সমাজ

উদ্বাস্তু মহিলা: মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা এবং মানসিক আঘাত

ডাঃ শ্যামলা বৎসা

উদ্বাস্তু এবং নিজের দেশ-ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশই  বেড়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে বহু মানুষের ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার ছবি; আফগানিস্তান থেকেও অনেক মানুষ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছে; এই একই ঘটনা ঘটেছে মায়ানমারে। সে দেশের মানুষ বাংলাদেশ ও ভারতে চলে এসেছে; আবার ভুটান থেকেও বহু মানুষ নেপালে পাড়ি দিয়েছে। ব্যাপকভাবে উৎখাত হওয়ার এই ঘটনায় মানুষের মনে চরম আঘাত লেগেছে। নিজেদের দেশ ও ঘর-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার যন্ত্রণা একজন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে যেমনভাবে অনুভূত হয়েছে, ঠিক তেমনই এই ঘটনা একটি আশ্রয়দাতা দেশের সামনেও নতুন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। এই প্রবন্ধে মহিলা উদ্বাস্তুদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যাদের উপরে উৎখাতের ঘটনা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতি ডেকে এনেছে। ইউনাইটেড নেশন হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস্‌ (ইউএনএইচসিআর) নামক সংগঠনের মতে, ''যেকোনও উদ্বাস্তু সমস্যায় মহিলা ও মেয়েদের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ রয়েছে-এরা নিজেদের রাজ্য বা দেশ থেকে উৎখাত হয়ে অন্য রাজ্য বা দেশে চলে গিয়েছে-এই জনসংখ্যার মধ্যে যারা নিঃসঙ্গ, গর্ভবতী, পরিবারের প্রধান, অক্ষম বা বয়স্ক, তাদের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি থাকে।''

যুদ্ধ এবং মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ ছাড়াও নিজের দেশ থেকে উৎখাত হওয়ার পিছনে আরেকটি বড় কারণ হল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে মানুষের জীবনে উৎখাত হওয়ার ঘটনা দেশের অভ্যন্তরেই ঘটে। ২০১৭ সালে অভ্যন্তরীণ উৎখাতের উপরে করা গ্লোবাল রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ২০১৬ সালের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনায় নতুন করে ২৪.২ লক্ষ মানুষ নিজের বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়েছে। আগের বছরগুলোর মতো দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিন, ভারত এবং ফিলিপিন্সের মানুষ সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু ছোট ছোট দ্বীপ-রাষ্ট্রের বাসিন্দারা তাদের মোট জনসংখ্যার তুলনায় সামঞ্জস্যহীনভাবে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে।

মহিলাদের উপর উৎখাত হওয়ার প্রভাব

আমি এমন অনেক উদ্বাস্তু মহিলাদের দেখেছি যারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে নিজেদের দেশ, ঘর বাড়ি থেকে উৎখাত হয়েছিল। সেই ঘটনা তাদের কাছে এক জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা তাদের সম্পত্তি, পরিবারের মানুষকে হারিয়েছিল এবং নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত বহু মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংস নিজের চোখে দেখেছিল। যুদ্ধ ও মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের ক্ষেত্রে মহিলারা প্রায়শই যৌন হিংসার শিকার হয় বা তাদের পরিবারের এবং গোষ্ঠীর লোকজনকে যৌন হিংসার শিকার হতে দেখে।

নিজের দেশ, বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার সময়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়াটা একজন মহিলার জীবনে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে- সেখানে তারা নিজেদের জীবনের কোনও গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারে না, তাদের  সন্তান এবং পরিবারের মানুষজন সেখানে অনেক বিপদের মুখোমুখি হয়। মহিলাদের অনেকসময়ে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বা গর্ভবতী অবস্থায় নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে হয়। তখন একজন মা নিজের সন্তানকে খিদের জ্বালা সহ্য করতে দেখে। একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার সময়ে তাদের নদী, এমনকি সমুদ্রও পেরোতে হয়, দিনের পর দিন রাস্তায় মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় এবং এই পরিস্থিতিতে তখন তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য একটু আশ্রয় খোঁজে।

কখনও কখনও এই যাত্রাপথে তারা তাদের পরিবারের মানুষজনকে হারিয়ে ফেলে। তখন নিঃসঙ্গতার অভিজ্ঞতা তাদের কাছে অবিশ্বাস্যভাবে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে এবং মানসিকভাবে তারা ভীষণ আঘাত পায়। এভাবে একজন উদ্বাস্তু মহিলাকে নানারকম কঠোর পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়।

