মহিলাদের জীবনে গর্ভাবস্থা এবং প্রসব-পরবর্তী সময়কাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়, শুধুমাত্র মহিলাদের জন্যই নয়, বরং ভ্রূণের বিকাশ এবং একটি শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও সমান তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এইসময়গুলো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যখন একজন মা ও শিশুর সুস্থ থাকার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই প্রবন্ধে মানসিক স্বাস্থ্য এবং গর্ভাবস্থা ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে একজন মায়ের মানসিকভাবে সুস্থ থাকার বিষয়ে আলোচনা করেছেন নিমহ্যান্সের পেরিন্যাটাল সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ প্রভা চন্দ্রা এবং ধাত্রীবিদ্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডঃ লতা ভেঙ্কটরাম।
প্রভা চন্দ্রা: একজন ধাত্রীবিদ্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনি কি মনে হয় যে একজন মহিলার জীবনে গর্ভাবস্থার সঙ্গে তার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি কীভাবে জড়িত থাকে?
লতা ভেঙ্কটরাম: হ্যাঁ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। তবে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নয়; ভ্রূণের বিকাশ ও শিশুর বড় হওয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মাতৃত্বকালীন মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে গর্ভাবস্থাকালীন ভ্রূণের বিকাশ এবং বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। অনেক সময়ে এসব ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায় না। আমি বলতে চাইছি যে মহিলারা এইসময় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাকে খুব সহজভাবে প্রকাশ করতে পারে না। আবার ধাত্রীবিদ্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরাও এই সমস্যাকে সহজভাবে ধরতে পারে না। কারণ তাঁরা তাঁদের চিকিৎসার কাজ নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকেন এবং তাঁদের সচেতনতারও অভাব থাকে। তাই এর প্রভাব শুধু মহিলাদের ওপরই নয় বরং ভ্রূণের বিকাশও এতে প্রভাবিত হয়।
হবু মায়েদের মধ্যে যদি মানসিক চাপ বা অন্য কোনও মনোরোগ বা মানসিক সমস্যা থাকে তাহলে জন্মের সময় বাচ্চার কম ওজন, সময়ের আগেই তার জন্ম প্রভৃতি ঘটনা ঘটে থাকে। বাচ্চার ওজন যদি কম হয় তাহলে তার মানে শুধু এই নয় যে, মায়ের গর্ভে থাকার সময়ে বাচ্চার ঠিকমতো বিকাশ হয়নি। বরং এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হয়। আপনি ঠিকই বলেছেন, এর ফলে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন এবং হার্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে ওই শিশুটির জীবনে। এমনকী, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা যেমন- অ্যাটেনশন ডেফিশিট হাইপারঅ্যাকটিভ ডিসঅর্ডার, অবসাদ, বিহেভায়রল বা আচরণগত সমস্যা, স্কিৎজোফ্রেনিয়া- এসব রোগের সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
প্রভা চন্দ্র: হ্যাঁ, আমার মনে হয় মায়েদের গর্ভাবস্থা এবং প্রাথমিকভাবে প্রসব-পরবর্তী পর্যায়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে আমাদের মনোযোগ, দৃষ্টি এবং অর্থ ব্যয় করা জরুরি।
লতা ভেঙ্কটরাম: হ্যাঁ এগুলো একান্ত আবশ্যক।
প্রভা চন্দ্র: ধাত্রীবিদ্যার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনার কাছে মায়েরা ঠিক কী ধরনের সমস্যা নিয়ে আসেন? তাদের মধ্যে কোনধরনের মানসিক সমস্যা দেখা যায়?
