সমাজ ও মানসিক স্বাস্থ্য

মানসিক বিপর্যয় মোকাবিলায় সাহায্য করে সমর্থনকারী গোষ্ঠী

হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন

সমর্থনকারী দল বা সাপোর্ট গ্রুপ বলতে কী বোঝায়?

এই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজন একইরকম জটিলতা বা সমস্যার মুখোমুখি হয় (অথবা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো একইরকম হয়)। এই দলের সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো ভাগ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে স্বস্তি পায়, নিরাপদভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারে, একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারে এবং যে কোনওরকম দুর্দশা মোকাবিলার জন্য বাস্তবসম্মত পন্থার সন্ধান করতে পারে।

সমর্থনকারী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্যানসার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রের চাপ- যে কোনও বিষয় নিয়েই আলাপ-আলোচনা চলতে পারে। এই দলের সদস্যরা ঠিক কী ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করছে তার উপর নির্ভর করে সমাধানের ব্যবস্থা করে এবং সেগুলোর ধরনও ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন- মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ বা স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে এই দল অত্যন্ত নিয়মমাফিক আচার-আচরণ করে। তাঁদের সঙ্গে হয় মুখোমুখি দেখা করে কথা বলে, অথবা অনলাইনে যোগাযোগ করে।

সমর্থনকারী দলের কাজকর্ম কীভাবে হয়?

এই দলের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে নিয়মিত (সাপ্তাহিক থেকে মাসিক) যোগাযোগ বজায় রেখে চলে। তাদের মধ্যে প্রাত্যহিক জীবনের নানা সমস্যার খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা হয় এবং সদস্যরা সমানুভূতি সহকারে সেসব কথা শোনে ও তা সমাধানের জন্য সম্ভাব্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেয়। অধিকাংশ সমর্থনকারী গোষ্ঠীর লক্ষ্য হল সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও বোঝাপড়া গড়ে তোলা যা স্বাভাবিকভাবে দলের বাইরে গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। অনেকসময়ে এই গোষ্ঠী এমন একজন বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানায় যিনি পরিচর্যাকারীদের নানারকম সমস্যা ও তা সমাধানের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। যার ফলে পরিচর্যাকারীরা উপকৃত হয়। যেমন- সমর্থনকারী গোষ্ঠীর দ্বারা আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞরা একজন পরিচর্যাকারী কীভাবে তাঁর  অসুস্থ প্রিয়জনের যত্ন নেবেন সে বিষয়ে নানারকম পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

কীভাবে সমর্থনকারী গোষ্ঠী সাহায্যদায়ক হয়ে ওঠে?

সমর্থনকারী গোষ্ঠীর কাজকর্মের মূল্যায়নজনিত গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে সহকর্মী বা সহযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটা সমর্থনকারী দল তার সদস্যদের উপর খুবই ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বা অনুভূতিগত সমস্যায় আক্রান্ত  একজন মানুষ নিজেকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে। তারা তাদের জীবনকে গোছাতে পারে না এবং সবরকম পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। এই অবস্থায় যদি এমন একজন কেউ থাকেন যিনি ওই মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির মতো একইরকম সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তাহলে তারা সেই পরিস্থিতির  মোকাবিলা করার জন্য পারস্পরিক সাহায্য নিশ্চিত করতে পারেন। সমর্থনকারী দলের সাহায্যে বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার  জন্য নতুন কৌশল শেখা যায় এমনকী, নতুন অভিজ্ঞতাও অর্জন করা যায়।

সমর্থনকারী গোষ্ঠী দলের নতুন সদস্যদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারে। যার ফলে তারা আশ্বস্ত হতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে তারা খুব সুখকর অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। এই গোষ্ঠী মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যকর ও স্বাভাবিক আচরণ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে এবং এক্ষেত্রে সদস্যদের কাছে থেকে তারা ভালো সাড়াও পায়।

কখন সমর্থনকারী দলের সাহায্য যথেষ্ঠ নয়

সমর্থনকারী দলের অনেক ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও সব পরিস্থিতিতেই এই গোষ্ঠীর সাহায্য কার্যকরী ফল দেয় না। যেসব ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা যথাযথ ফল দেয় না সেগুলো হল-

