অধিকাংশ মহিলার জন্যই গর্ভাবস্থা এক আনন্দের সময়। নিজের শিশুকে কোলেপিঠে করে মানুষ করার ইচ্ছা স্বভাবতই প্রাকৃতিক। কিন্তু, কখনও কখনও কিছু মানসিক জটিলতার কারণে এই তথাকথিত সহজ কাজটাও প্রচণ্ড কঠিন হয়ে পরে। ফলে সন্তানের যত্ন নেওয়া অনেক বেশী পরিশ্রমসাধ্য হয়ে ওঠে।
এই সম্পর্কের সূত্রপাত কোথায়?
একজন মা এবং তাঁর শিশুর বন্ধন বিভিন্ন পর্যায় শুরু হতে পারে। কারও ক্ষেত্রে হয়ত মা হবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় থেকেই এই বন্ধন গড়ে উঠতে পারে। আবার সারোগেসির ক্ষেত্রে হয়ত সন্তানকে কাছে পাবার পর থেকে এই সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
এই সম্পর্ক মূলত দু’ধরণের:
গর্ভস্থ সন্তানের সাথে সম্পর্ক: মাতৃগর্ভে ভ্রূণ সঞ্চারের সাথে সাথেই এই সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। মা সন্তানের রূপ এবং লিঙ্গ নিয়ে কল্পনা করতে থাকেন। তিনি হয়ত পেটের উপর আনমনে হাত বোলাতে পারেন, তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে পারেন বা গল্প পড়ে শোনাতে পারেন। একটু একটু করে নিজের সন্তানের বড় হয়ে ওঠার নানান মুহুর্তের কথা কোথাও লিখে রাখতে পারেন।
সদ্যোজাত সন্তানের সাথে সম্পর্ক: সন্তানের জন্মের পরে তাঁর মায়ের সাথে এই সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। মা শিশুর যত্ন নেওয়া শুরু করেন। তাঁর কখন খিদে পেয়েছে, ঘুম পেয়েছে, বা কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে পারেন। এখানে, স্তন্যপান করানো এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সন্তানের বড় হওয়ার (০-৫ বছর) সাথে সাথে মায়েরা কিছু আচরণ যেমন, আদর করা, খাওয়ানো বা ঘুম পাড়ানো, ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এগুলি স্বভাবতই মা ও সন্তানের সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে। মা ধীরে ধীরে তাঁর শিশুর মন মেজাজ ও চাহিদা বুঝতে আরম্ভ করেন।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
দুশ্চিন্তা, হতাশা, দুঃখ গ্লানি – একজন মা তাঁর সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে নানা রকম আবেগের শিকার হতে পারেন। সন্তানের যত্ন নেওয়ার এই আকস্মিক দায়িত্ব, সব সময় তাঁর খেয়াল রাখা, এবং একজন ‘ভাল মা’ হওয়ার মানসিক চাপ, অপরিমিত ঘুম, স্তন্যপান, ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকে নজর দেওয়া, ইত্যাদি তাঁর জন্য মানসিক এবং শারীরিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সামান্য দুশ্চিন্তা হয়ত সব মায়েরই হয়। কিন্তু এর ফলে যদি দৈনিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পরে তবে তা নিয়ে মাথা ঘামানো প্রয়োজন।
যে লক্ষণগুলি স্বাভাবিক | যে লক্ষণগুলির ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসা প্রয়োজন |
কখনও কখনও মেজাজ বিগড়ে থাকা হতাশা | সব সময়ে বাচ্চার উপর রেগে থাকা |
ক্লান্তি, যা বিশ্রাম বা ঘুমের সাহায্যে কমানো সম্ভব | বাচ্চার সমস্ত দেখভালের দায়িত্ব অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়া |
মা তাঁর কাজকর্ম সব গুছিয়ে করতে পারেন এবং সন্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক | স্তন্যপানকে এক স্নেহসুলভ আচরণ হিসেবে না দেখে, এক বাধ্যতামূলক কাজ হিসেবে দেখা |
মা হওয়ার পরে জীবনে পরিবর্তন নিয়ে কখনও সখনও দুঃখ প্রকাশ করা | সন্তান মানুষ করার মধ্যে কোনও সুখ না খুঁজে পাওয়া। সন্তানকে ঘৃণা করা বা তাঁর জন্মানো নিয়ে আপসোস |
এছাড়া গভীর দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, হতাশা, খিটখিটে মেজাজ মায়ের রোজকার জীবনযাত্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে অবিলম্বে একজন মনোবিদের সাথে যোগাযোগ করুন।
মা যদি নিজের সন্তানকে অস্বীকার করেন?
বিভিন্ন কারণে একজন মা তাঁর সন্তানকে অস্বীকার করেন:
যদি মায়ের পূর্ববর্তী কোনও মানসিক রোগের ইতিহাস থাকে
ছোটবেলায় নিজে মায়ের থেকে সঠিক যত্ন না পেয়ে থাকলে, সন্তানের সাথে তিনিও একই রকম ব্যবহার করবেন
প্রসবকালীন পীড়া মায়ের মনে সন্তানের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করতে পারে
অনিচ্ছাকৃত বা অবাঞ্ছিত গর্ভাবস্থা (যৌন নিপীড়ন)
সন্তানের মধ্যে কোনও বিকৃতি বা জটিল রোগ থাকলে
আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিবারেই গর্ভবতি মহিলা নিজের মা বা শাশুড়ির থেকে সহায়তা পান, ফলে সন্তানের প্রতি অনীহার কারণ বার করা একটু কঠিন হতে পারে। তাও পরিবারের সমস্ত সদস্যরাই মায়ের আচার আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখতে পারেন এবং প্রয়োজন অনুসারে একজন মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
পরিস্থিতি সামাল দেওয়া
মা এবং সন্তানের বন্ধনের অন্তরায়কে ঘোচাতে পরিবারের সবার সহায়তা প্রয়োজন। একজন মায়ের আচার আচরণের দিকে নজর রাখার মাধ্যমে, তিনি সন্তানের ডাকে সাড়া দিতে পারছেন কিনা তা বোঝা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, কোনও কোনও মায়ের ক্ষেত্রে এই নজরদারই ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে করা হতে পারে। এই ভাবে তাঁর কাজের পদ্ধতি জানলে তাঁকে রাস্তা দেখানো অনেকটা সহজ হবে।
শিশুকে স্নান করানোর আগে মালিশ করতে বলা হতে পারে। এই জন্যে মা কে শিশুকে কোমল ভাবে স্পর্শ করতে বলা হয়। তাছাড়া বাচ্চার চোখে চোখ রেখে হাসা ও কথা বলার উপরেও জোর দেওয়া হয়।
মায়ের সন্তানের সাথে মানাতে অসুবিধা হলে তাঁকে দোষ দেওয়া উচিত না। অনেক সময় সামাজিক কুন্ঠার কারণে পরিবারের কোনও লোক চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করেন না। কিন্তু এটি একটি মানসিক সমস্যা বলে বোঝা প্রয়োজন। এবং পাশাপাশি এটাও বোঝা প্রয়োজন, যে সঠিক সাহায্য পেলে মা তাঁর সন্তানের সাথে আগামী জীবন আনন্দে কাটাতে পারবেন। অন্য কেউ যেন সম্পূর্ণ দায়িত্ব না নিয়ে নেন। অনেক সময় চূড়ান্ত মানসিক জটিলতা থাকা সত্ত্বেও একজন মা টুকটাক কাজ, যেমন বাচ্চার জামা গোছানো, বা খাবার তৈরি করার মতন কাজ খুব সহজেই করতে পারেন।