লতা ভেঙ্কটরাম: প্রায় সময়েই তারা নিজেদের মানসিক সমস্যাগুলোকে বুঝতেই পারে না। আর সেটাই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যা। এইজন্য একজন ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞের উচিত নিজেকে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার হালহকিকত সম্পর্কে দক্ষ করে তোলা। এর সঙ্গে থাকা জরুরি একজন রুগির সচেতনতা। স্বাস্থ্যশিক্ষার অঙ্গ হিসেবে আমাদের তাদের জানানো দরকার যে কখন তাদের সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসা উচিত, কী ধরনের সমস্যার কথা আমাদের জানানো উচিত এবং গর্ভাবস্থার সময়ে স্বাভাবিক নয় এমন ঘটনা বা বৈশিষ্ট্যর বিষয়ে তাদের ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন।
আসলে গর্ভধারণ প্রতিটি মহিলার জীবনেই অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। আমি সব মহিলাদের উদ্দেশ্যেই বলতে চাই যে, তারা যেন মনে রাখেন যে তাদের শরীর সন্তানধারণ আর স্বাভাবিক পদ্ধতিতে প্রসবের জন্য তৈরি। কিন্তু আমি এটাও বলব যে, ইদানীংকালে গোটা প্রক্রিয়াটিকে ঘিরে যথেষ্ট মানসিক চাপ সৃষ্টি করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তাই প্রত্যেক মায়েদের উচিত গর্ভাবস্থার সময়ে স্বচ্ছ ও স্বাস্থ্যকর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। এ সময়ে অযথা দুশ্চিন্তা করা একদম ঠিক নয়।
সন্তানধারণ সম্পর্কে মহিলারা অনেক কিছু জানেন। কিন্তু তাদের জানা সব খবরাখবর কিন্তু সঠিক নাও হতে পারে। তাই আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এই বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা এবং সেগুলো ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করা যাতে তাদের মানসিক চাপ কমে।
সন্তানধারণের সঙ্গে সঙ্গে একজন মহিলার জীবনে অনেক দায়দায়িত্ব এসে পড়ে। আসলে তারা সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠতে চায়। আমার মনে হয় এই সময় মহিলাদের উচিত চাপমুক্ত হয়ে নিজেদের জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন ঘটানো। ছোট পরিবারগুলির ক্ষেত্রে মানসিক চাপ বেশি থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মানসিক স্বাস্থ্য ও ধাত্রীবিদ্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞের অভাব। এটা সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমার খুব ভালো লাগছে যে এই বিষয়টা নিয়ে আমরা পারস্পরিক আলোচনা করছি কারণ আমার মনে হয় এটাই একদম ঠিক সময় মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ এবং ধাত্রীবিদ্যার ডাক্তারদের একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার। এর ফলে মহিলারা প্রভূত উপকৃত হবেন।
মহিলাদের গর্ভাবস্থার সময়ে তার পরিবারের সদস্য এবং স্বামীর ভূমিকা
প্রভা চন্দ্র: আপনি কি একজন সন্তানসম্ভবা মা বা তার পরিবারের লোকজনদের কিছু পরামর্শ দেবেন গর্ভাবস্থার সময়ে হবু মায়ের সুস্থ থাকার বিষয়ে? আমরা জানি যে এইসময় তারা খুবই চিন্তাগ্রস্ত থাকে। অনেক বিষয় নিয়ে এইসময়ে তথ্য আদান-প্রদান হয়। কিন্তু ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক দিকগুলিই বেশি প্রকাশ পায়। যেসব হবু মায়েরা আপনার কাছে সন্তান প্রসবের জন্য আসে তাদের আপনি কী পরামর্শ দেন? এইসময় কী করা উচিত যাতে তারা সুস্থ থাকতে পারে?
লতা ভেঙ্কটরাম: আমার মতে ডাক্তারের আশ্বাসবাণীর সঙ্গে প্রয়োজন পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক সাহায্য। যেমন সন্তানসম্ভবা মহিলার মা, শাশুড়ির উচিত হবু মাকে বোঝানো যে মেয়েদের জীবনে গর্ভধারণ খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসময় জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এই ধরনের সাহায্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং পরিবারের সদস্য- দু'দিক থেকেই আসা জরুরি। মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকা এইসময়ে ভীষণ দরকার। আমি তো আগেই বলেছি জীবনধারার বদল ঘটানো প্রয়োজন। এর সঙ্গে জরুরি অতিরিক্ত কাজের বোঝা এবং ছুটোছুটি কমানো। এইসময়ে একজন মহিলার পক্ষে মরিয়া হয়ে কোনও কাজ করা উচিত নয়। মানসিক চাপ কমাতে পছন্দের কাজ করা এইসময়ে খুবই কার্যকরী। গর্ভাবস্থার সময়ে মহিলাদের নিজেদের সৃষ্টিশীলতার উপর জোর দেওয়া জরুরি। এসব কাজকর্মের মধ্য দিয়ে তারা মাতৃত্বকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। যোগব্যায়াম একজন হবু মায়ের ক্ষেত্রে খুবই ফলদায়ক হয়। যোগব্যায়ামের সঙ্গে গর্ভাবস্থার যোগাযোগ সম্পর্কিত পড়াশোনাও এইসময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এর ফলে শুধু মানসিক চাপই কমে না, বরং সমস্তরকম জটিলতাও কমে যায়। যদি হবু মায়ের মানসিক চাপ কম থাকে তাহলে স্বাভাবিক উপায়ে প্রসবের সম্ভাবনা থাকে এবং প্রসব সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যাও অনেক কম দেখা যায়।
প্রভা চন্দ্র: তাহলে আপনার কি মনে হয় এইসময়ে মহিলাদের স্বামীদেরও অনেক দায়িত্ব থাকে? কারণ তারা তো সবসময়ে স্ত্রীদের কাছে থাকতে পারে না, পরিস্থিতির উপর নজর দিতেও পারে না। তারা মনে করে হরমোনের প্রভাবেই যাবতীয় সব কিছু ঘটছে। তাই এই পরিস্থিতিতে স্বামীরা হবু মায়েদের অর্থাৎ স্ত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের পাশে কীভাবে দাঁড়াতে পারে?
লতা ভেঙ্কটরাম: স্বামীদের উচিত স্ত্রীদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা এবং সর্বাঙ্গীন পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা। তাদেরকে এও বুঝতে হবে যে গর্ভাবস্থার সময়ে মহিলাদের মেজাজ-মর্জির অহরহ বদল ঘটে। এইসময়ে স্বামীদের উচিত তাদের স্ত্রীদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বিষয়ে ডাক্তারের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ রাখা। এটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গর্ভাবস্থার পুরো সময়টা, এমনকী সন্তান প্রসবের সময়েও, একজন স্বামীর উচিত তার স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা। তবে এখানেই শেষ নয়। প্রসব-পরবর্তী সময়েও একজন স্ত্রীর প্রয়োজন পড়ে তার স্বামীর সাহায্যের। প্রসব-পরবর্তী সমস্যাগুলোর আবার আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। এই সময়টায় অন্যরকম লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ এই সময়ে নতুন সংযোজন হিসেবে থাকে একটি সদ্যোজাত শিশুর দেখভাল করার বিষয়টি। বাচ্চার জন্মের পর অনেক সামাজিক সমস্যারও মুখোমুখি হতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে বাধানিষেধ, অনিদ্রাজনিত নানা সমস্যা।
প্রভা চন্দ্র: তাই সন্তানসম্ভবা একজন মহিলার স্বামী বা তার পরিবারের সদস্যদের সহানুভূতিশীল হতে হয়। আমরা প্রায়শই বলি স্বামীদের কিছু দায়িত্ব পালন করতে, যেন তারা শুধু ব্যস্ত বাবা হিসেবে কাজ নিয়ে মেতে না থাকেন। এই পরিস্থিতিতে বাবা যদি বাচ্চার যত্নের জন্য রাতে কিছু ঘণ্টা বেশী জেগে থাকেন তাহলে সেটা মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির কারন হয়ে উঠবে।
লতা ভেঙ্কটরাম: একদম ঠিক বলেছেন আপনি।
গর্ভাবস্থা এবং তার আগের সময়ের মানসিক অসুস্থতা
প্রভা চন্দ্র: কিছু মহিলার ক্ষেত্রে গর্ভধারণের আগে থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা থাকে। সেই সমস্যা গুরুতর হতে পারে অথবা প্রথম বাচ্চার জন্মের পর অবসাদ, উদ্বেগ বা ব্যক্তিত্ববিকারে আক্রান্ত হতে পারেন মহিলারা। এক্ষেত্রে কীভাবে একজন ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ মহিলাদের সাহস দেবেন এই সমস্যাটি কথা জানানোর জন্য এবং মহিলারাই বা এক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে কী বলবেন? কারণ মহিলারা অনেকসময় তাদের মানসিক সমস্যাগুলো ডাক্তারের কাছে বলে না। তাদের কাছে সেই সময় গর্ভধারণের বিষয়টাই বেশি গুরুত্ব পায়। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাটাকে তখন তারা অবহেলা করে ডাক্তারের কাছে গোপন করে যায়। এই পরিস্থিতিতে মহিলাদের আপনি কি পরামর্শ দেবেন?
লতা ভেঙ্কটরাম: গর্ভবস্থার আগে মহিলাদের মধ্যে যদি মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা দেখা দেয় তাহলে তা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে এবং মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে। যদি মহিলাদের মধ্যে খুব মানসিক চাপ থাকে তাহলে কাউন্সেলরের সঙ্গে যোগাযোগ করা একান্ত জরুরি। আসলে মনোবিদের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে নানরকম বিধিনিষেধ, সংস্কার কাজ করে। কিন্তু আমার মতে, নিজেদের সন্তানের ঝুঁকির কথা ভেবে মহিলাদের উচিত মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা। মা এবং বাচ্চার ভালোর জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
প্রভা চন্দ্র: হ্যাঁ আপনি একদম সঠিক বলেছেন। আসলে এমন অনেক মা থাকেন, যাদের কথা আপনি একটু আগেই বললেন, তারা গর্ভাবস্থার সময়ে মনোরোগের ওষুধগুলো পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ করে দেয়। কারণ তারা ভাবে যে ভাবী সন্তানের উপর এর প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু মায়েদের জানা উচিত, অবসাদ বা উদ্বেগের সমস্যা সমাধানের যদি সঠিক চিকিৎসা না হয় তাহলে তা ওষুধ খাওয়া বন্ধ করার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। আর এটাও জেনে রাখা ভালো যে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক নিরাপদ ওষুধ রয়েছে, যা খেলে গর্ভের সন্তানের কোনও ক্ষতি হয় না।
লতা ভেঙ্কটরাম: হ্যাঁ অবশ্যই। রুগিকে হালকা মাত্রার ওষুধও দেওয়া যেতে পারে। গর্ভাবস্থার সময়ে খাওয়া যায় এমন অনেক নিরাপদ ওষুধ রয়েছে। তাই আমার মনে হয় ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে হবু মায়েদের অযথা ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।
প্রভা চন্দ্র: এর সঙ্গে মায়েদের উচিত একজন ধাত্রীবিদ্যার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তাদের মনের চিন্তা, ভয় বা আশঙ্কা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা। কারণ সমস্যা যদি খুব গুরুতর না হয়, তাহলে ওষুধ না খেলেও চলে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং-এর সাহায্য নেওয়া যায়। কিন্তু অনেকসময় শুধু ওষুধ খাওয়ার ভয়েই মহিলারা তাদের মানসিক সমস্যার মোকাবিলা থেকে পিছিয়ে আসে।
প্রসব-পরবর্তী অধ্যায় এবং একজন মায়ের সুস্থ থাকা
প্রভা চন্দ্র: প্রসব-পরবর্তী পর্যায় একজন মহিলার জীবনে খুবই কোমল ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে মহিলাদের জীবনে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকিও থাকে বেশি। ভারতের মতো বিশাল সাংস্কৃতিক সমস্যায় পূর্ণ দেশে এই মানসিক রোগগুলো মূলত আচার-বিচার সর্বস্ব ও লিঙ্গভিত্তিক হয়।
লতা ভেঙ্কটরাম: একদম ঠিক। আসলে অধিকাংশ মহিলাই তো ছেলের জন্ম দিতে ইচ্ছুক থাকে। কিন্তু বাস্তবে ছেলের বদলে যদি মেয়ে হয় তাহলে তাদের মধ্যে অবসাদের সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে।
প্রভা চন্দ্র: হ্যাঁ একথা সত্যি। নিজেদের বাচ্চার সম্পর্কে খুব সাধারণ মন্তব্য যেমন- 'বাচ্চার গায়ের রং তেমন ফর্সা নয়' বা 'বাচ্চাটা ভীষণ রোগা'- এসব শোনামাত্র মহিলারা অর্থাৎ মায়েরা দুর্বল হয় পড়ে। তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফুটে ওঠে। আমরা মাঝে মাঝে দেখি যে বাচ্চার জন্মের পর মায়েরা বিষণ্ণ থাকে, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে মায়েরা ভাবে তারা পরিবার থেকে এবার হয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বা তারা পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারল না। আপনার মতে প্রসব-পরবর্তী সময়ে মহিলাদের পরিবারের ভূমিকা ঠিক কী হওয়া উচিত? কারণ সদ্য মায়েদের তো বাচ্চার জন্মের পর হয় শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হয় আর না হয় বাপের বাড়িতে থাকতে হয়।
লতা ভেঙ্কটরাম: প্রসব-পরবর্তী সময়ে মহিলাদের পুষ্টির উপর নজর দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই সময়ের খাওয়াদাওয়ার উপর অনেক বিধিনিষেধ থাকে। তাছাড়া জল, পুষ্টিকর খাবারদাবার, বাইরে বেরনো প্রভৃতির উপরেও নানা নিয়ন্ত্রণ থাকে। এগুলোর ফলেও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অন্য দিকটি হল এইসময় কীভাবে একজন মহিলাকে সাহায্য করা যেতে পারে, যে কিনা তার সদ্যোজাত সন্তানকে দেখভাল করছে। মা যদি মানসিক অবসাদ বা চাপের মধ্যে থাকে তাহলে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বা বাচ্চার সঙ্গে মায়ের বন্ধন তৈরির ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। তাই মায়েদের পাশে এইসময় পরিবারের লোকজনদের থাকতে হবে, তাকে সাহায্য করতে হবে। সেই সঙ্গে ছোটখাটো বিষয় যেমন- প্রথা, আচার-বিচারগুলো নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। যেগুলো অর্থবহ সেই প্রথাগুলো মায়েদের মানা উচিত। কিন্তু সেগুলো যেন মায়েরা আনন্দের সঙ্গে মানতে পারে। তাতে যেন তাদের মধ্যে মানসিক চাপ দেখা না দেয়। মহিলারা যা কিছু এইসময় গ্রহণ করবে তা যেন তারা উপভোগ করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে একজন মহিলার স্বামীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি জানি স্বামীদের এইসময় স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির মধ্যে সংযোগ রেখে চলতে হয়। তবু এই পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে চলাটাই তাদের পক্ষে খুবই জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
প্রভা চন্দ্র: যদি মায়েদের মধ্যে মানসিক কোনও সমস্যা থেকে থাকে এবং পরিবারে অনেক সদস্য থাকে তাহলে মনে করা হয় যে বাচ্চার কোনও ক্ষতি হবে না। সে সুস্থই থাকবে। কিন্তু যে কোনও মহিলার ক্ষেত্রেই মায়ের দায়িত্বপালনের জন্য প্রস্তুত থাকাটা একান্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। কোনও কিছুই যেমন হঠাৎ করে হওয়া যায় না, তেমন মা-ও হঠাৎ করে হওয়া যায় না। এমন অনেক মা থাকেন যারা আগেভাগে অনেক কিছু ভেবে আশঙ্কা করেন যে তাদের সঙ্গে হয়তো তাদের বাচ্চার বন্ধনটা জোরালো হবে না। তারা যে অনুভূতি লাভ করতে চান তা হয়তো তারা পান না। আসলে এটা খুবই সাধারণ একটা বিষয়। অনেকসময় মায়েরা বাচ্চার সঙ্গে তেমন একাত্মতা বোধ করতে পারেন না। কারণ মায়েরা নিজেরাই বাচ্চার জন্মের পর ক্লান্ত, অবসন্ন থাকেন। তাছাড়া বাচ্চা ছোট থাকার ফলে তার দেখভাল করাও যথেষ্ট কঠিন কাজ হয় একজন মায়ের পক্ষে। বাচ্চারাও মাঝে মাঝে খামখেয়ালি, বদমেজাজি হয়। তাই মায়েদের নিজেকে সেরা বা অসাধারণ মনে করার কোনও যুক্তি নেই। স্বাভাবিক, সাধারণ অনুভূতি লাভ করাই একজন মায়ের পক্ষে কাম্য।
লতা ভেঙ্কটরাম: গর্ভাবস্থায় একজন মহিলা ও তার পরিবারের প্রত্যাশাগুলো খুব বেশি থাকে। আমার মতে উচ্চ আশা না করে বাস্তবের মাটিতে পা রাখাটাই এইসময় যুক্তিযুক্ত। মা ও বাচ্চার ভালো থাকার বিষয়টি নিয়ে ডাক্তারদের আশ্বাসবাণীও এইসময় অত্যন্ত জরুরি।
প্রভা চন্দ্র: পরিবারের লোকজন ও মায়ের মধ্যে যদি অবসাদ বা উদ্বেগ অথবা ছোটখাটো মানসিক সমস্যা থেকেও থাকে তাহলে তাদের বোঝানো উচিত এই বলে যে 'তোমার খুশি হওয়া উচিত কারণ তোমার একটা ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছে। কেন তুমি দুঃখ পাচ্ছ? কেন তুমি কান্নাকাটি করছ?'। আমার মতে, মায়ের পরিবারের লোকজনদের সচেতন থাকা প্রয়োজন এই ভেবে যে, প্রসব-পরবর্তী সময়টা খুবই দুর্বল অধ্যায়। এইসময় মায়েরা যদি বেশি কান্নাকাটি করে, বাচ্চার থেকে দূরে থাকে বা ভালভাবে ঘুমাতে না পারে তাহলে তার মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এই বিষয়গুলির উপর পরিবারের সদস্যদের সতর্ক নজর রাখা একান্ত কর্তব্য।
লতা ভেঙ্কটরাম: যদি মায়েরা প্রসব-পরবর্তী সময়ে নিজেদের যত্ন নেয় তাহলে তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধাত্রীবিদ্যার বিশেষজ্ঞ বা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে। কারণ বাচ্চা হওয়ার পর মায়েরা নিজেদের দিকে খুব বেশি নজর দেয় না। তাই আমাদের অর্থাৎ ডাক্তারদের উচিত মায়েদের উপর নজর রেখে সময়মতো তাদের মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া।
পোস্টন্যাটাল বা অ্যান্টেন্যাটাল ক্লিনিকগুলোতে এত ব্যস্ততা থাকে যে আমরা অনেকসময় রুগিদের যথাযথ চিকিৎসা বা তাদের সমস্যাগুলোকে খতিয়ে দেখতে পারি না। তাই আমার মনে হয় এই সমস্যার সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত পেরিন্যাটাল ক্লিনিক গড়ে তোলার সময় হয়ে গিয়েছে। কারণ গর্ভাবস্থাকালীন মানসিক সমস্যার সমাধানের জন্য এইধরনের ক্লিনিকগুলো খুবই কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।