  • যদি সামাজিক পরিস্থিতির কারণে কেউ মানসিক উদ্বেগে ভোগে তাহলে সে নিজেকে চেনা-জানা বা বোঝার জন্য অনলাইন গোষ্ঠীর সদস্য হতে চাইতে পারে।

  • যদি দলের কোনও একজন বা একাধিক সদস্য নিজেদের সীমারেখা মেনে চলতে না পারে তাহলে তা দলের অন্যান্য সদস্যদের কাছে অপছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

  • যদি গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য প্রায়শই মিটিং-এ হাজির না হয় তাহলে ঘটনাক্রমে দলের সদস্য সংখ্যা কম হতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত ওই গোষ্ঠীর অস্বিত্বই আর বজায় থাকে না। এর ফলে দলের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত ও শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে।

  • যদি এই ধরনের গোষ্ঠীর সদস্যদের খুব ঝাড়াই-বাছাই করে নেওয়া না হয় তাহলে একটি দলে বিভিন্ন ধরনের মানুষের উপস্থিতি দেখা দেয়। মানুষে-মানুষে পার্থক্য থাকার ফলে গোষ্ঠীর মধ্যে নানারকম দ্বন্দ্ব জন্মায়। আর সেই দ্বন্দ্ব মেটাতেই অনেক সময় চলে যায়। ফলে অধিকাংশ সদস্যের মনেই নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয় এবং তখন মিটিং-এ হাজির হওয়াটা তাদের কাছে বোঝা বলে মনে হয়।

কীভাবে আপনি একটা সমর্থনকারী গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারেন?

যদি আপনার আশেপাশে কোনও সমর্থনকারী গোষ্ঠী না থাকে বা তার সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করতে না পারেন তাহলে আপনি নিজে একটা এই ধরনের গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে-

একই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য- কোনও গোষ্ঠীর কার্যকলাপ সফল করতে হলে সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক হওয়াটা একান্ত জরুরি।

উদ্যোগী সদস্য- গোষ্ঠীর মধ্যে এমন একজন উদ্যোগী সদস্য থাকতে হবে যিনি আলাপ-আলোচনায় নেতৃত্ব দিতে পারেন। তাঁকে মিটিং-এর দিন স্থির করতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী সদস্যদের সাহায্য করার জন্য একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শের ব্যবস্থা করতে হবে, আলোচনা যাতে ইতিবাচক হয় তা নিশ্চিত করতে হবে,  নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, সদস্যদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ মেটাতে হবে এবং দলের সব সদস্য যাতে তাদের নিজস্ব সীমারেখা ও সীমাবদ্ধতা মেনে কাজ করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

সদস্য- একটা গোষ্ঠী তার সদস্যদের যোগ্যতা অনুযায়ী বা তাদের আগ্রহ অনুযায়ী দলে নিতে পারে। গোষ্ঠীর নিয়মকানুন সদস্যদের কাছে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা জরুরি। গোষ্ঠীটি সদস্যদের পক্ষে কতখানি নিরাপদ তা-ও সঠিকভাবে তাদের জানিয়ে দেওয়া দরকার। সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক গোপনীয়তা বজায় রাখা অবশ্যই প্রয়োজন। একে অপরের প্রতি সমানুভূতিশীল হতে হবে, একে অপরের  বিষয়ে কোনও মতামত না দিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে এবং একে অপরকে অযাচিত উপদেশ দেওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।

নিয়ম মেনে মিটিং করতে হবে- সদস্যদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে মিটিং সপ্তাহে একবার হবে না পনেরো দিনে একবার নাকি মাসে একবার হবে। গোষ্ঠীর সদস্য এবং পরামর্শদাতাদের উচিত মিটিং-এর জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করা। যদি কোনও কারণে সেই জায়গা বদল করতে হয় তাহলে তা গোষ্ঠীর সদস্যদের আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া জরুরি। যদি দলে নতুন সদস্য আসে তাহলে তাদের জন্য পর্যাপ্ত ঘরের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সদস্যদের মধ্যে পরিচর্যাকারীরাও থাকতে পারে এবং তারা যাতে তাদের প্রিয়জনকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় থাকতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

সমর্থনকারী গোষ্ঠী সম্পর্কে আরও তথ্য জানার জন্য আপনারা হু বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা পড়তে পারেন।