বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের মধ্যে নানারকম ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগস্থাপনহীন (নন-কমিউনিকেবল) অসুখ দেখা দিতে পারে। এগুলোকে জীবনযাপনজনিত অসুস্থতা বা লাইফস্টাইল ডিজিজও বলা হয়। এই অসুখগুলোর মধ্যে রয়েছে- ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগ, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা এবং হার্টের অসুখ। এসব পুরনো বা লাগাতার অসুখের মোকাবিলা করা যথেষ্ঠ দুঃসাহসিক কাজ। কারণ এধরনের অসুখ দেখা দিলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বড়সড় পরিবর্তন ঘটে এবং নিয়মিত ওষুধ খেয়ে সমস্যা নিয়ন্ত্রয়ণে রাখতে হয়। সেই সঙ্গে এসব জীবনযাপনজনিত অসুস্থতা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক
হয়ে ওঠে।
হু বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ভারতে হার্টের সমস্যা ও ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক অসুখের ফলে মানুষের মধ্যে অক্ষমতা ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হয়। ভারতে হার্টের নানারকম অসুখে এবং স্ট্রোকের ফলে ২৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া মোট জনসংখ্যার ২৯.৮ শতাংশের মধ্যে হাইপারটেনশন এবং প্রতি বছর কম-বেশি ৬২ লক্ষ ভারতবাসী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
যেহেতু এইধরনের অসুস্থতা লাগাতার হয় তাই তাদের মোকাবিলা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন পড়ে। সেই সঙ্গে মানুষকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়:
শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস ও দুর্বল মানসিক চেতনার মোকাবিলা করা
অসুস্থতার চরিত্র অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা
পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়া
চিকিৎসা এবং ওষুধের ব্যয়ভার বহন করা। এই ব্যয় সাধারণত বয়স্ক মানুষের চিকিৎসা বা পরিচর্যাকারীদের ভরণ-পোষণের জন্যই হয়ে থাকে।
পরিবারের সদস্য বা পরিচর্যাকারীদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল এসব অসুখের ফলে একজন মানুষের মধ্যে হঠাৎ যেসব অনুভূতিগত সমস্যা দেখা দেয় সেগুলোর প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখা। কারণ এগুলোই মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে অসুখের ঝুঁকি এবং চাপের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল অসুখের সঠিক চিকিৎসা করা।
ডায়াবেটিস বা মধুমেহ
সব ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রেই যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেবে তা নয়। কিন্তু ডায়াবেটিসের ফলে অবসাদের মতো মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। একজন অবসাদগ্রস্ত মানুষের যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে তা একজন ডায়াবেটিসহীন অবসাদগ্রস্ত মানুষের চাইতে অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে একজন মানুষের ডায়াবেটিস রয়েছে এবং সেই সঙ্গে অবসাদ থাকা সত্ত্বেও তা নির্ধারণ করা হয়নি, সেক্ষেত্রে নানারকম জটিলতা দেখা দিতে পারে-
ওষুধের প্রতি দুর্বল আসক্তি- ডায়াবেটিস রয়েছে অথচ মানসিক অবসাদ চিহ্নিত করা যায়নি এমন মানুষদের ক্ষেত্রে ওষুধের প্রতি আসক্তির মাত্রা এতই কম থাকে যে এর ফলে ডায়াবেটিসের সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়ে।
দুর্বল গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ- গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ বলত বোঝায় রক্তে শর্করার মাত্রা বা পরিমাণের উপস্থিতি। যেসব মানুষ নিয়ম মেনে ওষুধ খায় না এবং অবসাদের কারণে ওষুধের কার্যকারিতা যাদের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক প্রকাশ পায় না, তাদের মধ্যে রক্তে শর্করার মাত্রা ওঠা-নামা করে।
এভাবেই অবসাদ ও ডায়াবেটিসের সঙ্গে বায়োলজিকাল এবং সাইকোলজিকাল উপাদান ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে। একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের দেহে যদি ইনসুলিন নামক হরমোনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় বা অগ্ন্যাশয় থেকে পর্যাপ্ত ইনসুলিন না পাওয়া যায় তাহলে সেই মানুষটির রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। আবার যখন মানুষের মধ্যে নানারকম চাপ জন্মায় তখন তার শরীরে কর্টিজলের মাত্রা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ব্লাডসুগারের পরিমাণও একলাফে বেড়ে যায়। তখন ডায়াবেটিসের মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, কর্টিজলের ভারসাম্যহীনতা মানসিক অবসাদের অন্যতম কারণ।
আবার যাদের অবসাদ রয়েছে তাদের মধ্যে কর্টিজলের ভারসাম্যহীনতার জন্য গ্লুকোজের মাত্রার হেরফের ঘটে। তাই যদি অবসাদ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা না যায় তাহলে কর্টিজলের ভারসাম্যহীনতার জন্য অবসাদ তো দূর হবেই না, সেই সঙ্গে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাবে এবং তখন তা ডায়াবেটিসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এভাবেই ডায়াবেটিস ও অবসাদের মধ্যে শক্তিশালী সহাবস্থান লক্ষ করা যায়।
এছাড়া ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি, যার মধ্যে অবসাদ নির্ধারণ করা যায়নি তার মধ্যে মানসিক নানারকম উপাদান, যেমন- চাপের মাত্রা, জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব পড়তে দেখা যায়। অবসাদগ্রস্ত মানুষের জীবনযাত্রার মান খুবই নিম্নগামী হয়। যেমন- অস্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া, শারীরিক ক্রিয়াশীলতাকে অগ্রাহ্য করা প্রভৃতি। আর এসবের অবশ্যম্ভাবী ফল হল স্থূলতা বা ওবেসিটি। এসবই ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া অবসাদগ্রস্ত মানুষের ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যা পরোক্ষাভাবে ডায়াবেটিসের পক্ষেও ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচর্যাকারী হিসেবে যদি কেউ নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নজর রাখে তাহলে রুগির মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা সম্ভবপর হয়-
অধিকাংশ সময়ে বিষণ্ণ ও মনমরা হয়ে থাকা
ওষুধ খাওয়া ও পর্যায়ক্রমিক স্বাস্থ্য-চিকিৎসায় অবহেলা করা
নিজের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা
খিদে কমে যাওয়ার সমস্যা
পছন্দের কাজ করতে অনীহা প্রকাশ পাওয়া
মৃত্যু বা আত্মহত্যার চিন্তা করা
এগুলো ছাড়াও অবসাদের আরও অন্যান্য লক্ষণ দেখা যায়।
অবসাদ ও ডায়াবেটিসের সহাবস্থানের কারণে অবসাদে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে যায় তেমন ডায়াবেটিসের রুগিকেও তার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হয় এবং অবসাদের লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তাই এই দুই রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উভয় অসুখের সঠিক চিকিৎসা করা জরুরি।
হার্টের সমস্যা
অধিকাংশ হার্টের সমস্যার পিছনে থাকে জীবনযাত্রাজনিত অব্যবস্থা। এছাড়া মানুষের শারীরিক কার্যকলাপ ও খাদ্যাভ্যাসের উপরেও এই সমস্যা নির্ভরশীল।
করোনারি হার্টের অসুখ (ধমনীর স্থবিরতা),পালমোনারি হাইপারটেনশন এবং স্ট্রোক- এই তিনটি ভারতে মানুষের মৃত্যুর সবচাইতে বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রায়শই মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার মোকাবিলা ও তার চিকিৎসায় হার্টের সমস্যাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাদের পারিবারিক ইতিহাসে হার্টের অসুখ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। সমস্যাগুলোর মধ্যে থাকে- উদ্বেগের সমস্যা, ওসিডি বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, সোশ্যাল ফোবিয়া বা সামাজিক ভীতি বা অন্যান্য নির্দিষ্ট কিছু ভীতি। আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে গুরুতর অবসাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এর ফলে প্রায় ২০ শতাংশ রুগি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১৯ শতাংশ রুগির ক্ষেত্রে অবসাদ তীব্রভাবে দেখা দেয়।
ব্যাঙ্গালোরের নিমহানস্-এর মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার অজিত দাহালে বলেছেন, ''যদি একবার কোনও মানুষের হার্ট অ্যাটাক বা হার্টে কোনও অপারেশন হয়ে থাকে তাহলে সে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব সতর্ক হয়ে যায়। এর ফলে তার মধ্যে স্বাস্থ্যজনিত উদ্বেগ দেখা যায়।''
অন্যদিকে, উদ্বেগের সঙ্গে যুক্ত থাকে করোনারি আর্টারি ডিজিজ-এর ঝুঁকি। ভীতিজনিত উদ্বেগ, সাধারণ উদ্বেগ, আতঙ্কের সমস্যা এবং দুশ্চিন্তাকে হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
এনসিডি এবং মানসিক অসুস্থতার মোকাবিলা
বিশেষজ্ঞদের মতে, বংশগত কারণ ছাড়াও ডায়াবেটিস এবং হার্টের অসুখের জন্য দায়ী থাকে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, যেমন- অত্যধিক মশলাদার খাবার খাওয়া, কম শারীরিক কসরত, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা, সিগারেট এবং মদ্যপান। জীবনযাত্রাজনিত অসুখ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জরুরি সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত
শারীরিক কসরত।
যদি আপনার পরিচিত কেউ ডায়াবেটিস বা হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত হয় এবং আপনি তার আচরণ বা অনুভূতির ক্ষেত্রে কোনও বদল লক্ষ করেন তাহলে অবিলম্বে তার সঙ্গে আপনার কথা বলা প্রয়োজন। আপনি তাকে একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার জন্য সাহায্য করতে পারেন। ডাক্তার দাহালে-র মতে, যদি কেউ আগে থেকেই মানসিক অসুস্থতার জন্য ওষুধ খেতে অভ্যস্ত থাকে সেখানে চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করা। সাধারণ ডাক্তার এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দু'জনের ক্ষেত্রে অবশ্যই জেনে নিতে হবে যে রুগি কী ধরনের ওষুধ খাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে একটা উদাহরণ তুলে ধরা যায়- একইসঙ্গে হাইপারটেনশন এবং অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধ খেলে মানুষের দৈহিক ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
যে কোনও লাগাতার বা পুরনো অসুখের ফলে মানুষের জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাস প্রভাবিত হয়। তার সঙ্গে মানুষকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়। এজন্য সময়মতো খাবার খেতে হয়, ঠিকঠাক ওষুধ খেতে হয় এবং তাদের সর্বাঙ্গীন সুস্থতার প্রতি নজর রাখতে হয়। পরিচর্যাকারী হিসেবে একজনের সাহায্য ও সহানুভূতি একটি বয়স্ক মানুষকে জীবনে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
সূত্র:
এই প্রবন্ধটি লিখতে সাহায্য করেছেন ব্যাঙ্গালোরের জ্ঞান সঞ্জীবনী মেডিক্যাল সেন্টার-এর গ্রন্থিবিশেষজ্ঞ (এন্ডোক্রিনোলজিস্ট) ডাক্তার কমলা থুম্মালা এবং নিমহ্যান্সের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার অজিত দাহালে।