কে চিন্তিত হন তাহলে কখন বাচ্চাদের মুখোরোচক ভাজাভুজি খাবার খাওয়ার সম্পর্কে একটা সাধারণ নিয়মকানুন তৈরি করতে হবে।
নিজের প্রতি সৎ হতে হবে- অভিভাবকত্ব মোটেই সহজ কাজ নয়। আমরা অধিকাংশই নিজেদের শরীর নিয়ে খুব পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিশ্বাসী হই এবং কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে নিজের বিশ্বাসের বদল ঘটানোও সম্ভব হয় না। যদি আপনি আপনার অপছন্দের কোনও কাজ করতে চান তাহলে নিজের প্রতি একটু সৎ থাকতে হবে এবং মনে রাখতে হবে আপনি চেষ্টা করলেই সেরা কাজ করতে পারেন।