মাতৃত্ব

যোগব্যায়াম আমায় সুস্থ থাকতে সাহায্য করে

নয়না কণ্ঠরাজ

গর্ভাবস্থা একটি ভয়ঙ্কর সুন্দর সময়। এই সময় একজন মহিলা নিজের সন্তানের মঙ্গল চান। আশে পাশে সবাই সেই ব্যাপারে পরামর্শ দিতে শুরু করেন। সজ্ঞ্যানে বা অজ্ঞ্যানে তিনি তখন শুধু সন্তানের কথাই ভাবেন।

আমারও ঠিক একই রকম একটি অভিজ্ঞতা আছে। যখন আমি প্রথমবার গর্ভবতী হয়েছিলাম, আমি তখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করতাম এবং যোগব্যায়াম শেখাতাম। যাতায়াতের চাপে আমি যোগব্যায়াম শেখানো ছেড়ে দিলাম। জীবনযাত্রায় এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে, এবং অফিসে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে, আমি হাইপার থাইরয়েডিসমে আক্রান্ত হলাম। আমাকে সেইমত ওষুধ-পত্র দেওয়া হল।

তখন আমার ওজন ৫০ কেজি ছিল। ধীরে ধীরে তা ৭৮ কেজিতে এসে দাঁড়াল। আমার রক্তচাপ বেড়ে গেছিল। আমার বাচ্চার জন্ম হবার পরে, আমার ওজন সবার আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল! ধীরে ধীরে আমার মনোবলও ভাঙতে শুরু করল।

আমাকে বাধ্য হয়ে সিজারিয়ান করতে হয়েছিল। প্রসবের ৮ সপ্তাহ পর থেকে আমি যোগব্যায়াম শুরু করলাম। আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম যে ইচ্ছাশক্তি এবং যোগব্যায়ামের সাহায্যে আমি সুস্থ থাকার লড়াইটা জিততে পারব। যখন আমার সন্তানের এক বছর বয়স, আমার থাইরয়েড কমে স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল, আমার ওষুধ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ওজনও আগের মত হয়ে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় বার যখন আমি মা হলাম, ততদিনে আমি পুরোপুরি যোগব্যায়ামের পথ বেছে নিয়েছি। ফলে এইবার আমাকে কোনও রকম জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়নি।

স্ট্রেসের সাথে মোকাবিলা

অনেক মহিলাই গর্ভাবস্থায় নিম্নলিখিত কারণগুলির জন্য অবাঞ্ছিত স্ট্রেসে ভুগতে পারেন:

প্রথম ত্রৈমাসিক: শারীরিক অসুস্থতা (বমি-বমি ভাব, ক্লান্তি, মর্নিং সিকনেস, মাথা ঘোরানো)। এই অবস্থাটা মেনে নিতে মহিলাদের কিছুদিন সময় লাগতে পারে। প্রথম বার হলে মায়েরা শিশুর স্বাস্থ্য নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভুগতে পারেন।

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক:  পিঠের যন্ত্রণা এবং গর্ভের সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তা।

তৃতীয় ত্রৈমাসিক:  পিঠের যন্ত্রণা, হাত-পা ফুলে যাওয়া, প্রসবকালীন যন্ত্রণা নিয়ে আতঙ্ক।

মা খুশী, তো সন্তানও খুশী

গর্ভাবস্থায় একজন মহিলার তাঁর পরিবারের কাছ থেকে সব রকম সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। অধিকাংশ মিহিলাই দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের দিকে চনমনে ও উৎসাহী বোধ করেন। এই সময় ব্যায়াম হিসেবে যোগব্যায়াম সবথেকে নিরাপদ বিকল্প।

এই সময় যোগব্যায়াম করলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও রক্ত সঞ্চালন আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়। ফুসফুসের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এবং সুস্থ দেহের ফলে সুস্থ মন গড়ে ওঠে। এই সময়ে আপনার শরীরে বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তন হয়। ফলে, থাইরয়েড এবং রক্তচাপের সমস্যার পাশাপাশি ডায়াবেটিসও দেখা দিতে পারে। যোগব্যায়ামের সাহায্যে এই সমস্ত সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব।

মন প্রসন্না উপায় যোগা ”: সুস্থ মনের চাবিকাঠি হল যোগব্যায়াম। বিভিন্ন আসন, প্রাণায়াম এবং ক্রিয়াযোগের সাহায্যদে নিজের মনের ও চিন্তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আপনি গর্ভবতী হলে নিম্নলিখিত আসনগুলি করে দেখতে পারেন:

(বি:দ্র: যে কোনও ব্যায়াম করার আগে একবার চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে নিন এবং একজন পেশাদার শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে করুন)

বদ্ধকোণাসন

এটি যেকোনও ত্রৈমাসিকে করা যেতে পারে।

প্রণালী:

  • সোজা হয়ে বসুন
  • হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের পাতা এক জায়গায় আনুন
  • হাঁটু দুটি এবার হাওয়ায় দোলান

উপবিষ্ট কোণাসন

প্রথম দুটি ত্রৈমাসিকে এটি করতে কোনও সমস্যা না হলেও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আপনাকে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হতে পারে।

প্রণালী:

  • সোজা হয়ে বসুন এবং পা দুটিকে যতটা সম্ভব দুপাশে ছড়িয়ে দিন
  • নিজের হাত দিয়ে ঊরূর উপরে ভর দিন।
  • বাঁ হাত তুলে ডান দিকে কাত হন
  • একই রকম ভাবে ডান হাত তুলে বাঁদিকে কাত হন
  • এইরকম ভাবে দিনে পাঁচ বার অভ্যাস করতে হবে

বিড়ালাসন এবং ব্যাঘ্রাসন:

এই ক্ষেত্রেও কোনও রকম বাধানিষেধ নেই

প্রণালী:

  • হাঁটু এবং হাতের উপরে ভর দিয়ে চতুষ্পদ প্রাণীর ন্যায় বসুন
  • গলা নামিয়ে ভর পিঠ বেঁকিয়ে নিশ্বাস নিন
  • উপরে ছাদের দিকে তাকান
  • নিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করুন
  • এইরকম ভাবে দিনে পাঁচ বার অভ্যাস করতে হবে

শিশুর জন্মের পরে

নয় মাস ধরে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার পরে যখন আপনি সন্তান প্রসব করবেন তখন সব কিছুই আলাদা মনে হতে পারে। পুঁথিগত বিদ্যা আর বাস্তবের মাঝের বিশাল ফারাক আপনাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে তুলতে পারে।

এই অবস্থায়, একজন মহিলার সব রকম সাহায্যের প্রয়োজন। কারণ আগামী সপ্তাহগুলিতে তিনি সন্তানের সাস্থ নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। ফলস্বরুপ তিনি মারাত্মক ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। শিশু যদি নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, মায়ের ঝক্কি তাহলে কিছুটা হলেও কমে; কিন্তু যদি সে তা না পারে, তাহলে মায়ের কাজ আরও একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণা বলছে যে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন মহিলা এই সময় ডিপ্রেশনে ভোগেন। প্রথম সপ্তাহ থেকে ষষ্ঠ মাস অবধি যে কোনও সময় এটা হতে পারে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা ধরা পড়ে না। সামাজিক রীতি-নিতির জালে তিনি আটকে থেকে যান। লোকে যদি জানতে পারে যে তিনি নিজের সন্তানকে সামলাতে পারছেন না তাহলে তাঁরা কী বলবেন? এই আতঙ্ক তাঁকে ক্রমেই গ্রাস করতে থাকে। যদি তিনি এই অবস্থায় সাহায্যের কোনও হাত না পান, তাহলে তিনি সন্তানের থেকে ক্রমেই নিজেকে গুটিয়ে নেবেন। অনেকের মাথাতে এই সময় সন্তানের ক্ষতি করার মতন চিন্তা আসতে পারে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে বা হাউ হাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করতে পারে। সেইক্ষেত্রে যোগব্যায়াম মাথা ঠাণ্ডা রাখতে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করে।

আপনি যদি প্রথমবার মা হয়ে থাকেন, তাহলে প্রসবের ছয় বা আট সপ্তাহ পর থাকেই যোগব্যায়াম শুরু করে দিতে পারেন। এর ফলে আপনি মানসিক শান্তি এবং মেদহীন দেহ, দুটোই লাভ করতে পারবেন। কিছু কিছু আসন আপনার শরীরে মেটাবলিজম আর হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করবে।

অনেক সময়ই চিকিৎসকেরাও শুধুমাত্র মায়ের শারীরিক অসুস্থতার দিকেই নজর দেন। প্রসবের আগে হোক বা পরে, একজন মায়ের যে কোনও অবস্থায় সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। কোনও রকম অস্বাভাবিক আচরণ বা অসংলগ্ন চিন্তা আসা মাত্রই চিকিৎসকে তা জানানো প্রয়োজন, যাতে তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আপনাকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন। এতে মা এবং সন্তান উভয়ই সুস্থ থাকবেন। যোগাভ্যাসের কোনও সঠিক লগ্ন হয় না; যে কোনও মুহুর্তই শুভ লগ্ন হয়ে উঠতে পারে!

যোগব্যায়াম শুরু করার আগে একবার চিকিৎসকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে নিন এবং একজন পেশাদার শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে করুন।

নয়না কণ্ঠরাজ বিম্বা যোগা’র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ব্যাঙ্গালোরে বিগত ১০ বছর ধরে মাতৃত্বকালীন যোগব্যায়াম শেখাচ্ছেন।