যদি কখনও আপনার বা আপনাদের অসহ্য মাথা যন্ত্রণা বা তীব্র দাঁতের ব্যথা হয়, তাহলে তখন ধারণা করা যায় যে শারীরিক বা দৈহিক ব্যথা-যন্ত্রণা কীভাবে মানুষকে বিপর্যস্ত ও অক্ষম করে তোলে। সেই সঙ্গে যন্ত্রণা যদি দীর্ঘদিন ধরে হতে হতে একেবারে স্থায়ী হয়ে যায় তবে তার প্রভাব মানুষের দৈহিক স্বাস্থ্য, অনুভূতি ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পড়ে।
ক্রনিক অথবা পুরনো বা লাগাতার ব্যথা বলতে কী বোঝায়?
যে ব্যথা বা যন্ত্রণা তিনমাসের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে তাকে ক্রনিক ব্যথা বলা হয়।
সমস্ত ব্যথারই একটা সর্বোচ্চ সীমা থাকে এবং একপ্রকার রক্ষাকবচজনিত উপাদান থাকে, যার দ্বারা আমাদের শরীর যেভাবে কাজ করা উচিত সেভাবে না করলে আমরা সতর্ক হয়ে যাই। এটা তখনই সমস্য হয়ে দাঁড়ায় যখন একজন মানুষের মধ্যে ব্যথা সহ্য করার সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘিত হয়। এইরকম ব্যথা বা যন্ত্রণা একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর শুধু গভীর প্রভাবই ফেলে না সেই সঙ্গে তার মানসিক চাপও বাড়িয়ে দেয়।
যখন ব্যথা বা যন্ত্রণা পুরনো বা লাগাতার হয়ে যায় তখন মানুষের গুণগত জীবনযাত্রার উপর তার প্রভাব পড়ে এবং কীভাবে তারা জীবন যাপন করবে সে বিষয়েও তা নির্দেশ করে (নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে)। শরীর-মনের যোগাযোগ ক্ষমতা যত বাড়তে থাকে ততই স্পষ্ট হতে শুরু করে যে কোনও ব্যথাই শুধু শারীরিক বা মানসিক নয়। অর্থাৎ শরীর-মনে যৌথভাবে ব্যথার প্রভাব পড়ে। যখন যন্ত্রণার প্রভাব মানুষের দৈহিক স্বাস্থ্যের উপর পড়ে তখন তার সঙ্গে সম্পর্কিত আরও অনেক বিষয় থাকে যেগুলো আমাদের চোখে সবসময়ে ধরা পড়ে না।
মানসিকভাবে ব্যথার বোধ খুব অনির্দিষ্ট,অনভিপ্রেত হয়। ব্যথার ফলে অনুভূতিগত দ্বন্দ্বও চলে। সেই সঙ্গে মানুষের নিজস্বতাজনিত বোধের উপরেও তার গভীর প্রভাব পড়ে। ব্যথা বা যন্ত্রণা মানুষের উৎপাদনশীলতার উপর আঘাত করে। আর যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতিফলন পড়তে দেখা যায় অর্থনীতিতে। যদি ব্যথা খুব গুরুতর আকার ধারণ করে তাহলে মানুষকে দিনের পর দিন লড়াই করে জীপনযাপন করতে হয়। পুরনো ব্যথায় আক্রান্ত মানুষের মধ্যে মানসিক ক্লান্তি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় হিসেবে দেখা দেয়।
যেসব ব্যথার তীব্রতা খুব বেশি থাকে তার চাপ মানুষের শরীরে ও মনে পড়ে। আমরা প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ব্যথা বা যন্ত্রণা সহ্য করতে সক্ষম হই। কিন্তু ব্যথার বোধ সেই সীমা অতিক্রম করলে আমাদের শরীরে অবস্থিত কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং তা আমাদের চেতনার স্তরে আঘাত করে। অসহ্য ব্যথা বা যন্ত্রণা হলে মানুষ কোনও কাজে মনঃসংযোগ করতে পারে না; খুব নিস্তেজ বা অধীর হয়ে ওঠে এবং তাদের বিচার-বিবেচনার বোধও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দৈহিক এবং মানসিক যন্ত্রণা
কখনও কখনও দৈহিক যন্ত্রণার ফলে মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। এবং দৈহিক যন্ত্রণার মতো মানসিক যন্ত্রণার পরিমাণ বুঝতে পারা ও তার চরিত্র নির্ধারণ করা সহজ কাজ হয় না। ব্যথা সম্পর্কে মানুষের আশঙ্কা বা দুশ্চিন্তা থেকে মানসিক যন্ত্রণা শুরু হয় এবং ক্রমে তা গভীর হয়ে ওঠে। পুরনো দৈহিক যন্ত্রণার চেয়ে লাগাতার মানসিক যন্ত্রণার মোকাবিলা করা একজন মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তার মানে এই নয় যে দৈহিক যন্ত্রণার তীব্রতা কিছু কম। আর আগেই বলা হয়েছে যে কোনও ব্যথা বা যন্ত্রণাই স্বাধীনভাবে শুধু শরীরে বা মনে দেখা দেয় না; এবং যখন মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে বিচার করা হয় তখন পুরনো যন্ত্রণার মোকাবিলা করা অনেক বেশি কার্যকরী হয়।
বলা হয় যে মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি বা বিকাশের ক্ষেত্রে পুরনো যন্ত্রণার প্রভাব তিনগুণ বেশি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে মানসিক উদ্বেগ বা অবসাদ হওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে। যেখানে পুরনো যন্ত্রণার থেকে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার প্রকোপ বাড়তে দেখা যায় সেখানে এটাও সত্যি, চাপের ফলে মানুষের মন এতটাই বিষণ্ণ হয়ে থাকে যে তার ফলে লাগাতার ব্যথা বা পুরনো যন্ত্রণার বোধ তীব্র হয়ে ওঠে।
পুরনো যন্ত্রণার ক্ষেত্রে নিজের সুরক্ষা-
১. নিজের যত্নের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে ওঠা জরুরি। এর ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যাতে পুষ্টিকর খাবার থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে; যতদূর সম্ভব পারা যায় নিয়মিত শরীরচর্চা করা দরকার। সেই সঙ্গে রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য ঘুমের ধরনে পরিবর্তন আনা জরুরি।
২. লাগাতার যন্ত্রণার উপশমে ফিজিওথেরাপির সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন।
৩. পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের কাছ থেকে মানসিক সাহায্য পাওয়া জরুরি। অথবা যদি প্রয়োজন হয় তাহলে একজন থেরাপিস্টের সঙ্গেও নিজের সমস্যা, দৈহিক সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করা ভালো।
৪. মানসিক চাপ যে কোনও যন্ত্রণার অবনতি ঘটাতে পারে। তাই এক্ষেত্রে চিহ্নিত করতে হবে যে কোন পরিস্থিতির ফলে চাপের সৃষ্টি হচ্ছে এবং চেষ্টা করতে হবে সেই পরিস্থিতি থেকে দূরে থাকার। যদি একান্তই সেই পরিস্থিতির সম্ভাবনা এড়ানো না যায় তাহলে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কৌশল শিখতে হবে। আর এভাবেই নিজের মানসিক চাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
৫. খাবার ধরন নিয়ন্ত্রণ করে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
৬. স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস করা দরকার। তাহলে যতদূর সম্ভব ভালোভাবে ঘুমানো যাবে। এজন্য নিজের শোওয়ার ঘর থেকে সবরকম যান্ত্রিক কৌশল বা যন্ত্রপাতির ব্যবহার দূরে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে যাতে ভালোভাবে ঘুমানো যায় তার জন্য নিজের মনকে শান্ত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
৭. প্রয়োজন মতো মানসিক ও বাস্তব সহায়তার জন্য সহযোগী দলের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করা একান্ত জরুরি।
এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য কাউন্সেলিংরত সাইকোলজিস্ট এবং সাইকো-অঙ্কোলজিস্ট হিবা সিদ্দিকি; নিমহানস-এর নিউরোসাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার শানতালা হেজ; ব্যাঙ্গালোরের জিসার হাসপাতালের কনসালট্যান্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ব্যথা-নিরোধক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আনন্দ জয়রামন-এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।