যখন মহিলারা মানুষে-মানুষে সংঘর্ষ বা যুদ্ধের শিকার হয় তখন তারা নিজের গোষ্ঠীর দ্বারা নিপীড়িত হয় এবং নিজেরই দেশে বৈষম্যের শিকার হয়। সেই সঙ্গে তাদের আত্মপরিচয় বা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়। নিজের বাসস্থান থেকে উৎখাত হওয়ার আগে তারা যে পরিস্থিতিতে বসবাস করে তা তাদের মধ্যে প্রত্যহ মানসিক চাপের জন্ম দেয়। জীবনধারণের ন্যূনতম পরিষেবা,পর্যাপ্ত পুষ্টি তারা পায় না এবং ক্রমাগত তারা জীবনসংকটের মধ্যে পড়ে। এই পরিবেশের মধ্যে পড়ে মহিলারা বহুবিধ ভূমিকা পালন করে, যেমন- পরিচর্যাকারী হিসেবে, ঘরের কাজকর্ম সামলায় আবার রোজগারের জন্য বাড়ির বাইরেও পা রাখে। তবে এসব কাজে তাদের সাহায্য করার মতো কেউ থাকে না। মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্বের মধ্যে পরিবারগুলো তাদের পুরুষ সদস্যদের হারিয়ে ফেলে। ফলে সংসার ও পরিবারের সব দায়িত্বের বোঝা মহিলাদের উপর এসে পড়ে।

এছাড়া, উদ্বাস্তুদের বা উৎখাত হওয়া মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আশ্রয়দাতা দেশ তথা সেই দেশের মানুষ কী ভূমিকা পালন করছে তা-ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। যদি উদ্বাস্তুদের আসার কারণে আশ্রয়দাতা দেশের সম্পদে ঘাটতি দেখা যায় তাহলে মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্ব এবং বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে যা তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা

উদ্বাস্তু মহিলারা যে ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার মুখোমুখি হয় তার সমাধান নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের উপর, যেমন- তাদের জীবনধারণের অভিজ্ঞতা, বর্তমান জীবনযাপনের পরিস্থিতি, ভবিষ্যতে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা, মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করার কৌশল এবং প্রয়োজনীয় সামাজিক সাহায্য।

উদ্বাস্তু শিবিরে পৌঁছনোর পরে একজন উৎখাত হওয়া মহিলার মধ্যে যেসব লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় সেগুলো হল-

  • অনিদ্রা

  • গভীর উদ্বেগ

  • খিদে বোধ চলে যাওয়া

  • বিষণ্ণ হয়ে থাকা

  • বারবার নিজের দেশ বা ঘর-বাড়ির কথা মনে আসা অর্থাৎ পুরনো দিনের কথা বারবার মনে হওয়া

  • দুঃস্বপ্ন দেখা

  • নির্লিপ্ত মনোভাব (যে কোনও পরিস্থিতিতেই আবেগানুভূতির অভাব)

  • একেবারে নীরব বা চুপচাপ হয়ে যাওয়া

এই লক্ষণগুলো পর্যায়ক্রমে কয়েক মাস ধরে দেখা দেওয়ার পর তা আস্তে আস্তে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিডিএসডি) এবং অবসাদে পরিণত হয়। তবে প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই যে এই ট্রমা বা মানসিক আঘাত পিটিএসডি বা অবসাদে পরিণত হয়, তা নয়। কিন্তু এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।

এই সমস্যা দূর করার প্রথম ধাপ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞরা সাইকোলজিকাল ফার্স্ট এইডের সাহায্য নেয়। তারপর তাঁরা উদ্বাস্তুদের সঙ্গে এমন সমানুভূতিসম্পন্ন যোগাযোগ গড়ে তোলেন যাতে তারা বুঝতে পারে যে তাদের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এই চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তাগুলো হল- নিজেদের নিরাপত্তা, উপযুক্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা, খাদ্য এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা। উদ্বাস্তু মানুষের মানসিক সুস্থতার জন্য প্রথমেই তাদের সঙ্গে অত্যন্ত মানবিক আচরণ করা জরুরি। যাতে তারা নিশ্চিত হতে পারে যে তাদের বিভিন্ন অত্যাবশ্যক চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিষেবা দানকারী ব্যবস্থা রয়েছে।

