মানসিক সুস্থতা নিয়ে আমি প্রথম কাজ শুরু করি ১৯৯৭ সালে, যখন আমি একজন মা হলাম আর সিদ্ধান্ত নিলাম আমার কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে একজন মায়ের দায়িত্ব নেব। মা হওয়ার পর জীবন নিয়ে, সম্পর্ক নিয়ে, বিশ্বাস গুলি কে নিয়ে আমার সমস্ত চিন্তাধারা বদলে গেল – বিশেষ করে আমার নিজের জীবন, নিজের সম্পর্ক ও আমার নিজের বিশ্বাস গুলি। সবাই কি ভাবে সন্তান মানুষ করছে আর আমি কি ভাবে আমার সন্তান কে মানুষ করছি তা ঠিক না ভুল?
যে ভাবে নিজের সন্তানকে বড় করতে চেয়েছিলাম সে ভাবে করতে পারছি কি না ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। প্রথম প্রথম মা হওয়ার পর আমার মাঝে মাঝেই মনে হত যেন কোথাও একটা সময় থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। মাতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায় দিয়ে যাওয়া সত্বেও মনে হত দৈনন্দিন জীবনে কোন পরিবর্তন ঘটছে না। অথচ যখন নিজের সন্তানকে চোখের সামনে ধাপে ধাপে বড় হতে দেখতাম তখন এই ভেবে ভাল লাগত যে সময় কত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে। আমার মেয়ে এখন যৌবনের দোরগোড়ায় আর খুব শীঘ্রই সে নিজের পথ নিজে বেছে নেবে। ছোটরা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠে এবং তাদের বড় হওয়ার সাথে আমরাও খুব অদ্ভুত ও অকল্পনীয় ভাবে বড় হয়ে উঠি।
অভিভাবকত্বকে ঘিরে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জে, ভুলভ্রান্তি, হতাশা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, আনন্দ, ভালবাসা, রাগ, স্বীকৃতিহীন কাজ করে যাওয়া এবং শর্তহীন ভালবাসার আদানপ্রদান। অভিভাবকত্বের দাবিগুলি সামলানোর পদ্ধতির উপর নির্ভর করে আমাদের শিশুরদের সাথে আমাদেরও মানসিক সুস্থতা ও ভাল থাকা।
মাতৃত্বের কিছু অধ্যায় পেরিয়ে ২০০৭ সালে আমি মানসিক সুস্থতা নিয়ে পাকাপাকি ভাবে কাজ করতে শুরু করলাম এবং একজন কাউন্সেলার হলাম। একই সঙ্গে আমি অন্য এক যাত্রায়ও পাড়ি দিলাম, নিজের জীবনের নতুন মানে খোঁজার যাত্রা। মানসিক সুস্থতা নিয়ে কাজ করার দরুন বেশ কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছি। পাঁচ বছর ধরে আমি একটি স্কুলের কাউন্সেলার এবং তাছাড়াও অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, দম্পতিকে তাঁদের জীবনের নতুন মানে খুঁজে বার করতে সাহায্য করেছি। আমি এখন একটি রাষ্ট্রীয় দৈনিকে তরুণ প্রজন্ম সংক্রান্ত সমস্যা – যেমন তাদের পরীক্ষার চাপ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত প্রচ্ছদ লিখি। আমার অনেক ক্লায়ন্টরাই মা-বাবা, যারা নিজেদের অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করছে। আবার অনেক ছেলেমেয়েরাও আছে যারা নিজেদের মা-বাবাকে ঘিরে সমস্যাগুলির সমাধান করার চেষ্টা করছে। আমি অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে বেশ কিছু ওয়ার্কশপ করেছি এবং তাঁদের শেখানোর চেষ্টা করেছি যে কিভাবে নিজেদের মানসিক সুস্থতাকে বজায় রেখে অন্যের মানসিক সুস্থতায় সাহায্য করতে হয়।
অভিভাবকত্বের সঙ্গে ছোটদের মানসিক সুস্থতার সম্পর্ক যে কতটা গভীর তা একটি ঘটনার মাধ্যমে আপনাদের বলি, যা আমি সম্প্রতি এক নতুন ক্লায়ন্টের থেকে জানতে পারলাম। ভদ্রলোকটি আমার সাথে দেখা করতে আসার দু-একদিন আগে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। তৎক্ষণাৎ জরুরি চিকিৎসার পর তার মনোবিদ তাকে আমার সাথে দেখা করতে বলেন। ভদ্রলোকটি অল্পবয়সী, তাঁর মা-বাবা তাকে স্কুলে নিজের পড়াশুনা শেষ করতে দেননি কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল ছেলে যদি পড়াশুনা না করে বিদেশে এক আত্মীয়ের পারিবারিক ব্যাবসায় সাহায্য করে তবে খুব ভাল হয়। তিনি বিদেশে যান এবং কিছুদিন পর আবার দেশে ফিরে আসেন। কারণ যার ব্যাবসা ছিল সে নিজে বিভিন্ন অবৈধ কাজকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ক্লায়ন্টের যৌথ পরিবার হওয়ার কারণে তাঁর মা-বাবা পারিবারিক সম্পর্ককেই বেশি প্রাধান্য দেন এবং তাঁকে আবার বিদেশে যাওয়ার জন্য জোর করতে থাকেন।
আমার ক্লায়েন্ট প্রথমে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে, মা-বাবার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে নতুন করে আবার সব কিছু শুরু করার চেষ্টা করেন। এই সময় তিনি আমার কাছে এসে উপস্থিত হন। তাঁর মা-বাবা কখনও তাকে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করতে দেন না এবং তাঁর মতামতের গুরুত্বও দেন না। একদিকে তাঁর মা-বাবার আশা-আকাঙ্খার চাপ অন্যদিকে তাঁর নিজের ইচ্ছে গুলির মধ্যে কোন মিল ছিল না। ফলে তাঁর উপর এতটাই চাপ সৃষ্টি হয়েছিল যে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মা-বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কাজ করার তাঁর ক্ষমতা ছিল না। তিনি আমাকে জানান যে তাঁর নিজেকে কারাগারে বন্দী মনে হত এবং পালাতে ইচ্ছা করত। আমরা একসঙ্গে খুব অল্প সময়ের জন্য কাজ করেছিলাম, কিন্তু তা খুবই ফলপ্রদ হয়। আমি শুধু তাঁকে বলেছিলাম নিজের মনগড়া ওই কারাগারটি থেকে বেরিয়ে আসতে কোন বাঁধা নেই। আর অন্যকে ‘না’ বলাটা কোন খারাপ কিছু না। এটার পর সে নিজেকে অনেক হাল্কা অনুভব করে এবং আবার নিজের জিবনযাত্রায় মন বসায় কিন্তু অবশ্যই নিজের মতো করে।
এই প্রচ্ছদটির মাধ্যমে আমি আমাদের সন্তানদের মানসিক সুস্থতা ও আমাদের অভিভাবকত্বের ধরণগুলির মধ্যে যে সম্পর্কটি আছে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। এটি আমাদের মা-বাবাদের যে প্রভাব আমাদের উপর পড়েছে এবং আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে কতখানি মানসিক ভাবে সুস্থ তাও বুঝতে সাহায্য করবে। আমরা মা-বাবা হিসাবে সব সময় চেষ্টা করি আমাদের সন্তানকে শ্রেষ্ঠ জিনিসটি দেবার, কিন্তু তা করতে গিয়ে তাদের স্বাভাবিক মানসিক সুস্থতা নিয়ে বড় হয়ে উঠতে বাঁধা সৃষ্টি করি। তা সত্বেও আমাদের সবসময় নিজেদেরকে ভাল মা-বাবা মনে করা উচিত এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের ছেলেমেয়েদেরকেও আত্মবিশ্বাসী, সুস্থ, স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে সাহায্য করা উচিৎ। আমাদের কে বুঝতে হবে যে কখন নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে আবার কখন নিজেকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। বুঝতে হবে কোনটা আমরা জানি আর কোনটা আমাদের জানার বাইরে। কখন ধরে রাখতে হবে আর কখন ছেড়ে দিতে হবে। কোনটা শেখাতে হবে আর কোনটা নিজেকে শিখতে হবে। কোনটা মেনে নিতে হবে আর কোনটা মানা যাবে না। বর্তমানে থেকে আমরা কতটা আমাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা নিয়ে চিন্তা করব? এই সবগুলিই হল আমাদের ও আমাদের সন্তানের মানসিক সুস্থতার মূল উপাদান।
আমি আমার বেশিরভাগ লেখায় নিজের অভিজ্ঞতাগুলিকে কেন্দ্র করে লিখি (কোনটা ফল দিয়েছে আর কোনটা ফল দেয়নি)। এইসব আমার ছোটবেলাকার অভিজ্ঞতা, মা হওয়ার অভিজ্ঞতা, আবার একজন কাউন্সেলার হওয়ারও অভিজ্ঞতা। তবে, গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য আমি কোনও নাম বলতে পারি না।
এই বিষয়গুলো জানার পর আপনাদের মনে যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে আমাকে অবশ্যই জানান। আমি চেষ্টা করব এক-এক করে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেবার। নতুন কিছু শেখার এই যাত্রায় আসুন আমরা একত্রে পাড়ি দেই।
মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুর একজন কাউন্সেলার যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিকভাবে ছাপানো হবে।