মনে পড়ে শেষ কবে আপনি আপনার বাচ্চার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছেন? বা আপনি কি এই বিষয়টি দেখে খুব আশ্চর্য হয়েছেন যে, কেন আপনার বাচ্চা আপনার মুখ লুকিয়ে ফেলা এবং নিমেষের মধ্যে সেই লোকানো মুখ বাইরে বের করে আনাকে খুব অবাক হয়ে দেখছে? এই প্রশ্নের উত্তরটি দৃশ্যগত স্থিরতা নামক বিষয়টির সঙ্গে জড়িত। এই বিষয়ের প্রতি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সুইস সাইকোলজিস্ট জিন পিয়াগেট। তাঁর মতে, শিশুর জন্মের পর আট মাস পর্যন্ত সে তার দৃষ্টির বাইরে থাকা কোনও বস্তু বা দৃশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকে। এর সঙ্গে একটি চালু ধারণা চোখের বাইরে থাকা মানে মনের বাইরে চলে যাওয়ারও মিল রয়েছে। আট থেকে বারো মাস বয়সের মধ্যে একটি শিশু চোখে না দেখা কোনও বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে বুঝতে শেখে আর ধীরে ধীরে তার চোখের দেখার স্থিরতা বা দৃশ্যগত অনুভূতিগুলির বিকাশ ঘটে। এর চরম পরিণতি হল রাগারাগির ফলে চোখের ভাষার ব্যাপক পরিবর্তন বা চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা। এইভাবেই একজন বাচ্চার সঙ্গে তার কাছের মানুষ প্রধানত বাবা-মা অথবা পরিচর্যাকারীর মনের বন্ধন বা টান এমনভাবে গড়ে ওঠে যে, কোনও কারণে যদি তাঁরা কিছুক্ষণের জন্য শিশুটির চোখের বাইরে থাকে তাহলে তাঁদের দেখতে না পেয়ে বাচ্চাটি গলা ফাটিয়ে বা পাগলের মতো চেঁচামেচি এবং কান্নাকাটি জুড়ে দেয়।
একটি শিশুর মধ্যে প্রথম এহেন মানসিক উদ্বেগের সৃষ্টি হয় তার আট মাস বয়সে। এবং এর পর থেকেই বাবা-মা বা পরিচর্যাকারীর সঙ্গে শিশুটির বন্ধন দৃঢ় হতে শুরু করে। এটি তখনই সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায় যখন সে টলোমলো পায়ে প্রথম হাঁটতে শেখে এবং লক্ষণীয় যে, যখন একজন বাচ্চার প্রথম স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি আরম্ভ হয়, সেই সময়ে সেপারেশন আংজাইটি বারেবারে প্রকাশ পায়। এইসময় একজন বাচ্চার মধ্যে সাধারণভাবে যে লক্ষণগুলি দেখা দেয় সেগুলি হল—
স্কুলে না যাওয়ার জন্য বায়না করা।
সারাক্ষণ বাবা-মা বা পরিচর্যাকারীর সঙ্গে সেঁটে থাকা বা ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ানো।
কাছের মানুষদের চোখের বাইরে না যাওয়ার জন্য রাগ, মেজাজ দেখানো বা অসুখের যেমন মাথা ব্যথা, পেটে ব্যথা প্রভৃতির ভান করা।
তবে স্বস্তির কথা এই যে, ছোট বাচ্চাদের মধ্যে এহেন মানসিক উদ্বিগ্নতা খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখা দেয়। এবং এটিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বিচার করা হয়। কারণ, এই ধরনের উদ্বেগের মধ্য দিয়ে একজন শিশু তার প্রিয়জনদের চিনতে শেখে ও তাদের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলে। অপরদিকে চিন্তার বিষয় হল, বাচ্চাদের প্রতিদিনের রাগ বা বদমেজাজের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অভিভাবককে খেয়াল রাখতে হবে এবং রাশ টানতে হবে।
সুতরাং, অভিভাবক হিসেবে কেউ যদি প্রতি সকালে বাচ্চার স্কুলে যাওয়া নিয়ে হইচই বা চেঁচামেচি এড়িয়ে চলতে চান তাহলে ছ'টি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি—
লুকিয়ে বাচ্চার থেকে দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই — বাচ্চাকে লুকিয়ে তার চোখের বাইরে চলে যাওয়া থেকে অভিভাবকদের বিরত থাকা জরুরি। এর ফলে বাচ্চাদের মনে একধরনের অসহায়তার সৃষ্টি হয়, যা থেকে তারা নিজেদের পরিত্যক্ত মনে করে। এই কারণে স্বচ্ছ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। বাচ্চা স্কুলে যাওয়া শুরু করলে প্রথম ক'দিন তাকে স্কুলে সম্পূর্ণ একা ছেড়ে না দিয়ে কিছু সময় তার সঙ্গে অভিভাবকদের থাকা উচিত। এইভাবে সপ্তাহখানেক যাওয়ার পর যথাযথভাবে বাচ্চাকে বিদায় জানিয়ে স্কুল ত্যাগ করতে হবে এবং বাবা-মা যে আবার স্কুল থেকে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সে বিষয়টি তাকে ভালোভাবে জানিয়ে দেওয়া জরুরি (এটি বাচ্চাকে স্কুলে থাকাকালীন খেলা, খাওয়া ইত্যাদিতে সাহায্য করবে)। অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে, সে বিষয়ে তার স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
বাচ্চাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত করে রাখা — অভিভাবকদের উচিত বাচ্চাকে স্কুলে রেখে বাড়ি ফিরে আসার আগে ছবি আঁকা বা ওই ধরনের কোনও কাজের প্রতি বাচ্চার মনোযোগ বৃদ্ধি করা। এই বিষয়ে শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করাও জরুরি। যেমন, কিছু শিশু গল্পের বই পড়ে বা গান শুনে শান্ত থাকে। কোন বাচ্চা কিসে শান্ত থাকবে, তা অভিভাবকদের স্থির করতে হবে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে।
বাচ্চা বাড়িতে থাকাকালীনও এহেন আলোচনা জারি রাখা প্রয়োজন - বাচ্চা পাকাপাকিভাবে স্কুলে যাওয়ার আগে তাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোনোর ছলে স্কুলের পরিবেশের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটানো জরুরি। শিক্ষকদের কার কী নাম, সে বিষয়ে বাচ্চার মনে সঠিক ধারণা দিতে হবে এবং অভিভাবক ও শিক্ষকদের কথোপকথনের মধ্যে বাচ্চাকেও উপস্থিত করা দরকার। শিশুদের সঙ্গে বড়দের সম্পর্ক স্থাপনে অভিভাবকরা সেতুর কাজ করে থাকেন। এইভাবে শিক্ষক-পড়ুয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা সুসম্পর্ক অভিভাবকদেরও উপকৃত করে। অতএব একটি বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করা অভিভাবকদের অবশ্য কর্তব্য। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে একজন বাচ্চা টিফিন বক্স গোছানো বা জামাকাপড় পড়ার মতো কাজ করতে শেখে।
অভিভাবকদের নিজেদের উদ্বিগ্নতা বাচ্চার সামনে প্রকাশ করা অনুচিত — বাচ্চারা খুব সহজেই বাবা-মায়ের ইশারা, অঙ্গ-ভঙ্গি রপ্ত করে নিতে বেশ দক্ষ। গভীর চিন্তায় মগ্ন অভিভাবকদের প্রকৃত মনের অবস্থা একজন বাচ্চার কাছে স্পষ্ট হতে বেশি সময় লাগে না। যদি বাবা-মায়েরা নিজেদের চিন্তা, উদ্বেগ নিজের মধ্যেই ধরে রাখতে পারেন, তাহলে অর্ধেক যুদ্ধ এই স্তরেই জেতা হয়ে যাবে।
বাচ্চার চোখের সামনে আরামদায়ক ছবি তুলে ধরা কাম্য — এই ধরনের দৃশ্য একটি শিশুর অনুভূতি প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, ফুটফুটে পুতুল। এটির মাধ্যমে বাড়ি একজন বাচ্চার কাছে খুব নিরাপদ এবং স্বস্তিদায়ক হয়ে ওঠে। তাই এই খেলনা সঙ্গে করে নিয়েই শিশুকে স্কুলে পাঠানো বাঞ্ছনীয়। যখন বাচ্চা স্কুলে পুরোপুরি তার মন বসাতে সক্ষম হবে, তখন ক্রমশ এহেন মাধ্যমের আর প্রয়োজন থাকবে না।
অল্প সময়ের জন্য বাবা-মায়ের থেকে দূরে থাকার অনুশীলন করাতে হবে বাচ্চাকে — বাচ্চাকে ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য অভিভাবকদের দূরে যাওয়া প্রয়োজন। এই সময়ে অন্য কোনও বড় মানুষের উপর বাচ্চার দায়িত্ব দেওয়া দরকার। এবং দেখা দরকার যে, এই ব্যবস্থায় বাচ্চা খুশি আছে কিনা। দাদু বা দিদারা এই ভূমিকা পালনে যোগ্য ব্যক্তি। এই ব্যবস্থা শিশুর মানসিক পরিবর্তনে সাহায্য করে।
কখন বাচ্চার এহেন সমস্যার ক্ষেত্রে একজন অভিভাবক বিপদের আঁচ অনুভব করবেন?
