আমি আর আমার এক পুরনো বন্ধু ফেসবুকে একটা বোকা, আসক্তিপূর্ণ কুইজ খেলতাম। প্রশ্নটা ছিল, 'এখন থেকে দশ বছর পরে তোমার পরিচিতি কী হবে'- এটা কি খুব একটা যুক্তিপূর্ণ ছিল। আমার বন্ধু আমার থেকে বয়সে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট ছিল এবং সে ছিল সদ্য বিবাহিত। সে স্বাভাবিকভাবে বলেছিল,' কিন্তু তুমি কি শুধু মা হিসেবেই পরিচিত হবে, না?'
মা, হয়তো তাই। কিন্তু কোনও কারণে আমি সেই সময়ে আমার বন্ধুর মন্তব্যের কোনও তল খুঁজে পায়নি। আমার মাতৃত্বমুখী-স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্কে দুটো ছবি ফুটে উঠেছিল; একটা ছবি ছিল আমি আর আমার বন্ধু লন্ডনে পার্টি করছি আর সেটাই ছিল আমাদের জীবনযাত্রার অঙ্গ। আর অন্যটা ছিল যখন আমি বাথরুমে বসে আছি তখন আমার বাচ্চা আমার কোলে টলমলে পায়ে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে। আর তৃতীয় হল আমি আর আমার বাচ্চা কোনও কারণ ছাড়াই অনিয়ন্ত্রিতভাবে হাসছি, কোনও দিকেই আমাদের মন নেই। এবং শেষ পর্যন্ত আমার
বুদ্ধি-বিবেচনাই জয়ী হল।
কিন্তু অবাক কাণ্ড, এই ঘটনা আমাকে তার কাছ থেকে আরেক ধাপ পিছিয়ে দিল, তবু আমি আরেকজন বন্ধু পেলাম।
কেউ আপনাকে সতর্ক করবে না যে যখন আপনি মা হতে চলেছেন তখন কীভাবে আপনি আপনার সবচাইতে কাছের বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখবেন। সেই সঙ্গে একজনও কেউ আপনাকে বলে দেবে না যে মাতৃত্বের যাত্রাপথে একলা চলার বিষয়টা আসলে ঠিক কী। আপাতভাবে সারা পৃথিবীর মহিলারা এই বিষয়ে যে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয় তা হল- মা হলে জীবন বদলে যাওয়া উচিত নয়, এর ফলে কি মহিলাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্কের বন্ধন আরও জোরদার হয়ে ওঠে? কিন্তু এর পরিবর্তে আমার নিজেকে এই বিশাল বন্ধুত্বপূর্ণ জগতে একা বলে মনে হয়েছিল। আমার মনে আছে স্কুল থেকে যে বন্ধুটির সঙ্গে আমি খুব গল্পগুজব করতাম, যে আমার আগেই দুই বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছে সে আমি মা হওয়ার পরে আমার বাচ্চার জন্য আমি কতটা চিন্তান্বিত- সেসব কথাই বারবার বলত (যেমন- প্রথম বাচ্চার ক্ষেত্রে তাঁর খুব নাকউঁচু ভাব ছিল)। আমার এ-ও মনে আছে আমি একটা দুপুর আমার প্রাক্তন সহকর্মীর সঙ্গে কাটিয়েছিলাম বলে নিজেকে খুব অপরাধী বলে মনে হয়েছিল, যে সহকর্মী আমার সঙ্গে দেখা করে আমার বাচ্চার ঢেঁকুড় ও কুলকুচি নিয়ে গল্পগাছা করতে আসত। মাতৃত্ব আমায় ঠিক এমনটাই করে তুলেছিল। আমি এমনিতেই অর্ন্তমুখী স্বভাবের ছিলাম। মা হওয়ার পরে আমি নিজেকে আরও গুটিয়ে নিতে শুরু করেছিলাম। যেটুকু সময় আমি আমার নিজের জন্য রাখতে চাইতাম সেই সময়ে কেউ আমায় বিরক্ত করুক, তা আমার ভাল লাগত না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়টা আমি ঘুমাতাম।
কিন্তু এসব করে আমার মোটেই ভাল লাগত না। আমার সামাজিক দক্ষতাগুলো গুরুতরভাবে ক্রমশ সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমার কথাবার্তাও ওই একরত্তি শিশুর সঙ্গেই বাধাধরা ছিল এবং বাচ্চাকে স্তনপান করানো, শৌচকর্ম করানোর মধ্যেই আমার জীবন আটকে গিয়েছিল। পাঠকরা আমায় ভুল বুঝবেন না, আমার কিন্তু অন্তর থেকে মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। তবু এর ফলে আমায় একাকিত্ব গ্রাস করেছিল এবং সেটা যে খুব অন্যরকম ছিল, তা বারবার মনে হত। বাচ্চার বাইরে অন্য কোনও বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সময় আমার ছিল না। আমার মাথায় সর্বক্ষণ শুধু বাচ্চার চিন্তাই থাকত। এসব সত্ত্বেও আমার একজন সহযোগী স্বামী ও সুন্দর একটা পরিবার ছিল। আমি আমার মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কোনও অন্তঃসারশূন্য বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করতে না পারার জন্য দুঃখ পেতাম; এইসময়ে আমি গায়ক- গায়িকাদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য ইউ টিউবে পুরনো হারিয়ে-যাওয়া সুরগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করতাম।