লড়াই এবং দুর্বলতা

আমি এমন অনেক উদ্বাস্তু মহিলা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে উৎখাত হওয়া মহিলাদের নিয়ে কাজ করেছি যেখানে আমি তাদের মধ্যে প্রধান যে অনুভূতি প্রকাশ পেতে দেখেছি তা হল হতাশা। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে প্রায়শই তারা ঘর-বাড়ি  জমিজমা সহ মূল্যবান সম্পত্তি হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে, যুদ্ধ বা মানুষের পারস্পরিক লড়াইয়ের জন্য তারা তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের হারিয়ে ফেলে। প্রায়শই দেখা যায় যে, উদ্বাস্তু মানুষের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তার সিদ্ধান্ত নিতেই দেশের সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠনগুলোর অনেক সময় লেগে যায়। এই অনিশ্চয়তাজনিত পরিস্থিতি দূর করতেই অনেকসময়ে কয়েক মাস বা কয়েকটা বছর কেটে যায়; এবং এই অনিশ্চয়তা নিয়েই উদ্বাস্তু গোষ্ঠীকে দিনের পর দিন জীবনধারণ করতে হয়। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে এইসময়ে উৎখাত হওয়া মানুষ গভীর দুঃখ এবং স্বজন হারানোর শোক নিয়ে বেঁচে থাকে। এই অবস্থায় নিজেদের কাছে তাদের একটাই জিজ্ঞাসা থাকে যে ভবিষ্যতে কে তাদের এবং তাদের সন্তানদের দায়দায়িত্ব নেবে?

যখন একসঙ্গে বহু উদ্বাস্তু ও ছিন্নমূল মানুষ একটা দেশে বা অঞ্চলে এসে জড়ো হয় তখন প্রাথমিকভাবে তাদের কপালে সাময়িক বাসস্থান বা আশ্রয় জোটে ঠিকই কিন্তু  সেই সব ঘনবসতিপূর্ণ ঘরগুলোতে না থাকে দরজা বা নিজেদের গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যবস্থা। এসব ক্ষেত্রে মহিলাদের জীবনে যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। এই পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের গোষ্ঠীর মানুষজন বা আশ্রয়দাতা গোষ্ঠীর মানুষজন- উভয়ের দ্বারাই যৌন হিংসার শিকার হতে পারে। এসময়ে তাদের জীবনে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কিছুই থাকে না। কিন্তু এই অবস্থায় তারা এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে যার দ্বারা নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তারা নতুন কৌশল শিখতে পারে অথবা এমন ব্যবস্থা নিতে পারে যার ফলে তাদের আর অতীতের মতো কোনও খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে না হয়।

প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে একজন উদ্বাস্তু মহিলা ক্রমাগত জীবনের মূল প্রয়োজনীয়তাগুলো পূরণের জন্য নানারকম উপায় খোঁজে। প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবিলা এবং তা অতিক্রম করার জন্য মহিলাদের নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য তাদের একনাগাড়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। এভাবে বেঁচে থাকতে গিয়ে অনবরত তাদের যখন শক্তিক্ষয় হয় তখন  মানসিকভাবেও তাদের মধ্যে অবসাদের জন্ম হয়। এই ঘটনা প্রায়শই ঘটে কারণ তাদের সামনে প্রচুর পরিমাণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় এবং এসব তাদের কতদিন যে সহ্য করতে হয় তার কোনও হিসেব থাকে না। এই পরিস্থিতিতে এক-একজন  মানুষের বহিঃপ্রকাশ এক-একরকম হয়।

উদ্বাস্তু মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পড়া এই চাপ অবিরাম চলতে থাকে এবং  এর ফলে তাদের মধ্যে আরও নানা ধরনের সমস্যার জন্ম হয়। এই সমস্যা অতিক্রম করার পথ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া খুব দীর্ঘ এবং জটিল হয়। কারণ এইসময়ে একট বড় অংশ জুড়ে তাদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জীবনে নানা বদল ঘটতে দেখা যায়।

প্রবন্ধটি লিখেছেন লেপালের কাঠমাণ্ডুর মানসিক স্বাস্থ্য এবং অক্ষমতা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রথমা রাঘবন। নেপাল, মায়ানমার এবং বাংলাদেশের উদ্বাস্তু সমস্যা এবং দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত উৎখাত হওয়া গোষ্ঠীদের নিয়ে তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে।