বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠনের মনোরোগ বিভাগের পরিচালক হিসেবে ১৬ বছর (১৯৭৭-৯৩) কাটানোর পর ডাঃ নরম্যান সার্টোরিয়াস বলেছেন যে কলঙ্ক কলঙ্ক ও লজ্জাই মনোরোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় অন্তরায়। সার্টোরিয়াস ওয়ার্ল্ড সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতিও ছিলেন। হোয়াইট সোয়ানের কর্মী পবিত্রা জয়ারমণের সঙ্গে একটি বিশেষ সাক্ষাতকারে উনি জানালেন যে কেন এবং কিভাবে পেশাদার চিকিৎসক বা সাধারণ মানুষের এই কুণ্ঠা কাটানো উচিৎ।
মানসিক রোগকে বোঝার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা কী?
মনোরোগীদের চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হল লজ্জা। রোগীরা নিজেরাই হীনমন্যতায় ভোগেন। তাঁদের রোগের উপসর্গই অন্যান্য লোকজনকে তাঁদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। সবাই তাঁদেরকে বিপজ্জনক অমানুষ ভেবে ভয় পায়। কাজেই সমাজে তাঁদের প্রতিচ্ছবি এবং তাঁদের জীবনযাত্রায় বদল না আনতে পারলে কোনও অগ্রগতি সম্ভব নয়।
এই ক্ষেত্রে মনোবিদদের ভূমিকা কী?
দেখুন, উক্ত সমস্যাগুলি সর্বত্র উপস্থিত। চিকিৎসক থেকে শুরু করে পুলিশ বা সাধারণ জনগণ সবার মধ্যে এই আতঙ্ক রাজ করে। মানসিক রোগী মাত্রই পাগল যারা অপদার্থ, অমানুষ এবং বিপজ্জনক; সুতরাং এঁদের চেয়ে শতহস্ত দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। এবং এই মানসিকতাই তাঁদের কে দূরে সরিয়ে রেখেছে সমাজ থেকে। আমরা সবাই জানি যে মনোরোগীদের চেয়ে সুস্থ লোকের অপরাধে লিপ্ত হবার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেশী।
কীভাবে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?
নিঃসন্দেহে সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে এই সমস্যাকে জয় করা সম্ভব। একবার ঠাণ্ডা মাথায় বসে একজন মনোরোগীর সাথে কথা বললে বুঝতে পারবেন, যে তাঁরা সাধারণ মানুষের চেয়ে কোনও অংশে আলাদা নন। হ্যাঁ তিনি অসুখের আগে যে রকম ছিলেন তার চেয়ে হয়ত আলাদা। কিন্তু সেটা তো যেকোন অসুস্থতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তাই না? কিন্তু বেশীরভাগ সময়ই আপনি সেই তফাৎ বুঝতে পারবেন না। সঠিক জ্ঞ্যান এই মানসিকতাকে কিছুটা হলেও বদলাতে পারে। তবে পুরোটা নয় কারণ নতুন কিছু শিখলে আমরা শুধু পছন্দের অংশটুকুই মনে রাখি। কাজেই প্রথমে মানসিকতা ও চিন্তাভাবনা পাল্টাতে হবে।
হোয়াইট সোয়ান ফাইন্ডেশনের মত সংগঠন এই ক্ষেত্রে কী করতে পারে?
আপনারা মনোরোগীদেরকেই নিজেদের কথা বলার জন্যে বেছে নিতে পারেন। আমি দেখেছি কোনও বিদ্যালয় বা সংস্থায় এই রকম একজন ব্যাক্তিকে যদি কথা বলার জন্যে নিয়ে যান, সবাই অবাক হয়ে তাঁর কথা শুনবে। সবাই তাঁর কথা শুনে বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে তিনি একজন মনোরোগী।
তাছাড়া, আপনারা চিকিৎসা পেশার সাথে যুক্ত যুবক বা যুবতীদের এই বিষয়ে শেখাতে পারেন যাতে তৃনমূলেই কলঙ্ক ও লজ্জাকে নষ্ট করে দেওয়া যায়। মনে রাখবেন চিকিৎসা পেশায় আমাদের মত সাধারণ মানুষরাই যোগদান করেন। সবাইকে এক ধরণের জ্ঞ্যান না দিয়ে ব্যাক্তিবিশেষে আলাদা ভাবে বোঝালে বেশী কাজ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন পুলিশ, একজন সাংবাদিক এবং এজন চিকিৎসককে আপনি কখনই মনোরোগ সম্বন্ধে এক জিনিস শেখাতে পারেন না। ব্যাস এই দুটোই। এক হল রোগীদের দিয়েই অন্যদেরকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধে শেখানো আর আলাদা করে ব্যক্তি বা একই ধরণের পেশার সাথে যুক্ত লোকজনকে একসাথে মানসিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধে শেখানো।
এছাড়াও মনোরোগীদের পরিবার এবং যারা তাঁদের যত্ন নেন, তাদেরও খেয়াল রাখা উচিৎ। হঠাৎ করে নিজেদের প্রিয়জনের অসুস্থতার কথা মেনে নিতে তাঁদেরও কষ্ট হয়। লজ্জায়, ভয়ে, গ্লানিতে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কাজেই এঁদের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়ে এক নতুন অধ্যায়ের শুভারম্ভ করা উচিৎ।
মনস্তত্ত্ববিদ্যায় এখন অনেক উন্নতির প্রয়োজন। এই মুহুর্তে আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে?
আমার মনে হয় মনস্তত্ত্ববিদ্যার অনেক সম্ভাবনা ও জ্ঞ্যানের সঠিক ব্যবহার হয়না। যেমন সম্পদের বণ্টন। বিভিন্ন দেশে মনোরোগ চিকিৎসা সংগঠন গুলিতে যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয় তা খুবই কম, মাত্র ১-২%। আমরা জানি যে গোটা বিশ্বে সমস্ত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ২/৫ অংশই মানসিক রোগের জন্য। কিন্তু প্রাপ্য অর্থ এবং সমস্যার পরিমাণের মধ্যেকার পার্থক্য বিপুল। আমাদের উন্নতি এর কারণে অনেকটাই আটকে। তেমনি মনোরোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। লোকলজ্জার কারণে কাউকে কিছু শেখানো যায় না এবং চিকিৎসকের চেয়ে সাধারণ লোকেরই প্রতিরোধের দায়িত্ব বেশী। উদাহরণস্বরূপ, প্রচুর বাচ্চারই চক্ষীন দৃষ্টিশক্তি থাকে এবং সময় মত তার চিকিৎসা না হলে সে লেখাপড়ায় বা খেলাধূলায় পিছিয়ে পড়তে পারে, গোটা জীবনটাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আশ্চর্য্যের কথা হল যে কিছু বাবা মা জোর করে ছেলে মেয়েকে চশমা পড়তে দেন না কারণ তাঁদের মনে হয় এতে ছেলে-মেয়েকে দেখতে কুচ্ছিত লাগবে। অথচ এটা কত জটিল একটি সমস্যার কত সাধারণ সমাধান। মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও একইরকম। মনোরোগের চিকিৎসায় আমাদের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবনভর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়মত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে, চিকিৎসার পর বাকি জীবনে অসুখের লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিকে আমি এক হেলায় হারানো সুযোগের যুগ বলব।
এমন প্রচুর মনোরোগ আছে যার কারণ আমরা জানি না।
শিশুদের মানসিক রোগের কথাই ধরা যাক? আপনি যদি রোগের কারণ অনুসন্ধান করতে যান, দেখবেন প্রচুর আছে। যেমন, মায়ের মানসিক সমস্যা, বাবা মায়ের হিংস্রতা, ভীড়, সামান্য অসুস্থতার জন্যে বারংবার হাসপাতালে ভর্তি ইত্যাদি। যেকোন একটা কারণের ক্ষেত্রে যদিও শিশুকে মনোরোগী ধরে নেবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু এইগুলোর সংখ্যা বাড়লে বাচ্চার অসুস্থ হবার সভাবনাও বেড়ে যায়। গবেষণার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলেও আশা করা যায় ভবিষ্যৎে অনেক কিছুই হতে পারে। বাবা মার হিংস্রতা না কমাতে পারলেও শিশুর থাকার ধরন আমরা পাল্টাতে পারি। মা যাতে শিশুর যত্ন নেন, স্কুলে যাতে ওঁর খেয়াল রাখা হয় এগুলো আমরা নিশ্চিত করতে পারি। মনোরোগের পেছনের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে একটাও কমাতে পারলে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করা যায়। কিছুজনের ক্ষেত্রে না হলেও বাকিদের ক্ষেত্রে যে হয় সেটাই আমাদের আশার আলো।