ইন্টারনেট এইসময়ে আমায় খানিকটা সঙ্গ দিয়েছিল। সেখান থেকেই আমি জানতে পেরেছিলাম পৃথিবীর সব জায়গায় সমস্ত মেয়েরাই এই একই নৌকোর যাত্রী এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমেই আমি মহিলাদের প্রতি আমার 'গোষ্ঠীগত' অনুভূতি খোঁজার চেষ্টা শুরু করি। এর মাধ্যমেই আমি বুঝতে পারি যে এখন আমার 'মা বন্ধু'দের খোঁজা উচিত। কিন্তু যত সহজে আমি বলছি বিষয়টা তত সহজ ছিল না। কিছু ওয়েবসাইটের মধ্য দিয়ে আমি পরামর্শ পেয়েছিলাম যে আমার বাচ্চার জন্য প্রিস্কুলের ঠিকানা খোঁজা এবং সেই স্কুলে বাচ্চার বন্ধুদের মাধ্যমে আমার নতুন বন্ধুর সন্ধান করা জরুরি। আমি তা করার চেষ্টাও করেছিলাম একবার। আমার বাচ্চা যখন প্রিস্কুলের দরজায় পৌঁছলো তখন আমি নিজেকে খানিকটা আড়ালে রাখার চেষ্টা করি এবং দেখি যে ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মায়েরা তাদের সন্তান ও তাদের স্কুলের ব্যাগপত্র নিয়ে আলোচনা জুড়েছে।
বাস্তব ঘটনা হল এভাবে আপনি আপনার অনেক বন্ধুকেই এইসময়ে হারিয়ে ফেলবেন, যেমন আমি হারিয়েছিলাম এবং এখনও সেই অবস্থাই রয়েছে; কিছু বন্ধুত্ব খুবই দুর্বল হয়ে যায় ও বেশিদিন টেকেও না। যদি কারোর ভাগ্য ভাল থাকে তাহলে অত্যন্ত কম সংখ্যক বন্ধুত্ব শক্তিশালী হয়।
একবার ইন্টারনেটে এমন কয়েকটি পরামর্শ পেয়েছিলাম, যা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। আমি শুধু প্রিস্কুল স্তরেই 'মা বন্ধু' পায়নি। ভাগ্য ভালো ছিল বলে আমার বাচ্চা একজন খুব ভালো বন্ধু পেয়েছিল, একইসঙ্গে আমরা দুই মা-ও ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। সেই কেনিয়ান বন্ধুটির সঙ্গে আমার মিলের থেকে অমিলই বেশি ছিল। আমাদের ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সংস্কৃতি, বেড়ে ওঠা- সবকিছুর মধ্যেই বিস্তর ফারাক ছিল। কিন্তু তবু তাতে কোনও সমস্যা ছিল না। আমাদের মধ্যে একটা শক্তিশালী বন্ধন ছিল, আমরা আমাদের বাচ্চাদের নানা বিষয় নিয়ে একে অপরের সঙ্গে নিজেদের অনুভূতি ভাগ করে নিতাম, শিশুদের বিষয়ে মজার গল্প করতাম এবং অভিভাবকত্বের নানাদিক নিয়ে আলোচনা করতাম। আমরা কত কিছু বিষয় নিয়েই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে চাইতাম। এবং সেটাই করতাম।
একজন মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমাদের কথাবার্তাগুলো খুবই বাস্তবসম্মত ছিল। যেমন- আমি তাকে বলতাম যে আমার বাচ্চাটি পৃথিবীর ক্ষুদ্র প্রাণীদের নিয়ে অধিকাংশ সময়ে হতাশ হয়ে যায় এবং সে আমায় বলত যে সেও ওই প্রাণীদের থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। আমাদের মধ্যে একতা ছিল এবং নিজেদের মতামত একে অপরকে চাপিয়ে দিতাম না। আমাদের সেই দিনগুলোয় আমরা ভালো করে ঘুমাতে পারতাম না, বাচ্চাকে স্তনপান করানো, রাতের বেলায় বাচ্চা বিছানা ভিজিয়ে ফেললে তা পরিষ্কার করা, বাচ্চার শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়া- এসব কাজে আমার ও আমার বন্ধুর প্রচুর মিল ছিল। আমরা পরস্পর কথা বলতাম, কাঁদতাম, হাসতাম। আর এভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ়, সুদৃঢ় হয়েছিল। আমাদের মধ্যে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল।
এহেন বন্ধুত্বের বন্ধন আমায় বেঁচে থাকার জন্য নতুন করে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি বিশ্বাস করি মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে আমি জীবনে একজন প্রকৃত বন্ধু পেয়েছিলাম। সেই সঙ্গে পেয়েছিলাম একজন ভালো মানুষের সন্ধান।
ও আচ্ছা, আরেকটা বিষয়ও জানাতে চাই। এখন আমরা দু'জনে বিখ্যাত গায়ক-গায়িকাদের নিয়েও গল্পগুজব করি।