সকলেই সফল হতে চায়, কেউ ব্যর্থ হতে চায় না। সাফল্য ও ব্যর্থতা দিয়ে একটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া যায়, একটি মানুষের নয়। আপনি কোন কাজ করতে বা কোনও লক্ষ পূরণ করতে সফল হতে পারেন আবার ব্যর্থও হতে পারেন। তার মানে এই নয় যে আপনি সম্পূর্ণ ভাবে সফল বা সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ। কোনও জিনিসে আপনি যেমন সফল হতে পারেন, আবার কোনও কোনও জিনিসে আপনি ব্যর্থও হতে পারেন। পৃথিবীর সফলতম ব্যক্তি (যদি সেরকম কেউ হয়) জীবনে অনেক অর্থ উপার্জন করতে পারে, সেই সঙ্গে একজন ভাল মা বা বাবা হতে বা ভাল স্বামী বা স্ত্রী হতে একেবারে ব্যর্থ হতে পারেন। আবার যে ব্যক্তি নিজের ব্যাবসার দিক থেকে একেবারেই অসফল, দেখা যাবে সেই হয়তো একজন অসাধারন অভিভাবক বা বন্ধু।
এর থেকে বোঝা যায় যে সফলতা আর ব্যর্থতা দিয়ে আমরা জীবনের কিছু ঘটনা বর্ণনা করার চেষ্টা করি, আমাদের নিজেদের বর্ণনা দিই না। কিন্তু আমরা এ দুটির পার্থক্য আজও সঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।
আমাদের অনেক সময় মনে হয় যে যেহেতু আমরা সফল আমাদের ছেলেমেয়েরাও সফল হবে এবং আমাদের বা তাদের জীবনে যদি একটুও ব্যর্থতার আঁচ লাগে তখন আমরা তা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। কখনও এটাও মনে হয়, যে যেহেতু আমরা নিজেরা অসফল, আমরা আমাদের সন্তানদের অসফল হতে দেব না। যদি আমাদের সন্তানরা পরীক্ষায় পাস করতে না পারে, আমরা তাদেরকে ব্যর্থ বলে থাকি, বা তাদেরকে বলি যে তারা সারা জীবন অসফলই থেকে যাবে। যেখানে তারা শুধু একটি পরিক্ষাতেই অসফল হয়েছে, হয়তো এরকম অনেক কিছু আছে, যাতে তারা সফলতা অর্জন করেছে। আমরা নিজেদেরকে বুঝিয়ে উঠতে পারিনা যে তারা হয়তো খেলাধুলায় খুব ভাল হতে পারে, বা খুব সহানুভূতিশীল একটি ব্যক্তি হতে পারে, বা শিল্পকলা বা বা খুব ভাল গান গাইতে পারে, তারা খুব ভাল কথাও বলতে পারে, তারা সৎ হতে পারে বা অন্যের সাহায্য করতে পারে। আমরা এই জিনিসগুলিকে দেখেও না দেখার চেষ্টা করি এবং তাদেরকে তাদের পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে বিচার করি।
একইভাবে যদি আমাদের চাকরি চলে যায়, তখন আমরা নিজেদের অসফল মনে করি, কিছু সময় আমরা সেই পরিস্থিতি থেকে সামলে উঠতে পারি না। কোন একটা বিশেষ কাজে ব্যর্থ হলে আমরা নিজেদেরকে অসফল বলে মনে করি আর সেই কারণেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারি না।
আমাদের সন্তানদের শক্তি ও দুর্বলতা গুলিকে সম্পূর্ণ ভাবে মেনে নিতে হলে আমাদের বুঝতে হবে যে সাফল্য ও ব্যর্থতা দিয়ে কোনও ঘটনার বিবরণ দেওয়া যায়, কোনও মানুষের বিবরণ দেওয়া যায় না। তার মানে, আমাদের নিজেদেরকে এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে দেখতে হবে, যিনি কোনও একটি ক্ষেত্রে সফল আবার কোনও একটি ক্ষেত্রে অসফল। আমাদের ব্যর্থতা গুলি স্বচ্ছন্দের সঙ্গে আমাদের মেনে নিতে শিখতে হবে। আমরা কি পারি আমাদের ব্যর্থতাগুলিকে মেনে নিতে এবং সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা নিতে? আমরা কি আমাদের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার কথা আমাদের ছেলেমেয়েদের বলতে পারি? খাওয়ার সময় আমরা কি সেই বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলতে পারি? এক মাত্র এই ভাবেই আমরা আমাদের সন্তানদের বোঝাতে পারি যে ব্যর্থতা জীবনের একটি অংশ এবং ব্যর্থতার মাধ্যমেই মানুষ শিখতে পারে। ব্যর্থতা কারও জীবন নষ্ট করার কারণ হতে পারে না।
কিছু কিছু ব্যর্থতা আমাদের ও আমাদের সন্তানদের জীবনে অবধারিত। ছেলেমেয়েদের জমানো মোটা অঙ্কের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স না দিয়ে যদি তাদের শেখানো যায় যে ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে কি ভাবে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায়, তাহলে সেটিই হবে তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার। এর মাধ্যমে তারা রুখে দাঁড়াতে শিখবে, তারা শিখবে কি ভাবে কোনও সমস্যার সঙ্গে লড়তে হয়। যত তাড়াতাড়ি তারা এ গুলি শিখতে পারবে ততই তাদের উন্নতি হবে।
কিন্তু বাচ্চারা যা দেখে এবং যা অভিজ্ঞতা করে, তার মধ্যে দিয়েই শেখে, আমাদের বকাবকির মধ্যে দিয়ে শেখে না। তার মানে তারা আমাদের মধ্যে দিয়ে শিখবে আমরা কি ভাবে সাফল্যকে ও ব্যর্থতাকে সম্বোধন করি। তাদের দেখা উচিত কি ভাবে আমরা নিজেদের ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করি। তাদের দেখা উচিত যে আমরাও ব্যর্থতার কারণে কখনও কখনও পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায় – নতুন শিখর ছুঁতে, আবার পড়ে যায়। তাদের আমাদের সাফল্যগুলিও দেখা উচিত, এবং কি ভাবে আমরা আমাদের সাফল্যগুলির কারণে আনন্দ লাভ করি।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে তাদেরকে আমাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোই দেখা উচিত। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল যে তাদেরকে বুঝতে হবে যে এই সাফল্য ও ব্যর্থতা আমাদের জীবন আসে কিছু সময়ের জন্য। আমরা সারা জীবন কেউ সফল বা কেউ ব্যর্থ থাকি না। জন উডেন’এর ভাষায় “সাফল্যই সব কিছুর শেষ নয়, হতাশাও মারাত্মক কিছু নয়। শুধু সাহস বজায় রাখতে হবে।“
অভিভাবক হিসাবে আমাদের সন্তানদের কাছে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে সমস্যার সামনে সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে, এবং নম্রতার সঙ্গে সমৃদ্ধিকে মেনে নিয়ে। একমাত্র এটি করতে পারলেই আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের কাছ থেকে শিখবে, এবং তা তারা নিজেদের জীবনেও ব্যাবহার করবে। আর একমাত্র তখনই বুঝতে পারব যে আমরা আমদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিয়েছি, যা দিয়ে তারা দায়িত্ববান মানুষ হতে পারবে জীবনের সমস্ত চ্যালেঞ্জ, উল্লাস, সাফল্য, ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে পারবে।
নিজের সন্তানকে অনুপ্রেরণা করার ক্ষমতা, তা সে ইতিবাচকই হোক বা নেতিবাচকই হোক তা কখনও অসম্মান করবেন না। চলুন চেষ্টা করা যাক ইতিবাচক গুলি বাড়িয়ে নেতিবাচক গুলি কমানোর।
মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুর একজন খ্যাতনামা মনোবিদ যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। মল্লিকা বর্তমানে ওয়ার্কপ্লেস অপশন্স নামে একটি বিশ্বব্যাপী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন।