গর্ভাবস্থায় একজন মহিলাকে সাধারণত দুটি কারণের জন্য ভালো-মন্দ খেতে উৎসাহ দেওয়া হয়। এই সময় মহিলাদের ওজন বৃদ্ধি এবং সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই তাদের খাওয়া-দাওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়। তাই দেখা যায় যে, বাচ্চার জন্মের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর থেকে একজন মা দেহের ওজন কমিয়ে নিজেকে গর্ভধারণের আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা কসরত শুরু করেন।
বাচ্চার জন্মের সময় অধিকাংশ মায়েরাই দেহের ওজন বৃদ্ধি বা তাঁদের বেঢপ চেহারার জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের বারবার মনে হয় যে, নিজেদের সমস্ত সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে আগের মতো তাঁরা আর আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারছেন না। এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার পিছনে কতগুলি কারণ রয়েছে। যেমন -
'এখন তোমায় কেমন যেন দেখতে লাগে!'— পারিপার্শ্বিকের এই ধরনের কথাবার্তায় একজন সদ্য মা খুবই বিব্রত বোধ করতে পারেন।
সবে মা হয়েছেন এমন মহিলারা তাঁদের নতুন দায়িত্বপালনে প্রায়শই দিশাহারা হয়ে পড়েন এবং আগেকার দৈনন্দিন ভালো লাগার কাজগুলি করতে না পারার জন্য আক্ষেপ করা শুরু করেন।
প্রতিদিন বাচ্চার বাবা কাজ করতে বাইরে বেরোচ্ছেন, অথচ মাকে শিশুর দেখভালের জন্য ঘরে থাকতে হচ্ছে— এই পরিস্থিতি একজন মায়ের কাছে বন্দিদশার সমান।
ওজন কমানো এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য একজন মাকে প্রায়ই তাঁর বন্ধু-বান্ধব বা পরিজনদের নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এর ফলে মায়েদের মানসিক চাপ বাড়তে পারে।
টেলিভিশনের পর্দায় দেখা একজন অভিনেত্রী বা স্বনামধন্য কোনও মহিলা, যিনি হয়তো কিছুদিন আগে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তাঁর নিখুঁত দেহ-সৌন্দর্য এবং চালচলন একজন নতুন মায়ের মনে প্রভাব বিস্তার করতেই পারে।
এই কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের চারপাশে কম-বেশি সব মায়েরাই প্রসবোত্তর পর্বে এহেন চিন্তাভাবনা এবং পরিস্থিতির শিকার হন। কিছু ক্ষেত্রে এর ফলে মহিলারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আবার অনেক সময় মায়েদের খাদ্যাভাসের অনিয়মজনিত সমস্যা আনোরেক্সিয়া অর্থাৎ ক্ষুধামান্দ্য অথবা বুলিমিয়া নামক রোগের জন্ম দেয়।
রোগের স্বাভাবিক লক্ষণগুলি হল—
মাঝে-মাঝে নিজের আকর্ষণ হারিয়ে যাওয়া বা নিজেকে অসুন্দর লাগা কিংবা মোটা হয়ে যাওয়ার চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকা।
নিজের দেহ-সৌন্দর্যের বিষয়ে অত্যধিক সচেতনতা প্রকাশ পাওয়া।
সন্তান জন্মের পর ফিটনেস সংক্রান্ত বিষয়ে নিজের সঙ্গে বন্ধু বা কলিগদের তুলনা করা।
কোন পরিস্থিতিতে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ দরকার হতে পারে—
নিজের পরিবর্তিত অবয়ব নিয়ে যখন একজন মায়ের চিন্তাভাবনাগুলি লাগাতার এবং লাগামছাড়া হতে শুরু করে।
ক্রমাগত অবসাদে ডুবে যাওয়া ও অনবরত কেঁদে চলা।
এক সপ্তাহের বেশি যদি কেউ অত্যন্ত কম আহার করে অথবা খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ একেবারে হারিয়ে ফেলে।
প্রসব-পরবর্তী পর্বে মায়েদের শরীর-কাঠামোর বদলকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা
সদ্য মা হওয়া মহিলারা তাঁদের পরিবর্তিত শরীর-কাঠামোর জন্য যথেষ্ট চিন্তিত থাকেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের স্বস্তি দিতে পারে এমন কতগুলি বিষয় হল—
সন্তান জন্মের ঠিক পরেই কোনও মহিলা দেহ-কাঠামোয় তাঁর পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে পারেন না। অধিকাংশ সময়ে এর জন্য অন্তত মাসখানেক অপেক্ষা করা জরুরি। এই তথ্যটি সদ্য মায়েদের মনে রাখা উচিত।
বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পরে নিজেকে আগের অবস্থার বা অন্য মহিলার সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়। কারণ এহেন পরিস্থিতিগুলি সব সময়েই অনন্য। অর্থাৎ এই সময়ে একজনের সঙ্গে অন্যজনের মিল খোঁজার চেষ্টা করা বৃথা।
বাচ্চার জন্মের পর তড়িঘড়ি নিজে থেকে জোর করে ব্যায়াম করা চলবে না। এই বিষয়ে ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রথমে অল্প-স্বল্প হাল্কা শরীরচর্চা, একটুআধটু হাঁটাহাঁটিও চলতে পারে। এইক্ষেত্রে বাচ্চাকে নিয়েও বাইরে হাঁটা যায়। এর মধ্যে দিয়ে বিশুদ্ধ হাওয়া-বাতাস পাওয়া যায়।
যতক্ষণ না দেহের ওজন হ্রাস পাচ্ছে, ততক্ষণ নিজেকে সুন্দর রাখার জন্য চুলের যত্ন, ম্যানিকিওর, পেডিকিওর প্রভৃতির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। সুন্দর জামাকাপড় পরে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার একটা চেষ্টা করলে ভালো। এইভাবে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
রঙিন দুনিয়ার তারকাদের সঙ্গে একজন সাধারণ মায়ের কোনও তুলনাই চলে না। কারণ তাঁদের দৈনন্দিন জীবনচর্চা যে সবার থেকে আলাদা, তা ভুলে গেলে চলবে না।
কিছু সময় নিজের মতো করে কাটানো উচিত। কাছাকাছি কোথাও বেড়িয়ে আসা বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠার মধ্যে দিয়েও সদ্য মায়েরা অবসর যাপন করতে পারেন।
এই অবস্থায় মায়েদের উচিত নিজের পছন্দ মতো কাজ করা। এক্ষেত্রে মহিলাদের স্বামী এবং পরিবার যদি বাচ্চার দেখাশুনা করে তাদের সাহায্য করে তবে নতুন মায়েদের পক্ষে এহেন সমস্যার সমাধান করা দ্রুত সম্ভব।
এই ধরনের সমস্যার মোকাবিলায় স্বামী ও পরিবারের ভূমিকা—
গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে পরিবর্তিত শরীর-কাঠামো নিয়ে যে ধরনের মানসিক সমস্যা হয়, তা দূর করতে তাঁর স্বামী ও পরিজনদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই সময় তাদের এমন কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়, যা নতুন মাকে বিব্রত করতে পারে।
যখন একজন মা তাঁর শারীরিক সৌন্দর্য সম্পর্কে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন, তখন স্বামী বা পরিবারের সদস্যদের উচিত তাঁকে তাঁর ভুল ধারণা থেকে বের করে এনে আশ্বস্ত করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন মায়ের তখনই এহেন সমস্যা গভীর হয়ে দেখা দেয়, যখন সে তার পরিবার-পরিজনদের কাছ থেকে কোনও বিরূপ মন্তব্য বা সমালোচনা শোনে। তাই এই সময় মহিলাদের দরকার পরিবারের আন্তরিক সহযোগিতা।
সর্বোপরি, প্রসবোত্তর সময়ে একজন সদ্য মায়ের কাছে সবচেয়ে কাম্য পরিবারের সর্বাত্মক সমর্থন এবং উৎসাহ দান। এর ফলে এই ধরনের মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠে একজন মা জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে যেতে সক্ষম হন।