বাচ্চার বয়স সাধারণত তিন বছর হলে সেপারেশন আংজাইটি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু একজন সাড়ে চার বা পাঁচ বছরের শিশুর মধ্যে যদি এহেন সমস্যা দেখা দেয় এবং একনাগাড়ে চলতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে, এটি সেপারেশন আংজাইটি ডিসঅর্ডার বা এসএডি-র মতো গুরুতর অসুখের সংকেত। নিমহানস্-এর শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জন বিজয় সাগর-এর মতে, একনাগাড়ে বাচ্চাদের স্কুলে যেতে না চাওয়ার প্রবণতা এবং অতিরিক্ত মানসিক উদ্বেগ এসএডি-র সাধারণ লক্ষণ। একটি পর্যায়ের পর এই সমস্যা বাচ্চাদের দৈনন্দিন জীবনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এই রোগ সারাতে ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য, বিশেষত ইন্টারভিউ এবং অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি খুবই কার্যকরী। এর ক্ষেত্রে থেরাপি এবং উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ—দুই-ই ব্যবহার করা হয়। ডা. সাগরের মতে, একদম বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খেলাধূলা বা ছবি আঁকার মতো পন্থা অবলম্বন করা হয় এবং অপেক্ষাকৃত বড়দের ক্ষেত্রে কগনিটিভ বিহাভায়রল থেরাপি বা সিবিটি, রিল্যাক্সসেশন টেকনিক ও গ্রেডেড স্কুল এক্সপোজার-এর মতো ব্যবস্থা কার্যকরী। তাঁর চিন্তায় রোগ গুরুতর হলেই একমাত্র ওষুধ প্রয়োগ করা জরুরি।
এই রোগ সম্বন্ধে জানার অন্যান্য সূত্রগুলি হল—
বেশ কয়েকটি ছোটদের বইয়ে এই অসুখের নানা বিবরণ পাওয়া যায়। এই বইগুলিতে শুধু বাবা-মায়ের থেকে দূরে থাকার সময়ে শিশুর করণীয় সম্বন্ধে আলোচনাই নেই, তার সঙ্গে রয়েছে অপরিচিত পরিবেশ এবং মানুষের সঙ্গে বাচ্চারা কীভাবে নিজেদের খাপ খাওয়াবে তার ধারণাও।
আওড্রি পেনের 'কিসিং হ্যান্ড'— এই বইয়ে একটি বাচ্চা ছেলে০র প্রথম ফরেস্ট স্কুলে যাওয়ার ভয় এবং সেই ভীতি কাটাতে তার মায়ের সাহায্য বর্ণিত হয়েছে।
মার্টিন ওয়াডেলের 'আওল বেবিজ' — এখানে তিনটি বাচ্চা পেঁচার গল্প রয়েছে, যারা এক রাতে দেখতে পায় যে তাদের মা আর তাদের কাছে নেই।
আন্না ডেডনি-র 'লামা লামা মিসেস মামা' — প্রথম দিন স্কুলে যাওয়ার সময়ে ছোট ছেলে লামা খুবই বিষণ্ণ ছিল এবং তার মা যখন তাকে ক্লাসরুমে ছেড়ে চলে যায় তখন তার মনে হয় যে সে বিশাল সমুদ্রে অনেক অপরিচিত মুখের আড়ালে হারিয়ে গেছে।
এলিজাবেথ ক্র্যারি এবং মারিনা মেগেল-এর 'মাম্মি, ডোন্ট গো'— এই গল্পের চরিত্র ম্যাথিউ-এর মা তাকে একা রেখে বাইরে চলে যায় এবং এই কারণে সে খুবই ভীত হয়ে পড়ে। এই সমস্যা থেকে ম্যাথিউ কীভাবে মুক্তি পায়, তার বর্ণনাই রয়েছে এই বইয়ে।