যেই বাচ্চাদের ভাই/বোন মানসিকভাবে অসুস্থ, অক্ষম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হয় তারা ছোটবেলার থেকেই এই পার্থক্যের বিষয়ে সচেতন থাকে। তারা সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং অনুভূতিগত দিক থেকে পরিণত হয়। অথবা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রতি খুব বিদ্বেষ জাগে কারণ তারা ভাবে যে তাদের সেই ভাই/বোন বাবা-মায়ের সব ভালোবাসা, যত্ন পাচ্ছে এবং আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা একজন অভিভাবক কীভাবে করছেন নির্ধারণ করবে যে অন্য বাচ্চাটি কী ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হবে। যে সন্তানটি অসুস্থ নয় তাকে সাহায্য করার জন্য কী কী করা যেতে পারে সেই বিষয়ে অভিভাবকদের কয়েকটি পরামর্শ দেওয়া হল-
অসুস্থতার বিষয়ে কথাবার্তা বলা- কোনও বাচ্চার নিজের ভাই বা বোনের মধ্যে যদি অসুস্থতা থাকে তাহলে সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এক্ষেত্রে সন্তানদের বয়স অনুযায়ী আলোচনা করা জরুরি। প্রয়োজন মতো ভাই-বোনদেরও একে অপরকে সাহায্য করতে হবে। অসুস্থ সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব শুধুমাত্র অভিভাবকের পরিবর্তে পরিবারের অন্যান্য সবার উচিত অসুস্থ বাচ্চার জন্য দায়দায়িত্ব পালন করা। এক্ষেত্রে সমগ্র পরিবারের একসঙ্গে মিলে আলোচনা এবং পরিকল্পনা করা দরকার। সেই সঙ্গে পরিবারের প্রতিটি সদস্য ব্যক্তিগতভাবে কী অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে কথাবার্তা বলা জরুরি।
অসুস্থতাকে হাতিয়ার করে কোনও প্রতিযোগিতা না করা- অনেকসময়ে যে পরিবারে একজন বাচ্চা সুস্থ এবং অন্যজন অসুস্থ হয় সেই পরিবারে অভিভাবক বনাম সন্তানদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যে বাচ্চাটা সুস্থ সে বাবা-মায়ের আদর, ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তার অসুস্থ ভাই বা বোনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে শুরু করে। অভিভাবক হিসেবে বাবা বা মায়ের উচিত বাচ্চাদের বোঝানো যে তার অসুস্থ ভাই বা বোন ঠিক কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে এবং কীভাবে তার জীবনে অসুস্থতার প্রভাব পড়ছে। সেই সঙ্গে এর বিরুদ্ধে যে সবাই মিলে একসঙ্গে লড়াই করা প্রয়োজন সে কথাও তাদের বোঝাতে হবে।
বাচ্চাটিকে তার ভাই বা বোনের দেখভালের জন্য প্রস্তুত করা উচিত- অভিভাবক হিসেবে বাবা-মায়ের উচিত তার সুস্থ সন্তানদের বোঝানো যে তাদের অসুস্থ ভাই বা বোন ঠিক কী অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। সেই সঙ্গে এই পরিস্থিতির প্রতি তাদের যে সংবেদনশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে সে কথাও বাচ্চাদের বলা দরকার। যেমন- বাচ্চা যদি বিকাশজনিত সমস্যায় ভোগে তাহলে সে খুব তীব্র শব্দ বা গানের আওয়াজ শুনতে পেলে প্রচন্ড রেগে যেতে পারে। তাই বাবা-মায়ের যে সন্তান খুব জোর শব্দে গান শুনছে তাকে আওয়াজ কম করে দেওয়ার পরিবর্তে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলা উচিত যে কেন এই কাজটা তাকে করতে নিষেধ করা হচ্ছে। কারণ খুব জোরে গান বা আওয়াজে ওই বাচ্চাটির অসুস্থ ভাই বা বোনের মনে অত্যন্ত চাপের সৃষ্টি হতে পারে। সেই জন্য ইয়ারফোন নামক যন্ত্র কানে লাগিয়ে গান শোনাটাই বাঞ্ছনীয়। এভাবে বললে বাচ্চারাও বুঝতে পারবে যে তাদের ভাই বা বোনের অসুস্থতার জন্যই বাবা-মা তাদের অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য পরামর্শ দিচ্ছে।
কীভাবে একজন বাচ্চাকে তার অসুস্থ ভাই বা বোনের দেখভালের কাজে লাগানো যেতে পারে? এক্ষেত্রে অভিভাবকরা বাচ্চাকে তার ভাই বা বোনকে ওষুধ খাওয়ানোর কথা, খাবার খাওয়ানোর কথা বা তাদের সঙ্গে খেলা করার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। তবে অভিভাবকদের নিয়মিত খেয়াল রাখতে হবে যে, বাচ্চারা যে তার ভাই বা বোনকে সাহায্য করছে তা ভাই বা বোনের কাছে চাপের কারণ হয়ে উঠছে কিনা।
সুস্থ এবং অসুস্থ উভয় বাচ্চার চাওয়া-পাওয়াকেই সমান চোখে দেখতে হবে- কেন অসুস্থ ভাই বা বোনের দিকে বাবা-মা একটু বেশি নজর ও সময় দিচ্ছে তা নিয়ে সুস্থ বাচ্চাদের সঙ্গে অভিভাবকদের খোলাখুলি কথা বলা জরুরি। যদি কোনও বাবা বা মায়ের অসুস্থ বাচ্চাকে কখনও আপদকালীন সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয় এবং ঠিক ওই সময়েই যদি তাদের অন্য একটি বাচ্চা খেলনা ভেঙে ফেলে তাহলে অবশ্যই অসুস্থ বাচ্চার প্রয়োজনীয়তাই একজন বাবা-মায়ের কাছে অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু সেই সঙ্গে ওই অসুস্থ বাচ্চাটির ভাই বা বোনের চাহিদাকেও স্বীকৃতি দিতে হবে এবং অসুস্থ বাচ্চার বিপদ কেটে গেলে অন্য বাচ্চাদের প্রতি বাবা-মাকে নজর দিতে হবে।
বাচ্চাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম খোলা রাখতে হবে এবং ভালো সময় কাটাতে হবে- অভিভাবকদের পক্ষে সুস্থ এবং অসুস্থ দু'জন বাচ্চার সঙ্গেই সম পরিমাণ সময় কাটানো সম্ভব নাও হতে পারে। অসুস্থ বাচ্চা যদি আবার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হয় তাহলে তো আরও সমস্যা। তাহলে এর পরিবর্তে সুস্থ বাচ্চার জন্য অভিভাবকরা কীভাবে সময় বের করবেন? সেজন্য বাবা-মাকে এমন সব কাজ করতে হবে যে কাজে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা কম। যেমন- বাচ্চাকে চুল আঁচড়ে দিতে হবে, স্কুলে যাওয়ার আগে তাদের সাজিয়ে-গুছিয়ে তৈরি করে দিতে হবে বা ঘুমানোর আগে গল্প বলতে হবে। এছাড়াও ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে খেলার ছলে তাদের সঙ্গে সুস্থ-সুন্দর যোগাযোগ গড়ে তোলা জরুরি।
কলঙ্কের বোধ দূর করতে বাচ্চাদের সাহায্য করতে হবে- যে সব বাচ্চার ভাই বা বোন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হয় তাদের উপর পরোক্ষভাবে কলঙ্কের বোঝা চাপানো হয়। বিশেষ করে যখন তারা তাদের সমবয়সি অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা করে তখন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যখন তাদের বন্ধু বা সহপাঠীরা তাদের অসুস্থ ভাই বা বোনকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে তখন তারা বন্ধুদের দলে যোগ দেবে না ভাই-বোনকে রক্ষা করবে তা নিয়ে ধন্ধে পড়ে যায়। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে যায় যখন বাবা-মায়েরা তাদের অসুস্থ ভাই-বোনকে নিয়ে একসঙ্গে খেলার জন্য জোরাজুরি করে।
এর পরিবর্তে অভিভাবকদের কী করা উচিত? সুস্থ বাচ্চাদের বোঝানো উচিত যে অসুস্থ ভাই-বোন বা অসুস্থ যে কারোর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া একান্ত দরকার। অসুস্থ মানুষকে নিয়ে যে মজা করা একেবারেই উচিত নয় সে কথা বোঝানোও জরুরি।
প্রয়োজন মতো অন্যদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে- অভিভাবকত্ব মোটেই সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে যে অভিভাবকদের বাচ্চারা শারীরিক বা মানসিকভাবে সুস্থ নয় তাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের নিজেদের যত্নের ব্যাপারে নিজেদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে এবং সাহায্যের মাধ্যমগুলো খুঁজতে হবে। মনে রাখা জরুরি যে অভিভাবকদের নিজেদের জীবনের চাপ কখনোই বাচ্চাদের উপর আরোপ করা উচিত নয়। বরং বাচ্চাদেরকে যথাযথ সহায়তা করে তাদের সুস্থ-সবল ভাবে গড়ে তুলতে হবে।
বিপদের সংকেত দেখলেই সতর্ক হতে হবে- যদি কোনও বাবা-মায়ের একজন বাচ্চার মধ্যে মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয় তাহলে বংশগতভাবে তাদের অন্য বাচ্চা অর্থাৎ অপরাপর ভাই-বোনের মধ্যেও অসুস্থ হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে। যদি এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে তখনই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে। বিপদের অন্যান্য সংকেতগুলি হল- হঠাৎ আচরণের পরিবর্তন ঘটা, দীর্ঘ সময় ধরে রাগ বা বিষণ্ণতা, পরিবার বা বন্ধুদের কাছে থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া, স্কুলে যেতে না চাওয়া এবং নেশার বস্তুর প্রতি আসক্ত হয়ে যাওয়া। যদি বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানের আচরণে এগুলোর মধ্যে কোনও একটার লক্ষণ দেখতে পান, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি।
সূত্র:
http://www.healthyplace.com/blogs/parentingchildwithmentalillness/
2015/05/siblings-of-children-with-mental-illness/